এক সময় কলকাতায় এলেই পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর অনেকটা সময় কাটত লাউডন স্ট্রিটে তাঁদের বাড়িতে। সেই সব দিনের স্মৃতি রোমন্থনে কিশোর ভিমানি।
ইমরান খান নিয়ে এখন যে পরিমাণ কাটাছেঁড়া হচ্ছে, তাঁর খেলোয়াড়জীবনেও এতটা হত কি না সন্দেহ!
ইমরান নিয়ে দেখছি এখন নানা মুনির নানা মত। আর সেটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। ‘আলটিমেট হট সিট’ বলে যদি কিছু হয়, তো তার মালিকের নাম এখন ইমরান খান। তর্কযোগ্য ভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব বলে কথা! আর তাই মিডিয়া যথেচ্ছ ভাবে ওকে নানা বিশেষণে ভূষিত করছে।
পাকিস্তানের নানা রাজনৈতিক দল এবং ইমরান-বিরোধী বিবিধ গোষ্ঠী তো এমনও বলছে যে, তাঁর স্পনসর ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সাহায্যে ইমরান নাকি কলকাঠি নেড়ে নির্বাচন জিতেছেন।
[‘অমর্ত্য-রাজনন্দিনী দু’জনেই লম্বা ইনিংস খেলবে’]
এ সব তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কয়েকটা জিনিস প্রচারের আড়ালে চলে গিয়েছে। তা হল, ইমরানের নেতৃত্ব দেওয়ার দুর্দান্ত ক্ষমতা। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচ্ছিন্ন, বিবেচিত মনোভাব। তাঁর অসীম আত্মশৃঙ্খলা আর সর্বোপরি, নিজের মতামত স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করার ক্ষমতা। ইমরান ভয়ডরহীন। দুনিয়ার শরিফ, মুশারফ, ভুট্টোরা কী বলল, তাতে তাঁর কিচ্ছু যায়-আসে না। পাকিস্তানের জেনারেল বা তাঁদের গুপ্তচর নিয়েও ইমরানের বিশেষ চিন্তা আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আর অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে খুব ভালই জানেন ইমরান। তিনি জানেন তাঁর সামনে অনেক সমস্যা- বালুচিস্তান, মোহাজির কোয়ামি মুভমেন্ট (এমকিউএম), তালিবান, দেশের আর্থিক বিপর্যয়, আভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত জঙ্গি আক্রমণ, এ সব তো আছেই। তার উপর আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা। যে দেশের সমালোচনায় ইমরান ছিলেন যথেষ্ট চাঁচাছোলা।
কিন্তু না, এ সব নিয়ে আজ লিখতে বসিনি। আজকের লেখার বিষয় হল ইমরানের কম বয়সের আনন্দোচ্ছল জীবন। আজকের লেখার বিষয় হল, ইমরানের কি সত্যি সত্যিই ‘প্লেবয়’-এর তকমা প্রাপ্য? আজকের লেখার বিষয় হল, কলকাতার সঙ্গে ইমরানের মিষ্টি সম্পর্ক।
ইংল্যান্ড দিয়ে শুরু করি। গরমকালে তখন ইংল্যান্ডে বেড়াতে যেতাম আর দেখা হত ইমরানের সঙ্গে। তখন আটের দশকের গোড়ার দিক। শিন-এ যন্ত্রণাদায়ক স্ট্রেস ফ্যাকচার নিয়ে কাহিল ইমরান। তাঁর কাউন্টি সাসেক্সের হয়ে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছিলেন তিনি। আপনাদের অনেকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে, ১৯৮৫ মেলবোর্ন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও ইমরান খেলেছিলেন শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে।
যাই হোক, ওই সময়টায় ওয়ারউইকশায়ার আর ডার্বিশায়ারে নিয়মিত কাজ থাকত ইমরানের। স্পনসরের গাড়িতে তাঁর সঙ্গে আমিও বার্মিংহাম আর ডার্বি যেতাম। ওই লম্বা ড্রাইভগুলো আমাকে সুযোগ দিয়েছিল আসল ইমরানকে চেনার চেষ্টা করার।
[কেন ভারতীয় পরিচালক তৈরি করবে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক? ক্ষুব্ধ ওপার বাংলা]
মাঠের বাইরে কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না ইমরান। বরং লং ড্রাইভের ওই সব আড্ডায় বারবার বেরিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক ইতিহাস আর কূটনীতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ। যা অবশ্যই অক্সফোর্ডের মতো রাজনৈতিক ভাবে চঞ্চল একটা জায়গায় পড়াশোনা করার ফসল। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি-র রাজনৈতিক দর্শন ইমরানের কাছে ছিল প্রায় নেশার মতো। আমাদের দেশের চাণক্যর মতো ম্যাকিয়াভেলি-ও একটা কালজয়ী বইয়ের স্রষ্টা। রাজনৈতিক শক্তি অর্জন আর ব্যবহারের অসাধারণ হ্যান্ডবুক ম্যাকিয়াভেলি-র ‘দ্য প্রিন্স’। ইংল্যান্ডের ওই লং ড্রাইভগুলোতেই বুঝে গিয়েছিলাম, ইন-সুইং বোলিং আর কভার ড্রাইভের অনেক, অনেক দূর দিগন্তের লক্ষ্যে ছুটছেন ইমরান!
