ভাওয়ালের মেজকুমার ৭২ বছর আগে কলকাতা হাই কোর্টে নিয়মিত আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেন? না, নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠায়। ‘এক যে ছিল রাজা’-র মেজকুমার যিশু সেনগুপ্ত-কে সেই আদালত চত্বরে নিয়ে এলেন ইন্দ্রনীল রায়।
সকাল ৮:৪৫। সে দিন দোসরা অক্টোবর বলে হাইকোর্ট চত্বর শুনশান। গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। জীবনের অনেক বছর এই কোর্টের চত্বরেই তো কেটেছিল ‘ভাওয়াল রাজা’র। ছবি তুলতে গিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে উঠছিলেন। একা একা কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়েও রইলেন বহু স্মৃতিবিজড়িত থামে হেলান দিয়ে।
কলকাতা হাইকোর্টের এই লম্বা করিডর, বড় থাম, উঁচু উঁচু সিঁড়ি। এখানকার কোনও ঘরেই তো ৭২ বছর আগে বিখ্যাত ভাওয়াল মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। কেমন লাগছে এখানে এসে যিশু?
যিশু: অদ্ভুত। ‘এক যে ছিল রাজা’-র পুরো জার্নিটা আজকে হাইকোর্ট চত্বরে এসে সম্পূর্ণ হল। এখানে আসাটা বোধহয় পোয়েটিক জাস্টিস।
সিনেমা করার আগে আপনি বিস্তারিত জানতেন কেসটার ব্যাপারে?
যিশু: বাকি পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো আমার ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ নিয়ে যতটুকু জানা, সেটা উত্তমকুমারের ‘সন্ন্যাসী রাজা’ দেখেই। তার পর ঋতুদার ‘নৌকাডুবি’ করার সময় স্ক্রিপ্টে একটা সিকোয়েন্স ছিল যেখানে মুখে পান নিয়ে আমি রিয়াকে (সেন) বলছি, “ভাওয়াল সন্ন্যাসী কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং জায়গায় পৌঁছেছে। ভার্ডিক্টটা কোন দিকে যাবে তা নিয়ে দেশ জুড়ে হুল্লোড় হচ্ছে।” ওই সিকোয়েন্সটা করার সময় ঋতুদার কাছ থেকে আর একটু জেনেছিলাম ওঁর সম্বন্ধে।
[ আবিরের পুজো মানে শোভাবাজার রাজবাড়ি, যিশুর পুজো কাটে অন্যভাবে ]
সেই সময় সত্যি তো দেশ জুড়ে হইচই হয়েছিল। পুরো কেসটাকে ‘সোশ্যাল এন্টারটেনমেন্ট’-ও বলা হয়েছিল। বেশ কিছু বইতে পড়েছি, হাই কোর্ট চত্বরেও বহু লোকে আসত যে দিন যে দিন এই কেসটার হিয়ারিং থাকত।
যিশু: আসবেই তো। কী ছিল না বলুন তো কেসটায়? সেক্স, স্ক্যান্ডল, মার্ডার। সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে, টাকাপয়সা, এস্টেটের মালিকানা। সে জন্যই তো সৃজিত বারবার বলছে ওকে আলাদা করে গল্পে কোনও মোচড় খুঁজতে হয়নি। সত্যি তো, রাজা মহেন্দ্র নারায়ণ রায়ের মতো কালারফুল চরিত্র ভারতবর্ষে খুব কম এসেছে।
ওঁর আসল নাম ছিল রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। অনেকে আবার ভাওয়ালের মেজকুমারও বলতেন।
যিশু: হ্যাঁ, সিনেমার জন্যই নামটা বদলানো হয়েছে এখানে। কী সাংঘাতিক কেস! ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন। তার পর কলকাতা হাইকোর্টে কিন্তু কেসটা আসে যখন, ঢাকার কোর্ট রায় দিয়ে বলে যে উনিই রাজা।
হ্যাঁ। রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী (সিনেমার মহেন্দ্র নারায়ণ) বিভাবতী দেবী নতুন করে এই কলকাতা হাই কোর্টে আবার আপিল করেন। ১৯৩৬ সাল সেটা…
