ভাস্কর লেট: অনুভূতি যদি হয় সুখময় এবং ভরন্ত, তাহলে বিশেষণ ব্যবহারে দোষ নেই। অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ গোত্র’ সিনেমায় সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী সম্ভবত তার জীবনের সবথেকে ‘ডেলিকেট’ ও ‘স্পর্শকাতর’ মামলার সমাধান করল।
‘ডেলিকেট’ এই জন্য যে, সত্যবতীর সঙ্গে ব্যোমকেশের দাম্পত্য এখানে প্রখরভাবে পরীক্ষিত হবে তৃতীয় এক পুরুষের আগমনে। সে পুরুষ প্রত্যক্ষ নির্লজ্জতায় চেষ্টা করবে সত্যবতীকে প্রাণিত করতে তার প্রেমে। এবং সেটাও আবার ব্যোমকেশের সামনে। বরের সামনে বিবাহিত নারীর রূপের যৌনগন্ধী প্রশংসা করতে বিরাট ধক লাগে মশাই। ‘জীবনসঙ্গী’ ব্যোমকেশ সেটা কী করে সামাল দেবে? এ এক অনন্ত সম্ভাবনার কুয়ো।
দ্বিতীয়ত, যে কারণে ‘স্পর্শকাতর’ লিখেছি, এই প্রথম ব্যোমকেশ আশ্চর্য একজন মক্কেল খুঁজে পেল, যে জানে সে ক’দিনের মধ্যে মরতে চলেছে! কিন্তু তারপরেও নিজেকে বাঁচাতে চাইছে না। বরং তার ইচ্ছা, অপঘাত মৃত্যুর পর ব্যোমকেশ খুনের তদন্ত করে সত্য আবিষ্কার করুক। মরি মরি, কী কাণ্ড! ছেলেটা পারিশ্রমিক অবধি আগে দিল। মরে গেলে পাছে টাকা মার যায়।
এমনতর ধাঁধার সামনে ব্যোমকেশের মতো লগনচাঁদা ছেলেও ক্ষণেকের জন্য হতচকিত। কেননা, এ যাবৎ তো জীবনাভিজ্ঞতায় সে জেনে এসেছে– মৃত্যুভয়ের সামনে সব রিস্ক ফ্যাক্টর তুচ্ছ। সব সম্পর্ক ফিকে। সব সম্পদ পানসে। সব খুশি বেরং। অতএব ব্যোমকেশ দাঁড়িয়ে আছে দু’মাথার মোড়ে।
এক) সে কি তার মক্কেলকে বাঁচানোর প্রয়াস নেবে মানবিকতার খাতিরে? সেক্ষেত্রে মৃত্যু-পরবর্তী তদন্ত করার ঝকমারি থাকে না। একজনের অবাঞ্ছিত মৃতু্যও ঠেকানো যায়।
দুই) মক্কেলের মৃত্যুর পর সত্য ঢুঁড়ে অপরাধীকে পেলে সে কী করবে? বিচার করা বা শাস্তিদান তো আদতে তার কাজ নয়। তাহলে?
[ কতটা ‘আনলিমিটেড’ ‘হইচই’ করলেন দেব? হলে যাওয়ার আগে জেনে নিন ]
‘রক্তের দাগ’ শরদিন্দু বন্দে্যাপাধ্যায়ের বিশিষ্ট লেখাগুলির মধ্যে বিশিষ্টতম। লেখকের মর্জি অনুযায়ী, ‘সামাজিক উপন্যাস’ হিসেবে যদি এই টেক্সট পড়ি, তাহলে এর বিষয় আবহমান– লাম্পট্যের ঝাপটানি। সমাজের শিরা-ধমনীর ঘেরাটোপে যা লুকিয়ে থাকে। সময়ে-অসময়ে যুদ্ধবাজ সাবমেরিনের মতো টর্পেডো ঝাড়ে। তখন নারী ও পুরুষ বহুগামী হয়। একে-অন্যের শিকারে মাতে। আর, যদি একে পড়ি রহস্যোপন্যাসের ছাঁদে ছক মিলিয়ে, তাহলে এই সিনেমা শরদিন্দুর মনের গতিকে পরম যত্নে অনুসরণ করেছে। এ সিনেমা ‘সত্যান্বেষী’ ব্যোমকেশের মানব-মহিমায় উত্তীর্ণ ও গোত্রান্তর হওয়ার গল্প। পরিচালক অরিন্দম শীল ভীষণ যত্ন নিয়েছেন। উপন্যাসের প্রতি। এবং উপন্যাসের চাল অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে সিনেমার মাচায় ফলবতী করে তোলার প্রশ্নেও। যেখানে যেখানে তিনি টেক্সট ভাঙছেন, গল্পের ভিন্নতর সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছেন শিল্পীর স্বাধীনতায় আস্থা রেখে, তাও যথাযথ। তাঁর আগের ব্যোমকেশের হতাশা কাটিয়ে দর্শক এখানে পাবেন বিনোদনের বুড়বুড়ি।
