সরস্বতী পুজো মানেই বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে। বাসন্তী রঙের শাড়ি বা পঞ্জাবি পরে পছন্দের মানুষটির সঙ্গে আলাপ জমানোর জন্য এই দিনটারই অপেক্ষা করে থাকে বাঙালি তরুণ-তরুণীরা। সেলিব্রিটিরাও তার ব্যতিক্রম নন। স্মৃতির ভাঁড়ার উপুড় করে সেই কথাই জানালেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীজাতরা।
হলুদ শাড়ির প্রেমফেম হয়নি
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছুটকোছাটকা প্রেম আমার জীবনে হয়নি। প্রেমগুলো সব সময় সেরকমই হয়েছে যাকে জটিল জড়িয়ে পড়া বলা যেতে পারে। এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, সরস্বতী পুজোর নির্দিষ্ট দিনে হলুদ শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবির মধ্যে পুজো মণ্ডপ, স্কুল বা পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যে ধরনের প্রেমগুলো ঘটে যায়, তেমনটা আমার জীবনে কখনও হয়নি। আমি অত চোখটোখ মটকাতে পারতাম না। আঁচলের ঝাপটাও দিতে পারতাম না। নখ খুঁটতে পারতাম না। আমাদের সময়ের হিসেবে আমি একটু বেশি বোল্ড ছিলাম। তা ছাড়া আমি ছিলাম কবি। আমার মূল সমস্যা ছিল প্রেমে পড়লেই শোকে পাথর হয়ে যাওয়া। এটা একটা সাংঘাতিক মানসিক অবস্থা। তবে চোখে-চোখে প্রেম, ইশারায় প্রেম, হাতচিঠি চালাচালি, পাঁচিলে একটা কার্ড রেখে যাওয়া, মেয়েদের স্কুলে ছেলেদের সরস্বতী পুজোর প্রসাদ খেতে আসা, এসে সঙ্গে সঙ্গে প্রেমে পড়া ও আধ ঘণ্টার মধ্যে ভূপেন বোসের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হেঁটে প্রেম করতে বেরিয়ে যাওয়া- এসব অনেক দেখেছি। অনেক প্রেম এখান থেকে শুরু হয়ে বিয়ে পর্যন্ত গেছে, তাও দেখেছি। এই যে দুটো চোখের মিলনে আকস্মিক একটা স্পার্ক তৈরি হয়। তারপর সেই স্পার্কটার মজা নিতেই আবার তাকানো, আবার এবং বারবার- এটাই গড়াতে গড়াতে একটা বিরাট বল হয়ে যায়। সেটাই প্রেম। সেদিক থেকে প্রেমে চোখ আর চোখের ম্যাজিকের কোনও তুলনা হয় না।
মা সরস্বতী ইজ ‘টু কুল’
রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোয় কুল ছিল হাইলি ডেঞ্জারাস ফল। কারণ পুজোর আগে কুল খাওয়া ইজ ইকুয়াল টু মা সরস্বতীর রেগে যাওয়া! কিন্তু আমার এবং মায়ের কুল ছিল ফেভারিট। তাই ভাল কুল বাজারে এলে আমাদের পেটেই তাদের অন্ত্যেষ্টি হত। খেতাম আর অপরাধবোধ কাজ করত। ছোটবেলার সব অঙ্ক পরীক্ষাগুলো নিয়ম করে পড়ত সোমবার। তার আগের দিন থাকত রোববার। সেদিন হত যাবতীয় অঙ্ক কষাকষি। পাড়ার মোড়ে ঠিক শনিবার বাজত ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল’। মনে হত গানটা আমাকেই উৎসর্গ করা হয়েছে। সে এক বীভৎস বিভীষিকা। তবে অঙ্ক পরীক্ষার কাছে তা ছিল একেবারে নগণ্য। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া মানে অঙ্ক মার্কশিটে কুল গোল্লা হয়ে ফেরত আসবে। খাওয়ার পরে মনে হত কেন কুলের লোভ সামলাতে পারলাম না? তবে অঙ্কের মার্কশিটে আমার খুব ক্ষতি হয়নি। এখন অঙ্ক ভয় পাই। কিন্তু কুলকে পাই না। আমার মনে হয় মা সরস্বতীও ইজ টু ‘কুল’ টু ওরি অ্যাবাউট কুল।