যিশু: কারেক্ট। তার পর থেকে পুরো কেসটা কলকাতা হাইকোর্টেই হয়। আপনি তখন ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমি বসে বসে ভাবছিলাম, কী সব ঘটনাই না ঘটেছে এই কোর্ট চত্বরে। একটু হেঁটে দেখছিলাম। কত ইতিহাসের সাক্ষী এই টেবিল-চেয়ারগুলো। কত জীবন বদলে গেছে এখানে একটা পেনের সইতে। অদ্ভুত একটা গা-ছমছমে ভাব আছে। ‘কফিহাউস’ না আনলে কোনও দিন এখানে আসতাম না। ভাবছিলাম কী সব দিনই না ভাওয়ালের রাজা দেখেছেন এখানে। ভাবলেই আজও গায়ে কাঁটা দেয়।
হ্যাঁ, ১৬৪টা সিটিং এই হাই কোর্টে যে বেঞ্চে হয়, সেই বেঞ্চে ছিলেন তিনজন বিচারক- লিওনার্ড কস্টেলো, চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও রোনাল্ড ফ্রান্সিস লজ।
যিশু: এর মধ্যে একজন জাজ শুনানির আগেই ইংল্যান্ড ফিরে যান।
যাঁ। জাজ কস্টেলো। উনি ইংল্যান্ড থেকে ২৫ জুন ১৯৪১ জাজমেন্ট পাঠান। কলকাতার এই কোর্টে যা খোলা হয় ২৯ আগস্ট ১৯৪১-এ। চারুচন্দ্র বিশ্বাস জাজমেন্ট দেন রাজার পক্ষে।
যিশু: হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন অভিনেতা হিসেবে আমি বারবার বোঝার চেষ্টা করেছি সেই মুহূর্তে ওই মানুষটার মনে কী চলছিল। এখানে আসার পর থেকে সেটাই ভেবে চলেছি। অপমান, রাগ, কত কী না সহ্য করতে হয়েছিল। তবে সিনেমাটা করে আমার মনে হয়েছে, জনগণ ওঁকেই সাপোর্ট করেছিলেন। ওঁর এস্টেটের মানুষ তো নাকি সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টে আসতেন। তাঁদের সাপোর্টটা নিশ্চয়ই একটা বিরাট অবলম্বন ছিল ওঁর কাছে। (অন্যমনস্ক)
কিছু ভাবছেন?
যিশু: (বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে) না, এই যে কোর্টের এখানে বসে আছি, ভাবছি কত পরীক্ষাই না ওঁকে দিতে হয়েছে এখানে। হ্যান্ডরাইটিং টেস্ট, ডক্টরদের নানা টেস্ট, ঘোড়া চালাতে পারেন কি না তার পরীক্ষা। সিনেমাটা করার পর এই কোর্টে আসাটা আমার কাছে তীর্থভ্রমণের মতো হল।
১৯৪০-এর রায়ের পরেও তো ওঁর স্ত্রী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হায়েস্ট কোর্ট অফ আপিল, প্রিভি কাউন্সিলে কেসটা নিয়ে যান। তাঁরাও ১৯৪৬-এ রায় দেন ওঁর পক্ষে।
যিশু: হ্যাঁ। আর ওই ফাইনাল রায় দেওয়ার পরের দিনই মারা যান উনি। কী জীবন! বউ আর শালার মতে ১৯০৮ সালে দার্জিলিংয়ে মৃত্যু। ১৯২১-এ নাগা সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে আসা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কোর্টের লড়াই। ফাইনালি রায় জিতে উঠে পরের দিন মৃত্যু। হোয়াট আ লাইফ!
আজকের বাংলাদেশের ভাওয়াল এস্টেটে যেতে ইচ্ছে করে আপনার এই ছবিটা করার পর?
যিশু: করে। খুব ইচ্ছে করে। শুনেছি ওটা এখন একটা গভর্নমেন্ট অফিস। তবে দেখতে ইচ্ছে করে ওই ঘরগুলো। ওঁর বসার ঘর, ওঁর বিখ্যাত নাচঘর। আপনার এডিটরকে বলে, চলুন ওখানে। এই হাইকোর্টে আসার মতোই অভিজ্ঞতা হবে আমাদের।
এই ছবিতে অনেকটা জুড়েই আপনি শুধু একটি ল্যাঙ্গোট পরে অভিনয় করেছেন। কতটা শক্ত ছিল সেটা?