ইংল্যান্ডের সোসাইটি কলামে ইমরানের একটা বিশেষণ ছিল- প্রাইজড পার্টি গেস্ট। ডিনারের পরের কথোপকথন বিলেতের পার্টি সার্কিটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই মাঠেও ইমরান ছিলেন অদ্বিতীয়। স্বাভাবিকভাবেই উইকএন্ড পার্টিতে তাঁর অশেষ চাহিদা ছিল।
রাজবংশের সদস্য, ফিল্মস্টার, রাজনৈতিক নেতা, সেরা স্পোর্টসম্যান- কারা কারা সব আসতেন সেই পার্টিতে! খেলার জগতের তারকাদের মধ্যে আসতেন সেবাস্টিয়ান কো, রজার ব্যানিস্টার, এডমান্ড হিলারি, ববি চার্লটন। ভাবতে পারছেন!
এমন তারকা-উজ্জ্বল সমাবেশে ইমরানের আগে উপমহাদেশ থেকে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের নামগুলোও সমান প্রভাবশালী। কোচবিহারের মহারাজ। জয়পুরের রাজা। পাকিস্তানের বিখ্যাত জেনারেল গুল হাসান। সোশ্যালাইট লায়লা তালুকদার। খুশবন্ত সিং, মনোহর মালগাঁওকরের মতো লেখক।
আজ স্কটল্যান্ডের কোনও রাজপ্রাসাদে চ্যারিটি উইকএন্ড তো কাল লর্ড অ্যাস্টরের ক্লাইভডেন এস্টেটে শনি-রবি কাটাচ্ছেন ইমরান। সেখানে তাঁর সঙ্গী কারা? না, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান। পপ তারকা মিক জ্যাগার। ফিল্মস্টার হিউ গ্রান্ট। এত গ্ল্যামারাস পার্টির নিয়মিত সদস্য হিসেবে ফ্লিট স্ট্রিট পেজ থ্রি-র প্রিয়পাত্র তো হবেনই ইমরান!
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি। ইংল্যান্ডের সমাজে ইমরান দারুণ জনপ্রিয় হলেও ও দেশের মিডিয়া কিন্তু তাঁকে কোনও কেচ্ছায় জড়ায়নি। ইংল্যান্ডের মিডিয়া তখন ব্যস্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলানের স্ত্রীর নানা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে। তার সঙ্গে ছিল ওয়াশিং মেশিন টাইকুন জন ব্লুমের নানা কীর্তি। সর্বোপরি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি স্যর জেমস গোল্ডস্মিথ, তিন দেশে যাঁর তিনজন স্ত্রী ছিল! মজার ব্যাপার, এই গোল্ডস্মিথই পরে হলেন ইমরানের শ্বশুরমশাই। হ্যাঁ, ইনিই ইমরানের প্রথম স্ত্রী জেমাইমার বাবা।
[‘ইন্ডাস্ট্রি বদলাচ্ছে বলেই আমি এখনও টিকে আছি’]
আমাদের ভারতবর্ষেও ইমরানের জীবন কম রঙিন ছিল না। ১৯৭৯-’৮০ সালের সফরে কলকাতায় এলেন ইমরান। তখনই তিনি প্রথম এসেছিলেন আমাদের লাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে। সফরকারী পাকিস্তান দলের জন্য আমরা বাড়িতে পার্টি দিতাম। সে সব জমায়েতে আসতেন নানা ফিল্মস্টার, বিখ্যাত খেলোয়াড়, সোশ্যালাইট এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই পার্টিতে ইমরানের সবচেয়ে প্রিয় দু’টো জিনিস ছিল, বিরিয়ানি আর নতুন লোকজনের সঙ্গে আলাপ।
তখনকার বম্বেতে ইমরানের জন্য পার্টি দিতেন দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না এবং বিখ্যাত সোশ্যালাইট পরমেশ্বর গোদরেজ। এ সব পার্টিতে কখনও পুরো পাকিস্তান টিমের নেমন্তন্ন থাকত, কখনও শুধুমাত্র ইমরানের।
আমিও তাঁর সঙ্গে এ রকম বহু পার্টিতে গিয়েছি। ইমরানের পার্টি-কীর্তি নিয়ে যতই রসালো গল্প থাকুক না কেন, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। হ্যাঁ, এ ধরনের আড্ডায় ইমরান সব সময় সুন্দরী-পরিবৃত হয়ে থাকতেন। কিন্তু তাঁর ব্যবহারে সব সময় থাকত নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভ্রমের ছোঁয়া।
আর একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করব। সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইমরান খান মোটেও ‘প্লেবয়’ ছিলেন না। ইমরান খান বরং এক বিরাট ব্যক্তিত্ব যিনি অসাধারণ ক্রিকেট খেলতেন, কিন্তু যাঁর ভাগ্যে ক্রিকেটের চেয়ে অনেক, অনেক বড় কিছু অপেক্ষা করে ছিল!
[সিসিডি-বারিস্তার যুগেও ইতিহাসের আভিজাত্যে গর্বিত ‘ফেভারিট কেবিন’]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.