সে-ই আমার সুন্দরী সরস্বতী
সুবোধ সরকার
বছর দুয়েক আগে আমি সাঁওতাল পরগনায় গিয়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় একটি মেয়েকে দেখে আমার চোখ আটকে যায়। মেয়েটির মাথায় ছিল বাবুই ঘাসের বোঝা। আর কাঁখে শিশু। কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে হয়তো কাজে যাচ্ছে বা কাজ থেকে ফিরছে। ওর চলার ছন্দটা এত সুন্দর ছিল যে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। একটু চেষ্টা করলাম, ওর মুখটা যদি দেখা যায়। কিন্তু খুব ভাল দেখতে পেলাম না। ওই মেয়েটি একদিকে মা, আর একদিকে শ্রমিক। আবার ওই কোলের শিশুর হাতে প্রথম স্লেট-পেন্সিল ওই ধরিয়ে দেবে। হয়ত অ-আ-ক-খ’র প্রথম পাঠটা সেই তার সন্তানকে শেখাবে। মেয়েটি কতটা রূপসী আমি জানতে পারিনি, সেদিন সরস্বতী পুজোও ছিল না, তবে এখনও মন্ডপে মা সরস্বতীর দিকে তাকালে আমার চোখে ওই মেয়েটির মুখটাই আবছা ভেসে ওঠে। আমার চোখে ওই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী, আমার সরস্বতী।
সেই বাসন্তীবাস কিশোরী
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৫৪-৫৫ সালটাল হবে। শ্যামবাজারের রামধন মিত্র লেনে রাজেনবাবুর টোলে সংস্কৃত পড়ি বছর তেরো কি চোদ্দর আমি। টোলে সরস্বতী পুজোর আয়োজন। বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে পুজো হচ্ছে। সে এল হঠাৎ অঞ্জলি দিতে। কোন রূপকথা থেকে উড়ে এল, কে জানে! যখন আলাপ হল সেই বাসন্তী-বাস পরা কিশোরীর সঙ্গে, মনে হল এমন চোখ, এমন ভুরু, এমন ঠোঁট আর হাসি-আলো-করা এমন দন্তরাশি এই প্রথম দেখলাম। আর এই প্রথম মন আর শরীর একই সঙ্গে তরঙ্গ তুলল তুমুল বাসনার। সেই প্রথম। তাকে আজও ভুলিনি। আমার লেখার প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তাকে ছুঁয়ে থাকে।
বাসন্তী রোদ্দুরে
শ্রীজাত
সরস্বতী, আসেন যদি আজ আমাদের পাড়ায়
চাইব যেন সবার ভাষা নিজের পায়ে দাঁড়ায়।
এত মানুষ বলছে কথা, এতরকম সুরে
আপনি তাদের এক করে দিন বাসন্তী রোদ্দুরে।
কথার গায়ে-হলুদ, তারও ভাবনামতে বিয়ে
দুঃখগুলো মুছিয়ে দেবেন, হাঁসের পালক দিয়ে?
হোক লেখা ফের নতুন করে কাব্য এবং গান
অক্ষরে হোক হাতেখড়ি, পাতে জুটুক ধান
যে যা খুশি দাগ টেনে দিক, আসলে এক জমি
মুখে যা হোক, বুকের ভেতর বসন্তপঞ্চমী!
সরস্বতী, আসেন যদি আজ আমাদের পাড়ায়,
চাইব, যেন প্রসাদ পেতে সক্কলে হাত বাড়ায়…
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.