যিশু: প্রথম দিনটা ভীষণ কঠিন ছিল। মুর্শিদাবাদের যে মিউজিয়ামে আমরা শুটিং করেছিলাম তারা বলেছিল শুটিংয়ের জন্য মিউজিয়াম বন্ধ রাখা যাবে না। শুধু একটা দিক কর্ডন অফ করা হবে। প্রথম দিন ওখানেই শুটিং। আমি একটা গেরুয়া চাদর আর একটা টাওয়েল পরে সেটে পৌঁছেছিলাম। সে দিন সেটে বাকি অভিনেতারা রয়েছে, ফিমেল অভিনেতারা রয়েছে, জুনিয়র আর্টিস্ট রয়েছে, মুর্শিদাবাদের লোকাল থিয়েটার গ্রুপের অভিনেতারা রয়েছে। পাশে দেখলাম অন্তত একশোজন সাধারণ মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তারা জানত যিশু সেনগুপ্ত শুটিং করছে কিন্তু মেকআপ এমন ছিল যে তারা আমাকে চিনতে পারেনি। আরে তারা বুঝতে পারছে না যিশু সেনগুপ্ত কে? শুধু ল্যাঙ্গোট পরে আমি তো জানি আমি যিশু সেনগুপ্ত। আমি ভাবছি চাদর আর টাওয়েলটা খুলব কী করে? সৃজিত দেখি আমায় অ্যাভয়েড করে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি, ও নিজেও টেনশন করছে।
তার পর?
যিশু: তার পর যখন সৃজিত শটের জন্য ডাকল, আমি এক মিনিট শুধু চোখ বন্ধ করে ছিলাম। নিজেকে বললাম, এই রোলটা আমার জীবনে আর কোনও দিনও আসবে না। ভগবানকে বললাম, আমাকে শক্তি দাও যাতে অভিনেতা হিসেবে আমি আমার ক্রাফ্টের প্রতি হান্ড্রেড পারসেন্ট অনেস্ট থাকি। ব্যস। তার পর থেকে পুরো শুটিংয়ে কোনও দিন আমার কোনও লজ্জা লাগেনি। অদ্ভুত একটা মুহূর্ত ছিল সেটা আমার জীবনে। সেই প্রথম দিনের সিন থেকে আজকে এই হাইকোর্টে বসে ইন্টারভিউ। ভাওয়ালের রাজাকে ধন্যবাদ আমাকে এই জার্নিটায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আজকের যিশু সেনগুপ্তর জীবনটাও তো লার্জার দ্যান লাইফ। জিটিভি’র সর্বোচ্চ কর্তা ‘মনিকর্ণিকা’ ছবির শুটিংয়ের জন্য মুম্বই থেকে কলকাতা শুধু আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাইভেট জেট পাঠাবেন ভেবেছেন…
যিশু: (হেসে) প্রাইভেট জেট পাঠাতে হয়নি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সত্যি আমি কোনও দিন ভাবিনি যে কেউ আমাকে আর আমার দুই অ্যাটেনডেন্ট, ভোলা আর ওয়ারিসকে শুটিংয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউ প্রাইভেট জেট পাঠাবার প্ল্যানও করতে পারে।
[ সুপারহিট ছবির নায়িকাদের কেন সাদা শাড়ি পরাতেন রাজ কাপুর? ]
এ রকম লাইফ ক’জনের হয়? একদিকে কঙ্গনা রানাওয়াতের সঙ্গে ‘মনিকর্ণিকা’। হায়দরাবাদে এনটিআর-এর বায়োপিকের শুটিংয়ে আপনার জন্য আলাদা ফাইভ স্টার হোটেলের সুইট। প্রকাশ রাজের মতো অভিনেতার সঙ্গে ডিনার আর আড্ডা। সকালে মুম্বইতে মহেশ মঞ্জরেকরের সেটে লাঞ্চ। এই তো জীবন, কালীদা।
যিশু: (হেসে) হ্যাঁ জীবনটা একটু একটু করে বদলাচ্ছিল। এত তাড়াতাড়ি এতটা ফাস্ট হয়ে যাবে ভাবিনি। সে দিন একজন জিজ্ঞেস করছিল, আপনি এখন কী কী কাজ করছেন? বললাম, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দুটো হিন্দি ছবি, দ্বিতীয় সপ্তাহে একটা তেলুগু, তার পরের উইকে একটা বাংলা ছবি। বলতে গিয়ে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
শেষ প্রশ্ন। মনে করুন এটা ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাস। কিছুক্ষণ আগে রায় বেরিয়ে গেছে, মহেন্দ্র কুমারই রাজা। এই কোর্ট চত্বরে আর কেউ নেই আপনারা দু’জন ছাড়া। কানে কানে যদি কিছু বলতে হত, কী বলতেন ভাওয়ালের রাজাকে?
যিশু: হোয়াট আ কোয়েশ্চেন! (অনেকক্ষণ ভেবে) ভাওয়ালের রাজাকে শুধু কানে কানে বলতাম, সত্যি করে বলো তো, তুমি কি রাজা? ভরসা রাখো আমার উপর। আমি সত্যিটা কোনও দিন কাউকে বলব না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.