‘রক্তের দাগ’ বহুলপঠিত উপন্যাস। তবু এমন একজন-দু’জন তো থাকবেনই- যাঁরা উপন্যাস না পড়েই এই সিনেমা দেখতে চেয়ে একচক্ষু হরিণের মতো পরিচালকের দরজা ঠকঠকাবেন। তাই গল্পটা আমরা বলব না। শেষে কী হবে, বলার প্রশ্নই নেই। কিন্তু বললে সম্ভবত উচিত হত। কারণ, অরিন্দম শীল অসম সাহসিকতার সঙ্গে এই ছবিতে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। সিনেমার একটা পর্যায়ে গিয়ে যেভাবে তিনি রহস্যটা সাজান, তাতে ব্যোমকেশের ভূমিকা হয়ে যায় স্থিতধী দর্শকের। সে বুঝতে পারছে তার মক্কেল সত্যকাম মরবেই। খুন অনিবার্য। নারী-পুরুষের সম্পর্কটাকে অনূর্ধ্ব পঁচিশের এই ছোকরা যেভাবে খোলামকুচি জ্ঞান করে, তাতে এমন একজনও সমব্যথী পাওয়া ভার- যে চাইবে ছোকরা বেঁচে থাকুক। কিন্তু নিয়তি যে বড় বালাই। ব্যোমকেশ তাই দুর্ঘটনার জন্য নীরবে স্পন্দিত হতে থাকে। মৃত্যু নামে। সূর্যাস্তের মতো। অপরিবর্তনীয় হ্যাবিচুয়াল ফ্যাক্ট হয়ে। তারপর প্রতিরোধের প্রবল সুনামি ওঠে। এই মামলার তদন্ত থেকে ব্যোমকেশকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন ব্যোমকেশ কীভাবে দুর্গরক্ষা করবে- সেটা তারিয়ে তারিয়ে দেখা– আমার মতো যে ব্যক্তি অন্তত ২০ থেকে ২৫ বার ‘রক্তের দাগ’ উপন্যাসটা পড়েছে মুগ্ধ হয়ে, তার কাছেও তীব্রতম কঠিনতম নার্ভের লড়াই।
শরদিন্দুবাবুর উপন্যাসটি কঠোরভাবে কলকাতায় সীমাবদ্ধ ছিল। আর সিনেমার পরিচালক কলকাতা ও মুসৌরির মধ্যে গল্পটাকে গমনাগমনে বাধ্য করেছেন। দেশভাগের দাঙ্গা, রিফিউজি ক্যাম্পের যাতনা-ভরা ইতিহাস, বিপ্লবের প্রতীক্ষায় গোপনে প্রস্তুত হতে থাকা কিউবার রাষ্ট্রিক পরিবেশ হুড়হুড় করে চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়তে থাকে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না।
ছান্দোগ্য উপনিষদে সত্যকামের উল্লেখ আছে। সে তার মা-র কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চেয়েছিল। উত্তর পায়নি। আর, এই সিনেমায় ব্যোমকেশের মক্কেল সত্যকামও মায়ের কাছে এই প্রশ্ন রাখতে বাধ্য হয়। সৌভাগ্য বলুন বা বেচারির দুর্ভাগ্য- উত্তরটা কলির সত্যকাম পেয়ে যায়। জগতের কিছু কিছু সত্য হয়তো বা পদ্মপাতায় জলের মতো ফ্লেক্সিবল হয়েই থাকা উচিত। চাইলেই যা গড়িয়ে দেওয়া যাবে। তাতে সুখ বা স্বস্তি না থাক, স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। তার বদলে গোপনতার সুড়ঙ্গে যদি সূর্যসম্পাত ঘটে? জ্বলতে ও পুড়তে হবেই।
দারুণ অভিনয় করেছেন আবির চট্টোপাধ্যায়। খোলসে ঢুকে ভাবনায় মন্থিত হওয়ার সময় যেমন আবির খাসা, তেমনই চোখে চোখ রেখে অন্যকে চমকাতেও দুরন্ত। এ সিনেমাতেও আবিরকে হাতেনাতে অ্যাকশন করতে হয়েছে। স্বাভাবিক!
গাই রিচি-র শার্লক হোমসের পর গোয়েন্দাদের প্রোটোটাইপ ভাঙতে বাধ্য। অর্জুন চক্রবর্তী আউটস্ট্যান্ডিং। লম্পট, নেশাতুর, নারীসর্বস্ব যুবকের অভিনয়ে তিনি প্রয়োজনমতো এনেছেন অ্যারোগ্যান্স, বেতোয়াক্কা মনোভাব ও বিষণ্ণতার আলো। কখনও কখনও আবিরকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। প্রিয়াঙ্কা ও রাহুলের আন্তর্জীবনের টানাপোড়েনের ছাপ অভিনয়ে অন্তত পড়েনি। সোহিনী সরকার অভিনীত ‘সত্যবতী’-কে দর্শক খেয়াল করবেনই। লালসা-মাখা পুরুষদৃষ্টির সামনে সোহিনীর সংকোচ-মেশা রাগ ও লজ্জা মন্দ তো লাগল না।
[ গড়পড়তা ছবি থেকে অনেকটাই আলাদা ‘ভিলেন’, রয়েছে টুইস্ট! ]
আর বিশেষ করে বলতে হবে অঞ্জন দত্ত ও মুসৌরির দৃশ্যপটের কথা। অঞ্জন দত্তর করা ‘ঊষাপতি’ চরিত্রকে হাবেভাবে ও উপস্থাপনায় পরিচালক উপন্যাসে বর্ণিত ঊষাপতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়েছেন। অঞ্জন দত্তর অভিনয় দেখে মনে হল- একদিকে ভালই করেছেন। আর, স্বাধীনতার পরের মুসৌরি যতটা অনাঘ্রাতা সুন্দরী ছিল, আজ ক্যামেরায় সে এফেক্ট আনা অসম্ভব। তবু ছবিটা দেখতে দেখতে লোভ হল। পুজোর পর পকেট পারমিট করলে একবার মেরে দেওয়া যায় কিন্তু ব্যোমকেশ-ধন্য মুসৌরির ঝটিকা সফর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.