নোবেলজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে ফোনে অনেক অজানা কথাই জানালেন মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সুমন ঘোষ।
দক্ষিণ কলকাতার সেই আড্ডাটা
অভিজিৎদার বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজ ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টের কিংবদন্তি শিক্ষক ছিলেন। মুকুল মজুমদার, দেবরাজ রায়, মৈত্রেশ ঘটকের মতো বিখ্যাত ছাত্র দীপকবাবুর হাত থেকে বেরিয়েছে। আমার শিক্ষক ছিলেন দীপকবাবু। অভিজিৎদাকেও উনি পড়িয়েছেন। দীপকবাবুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে? না, অমর্ত্য সেন। দু’জন সমসাময়িক। ওঁদের বন্ধুত্ব কত গভীর আমি দেখেছি। আমি জানি দীপকবাবুর বাড়িতে ওঁদের নিয়মিত আড্ডা বসত। অমর্ত্যদা সেই আড্ডায় আসতেন। অমর্ত্যদার কাছে, দীপকবাবুর কাছে আমি সেই আড্ডার গল্প প্রচুর শুনেছি। ভাবলে স্তম্ভিত লাগে যে, দক্ষিণ কলকাতার একটা বাড়িতে আড্ডা হচ্ছে, আর সেখান থেকে কি না কুড়ি বছরের মধ্যে দুটো নোবেল প্রাইজ বেরোল!
তোমার অভিজিৎ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন
অভিজিৎদা সংগীত খুব ভালবাসেন। বিশেষ করে শাস্ত্রীয় সংগীতের দারুণ ভক্ত। তার উদাহরণ এই সেদিনও পেয়েছি।কীভাবে? আমার পরিচালিত ছবি ‘আধার’এর মিউজিক করছে শান্তনু মৈত্র। একদিন লাঞ্চ করতে করতে মুম্বইয়ে শান্তনুদার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। শান্তনুদা হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা অভিজিৎ ব্যানার্জি কে? উনি কী নিয়ে কাজ করছেন?” আমি বললাম, কেন জিজ্ঞেস করছ? শুনলাম, মুম্বইয়ে কোনও কাজে এসেছিলেন অভিজিৎদা। তখন উনি শান্তনুদাকে কনট্যাক্ট করেন। বলেন, আপনি যখন মিউজিক রেকর্ড করবেন, তখন আমি আপনার বাজনা একটু শুনতে চাই। শান্তনুদা বলল, “বেশ কয়েকদিন ভদ্রলোক রেকর্ডিং স্টুডিওতে এসেছেন। চুপচাপ বসে আমার রেকর্ডিং শুনতেন। কোনও কথা বলতেন না। গান শুনে চুপচাপ বেরিয়ে যেতেন।” অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কে? সেটা শান্তনুদা জানত না। ও শুধু জানত যে, অভিজিৎদা এমআইটিতে পড়ান। আমি শান্তনুদাকে বললাম, আরে এ তো বিরাট বড় মানুষ। নোবেল পাওয়ার দাবিদার। শান্তনুদা তো শুনে অবাক। আসলে ওঁর কাজটা যে কত বড়, সেটা অভিজিৎদা কোনওদিন কাউকে বুঝতে দেননি। ঘোষণাটা শুনেই আমি শান্তনুদাকে টেক্সট করলাম, তোমার সেই অভিজিৎ ব্যানার্জি নোবেল প্রাইজ জিতলেন!
ল্যাবরেটরিটাকে মাঠে নিয়ে গিয়েছেন অভিজিৎদা
অভিজিৎদা, ওঁর স্ত্রী এসথার আর মাইকেল ক্রেমারের কাজের একটা বড় দিক হল, এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজা। ঠান্ডা ঘরে বসে পলিসি তৈরি করার পুরনো প্রথা ভেঙে নানা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে প্রবলেম সলভ করা। যেন তাঁরা ল্যাবরেটরিটাকেই নিয়ে গিয়েছেন মাঠে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন এটা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এর কার্যকারিতাও দারুণ।
পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব
অর্থনৈতিক ভাবনার ইতিহাসে দুই বাঙালির অবদান বিশ্বে কত গভীর, ভাবলে গর্ববোধ হয়। অমর্ত্যদার কাজের সিংহভাগ ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স নিয়ে হলেও দারিদ্র নিয়ে ওঁর প্রচুর মৌলিক ভাবনা রয়েছে। ‘সেন’স পভার্টি ইনডেক্স’ বলে একটা মাপকাঠি আছে, যা দিয়ে দারিদ্রকে মাপা হয়। আটের দশকে এটা অমর্ত্যদার গবেষণার একটা বড় দিক ছিল। কিন্তু তার পরের কয়েক দশক ডেভলপমেন্টাল ইকনমিক্স একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিল। অভিজিৎদাদের কাজ সেটাকে আবার মূলস্রোতে নিয়ে এল। অভিজিৎদার কাজের একটা বড় দিক ‘ব়্যানডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস’। সহজ করে বললে, বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের ধাঁচে দারিদ্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে তা দূরীকরণের পদ্ধতি বের করা। অভিজিৎদাদের বক্তব্য ছিল, পৃথিবীর সব জায়গায় দারিদ্রের কারণ এক নয়। কেনিয়ার মানুষ যে কারণে দরিদ্র, ভারতীয়রা সেই কারণে নয়। ওঁরা মাইক্রো লেভেলে ভাবতে শুরু করেন সমস্যাটা নিয়ে। এবং আবিষ্কার করেন, নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্টভাবে দারিদ্রের মোকাবিলা করা যায় ট্রায়াল বা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে। এটা দিলে কী হয়? এটা সরিয়ে নিলে কী হয়? এভাবে ট্রায়াল করতে করতে কেনিয়ায় কাজ করেন অভিজিৎদারা। ওঁদের মডেল খুব এফেক্টিভলি ব্যবহার করেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। রাষ্ট্রপুঞ্জও লক্ষ্য স্থির করে যে, এই শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বদারিদ্র অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এতে অভিজিৎদাদের কাজ অনেক লাভদায়ক হয়। এমআইটিতে ওঁদের একটা পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব আছে। যার অন্যতম সৃষ্টিকর্তা অভিজিৎদা। সেই ল্যাবেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
বাঙালির রেনেসাঁ
অস্বীকার করে লাভ নেই যে সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বাঙালির প্রচুর অবনতি হয়েছে। কেন হয়েছে, সেই কারণে যাচ্ছি না। কিন্তু আমার মনে হয়, অমর্ত্য সেন বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা অপর্ণা সেনের প্রজন্মের যে ইন্টেলেকচুয়ালরা বাঙালিদের গর্ব, সেই ব্যাপারটা এখন বাংলায় বিশেষ নেই। শুধু নিজের বিষয় নয়, বিশ্বের সব বিষয়ের প্রতি একটা আগ্রহ, একটা জ্ঞান- এটা আমার কাছে ‘রেনেসাঁ বেঙ্গলি’। মানে শুধু ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া নয়। তার মধ্যে চিন্তার একটা প্রসার, একটা বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি থাকবে। এই ব্যাপারটা বাঙালির মধ্যে ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। এমন বিপন্নতার করিডরে অভিজিৎদার নোবেল বাঙালিকে আশা দেবে যে, সব বিভাগে বাংলার ইন্টেলেকচুয়াল অবনতির ধারা এবার পালটানোর দিকে। কে বলতে পারে ওঁর এই নোবেলজয় চাকাটা আবার ঘুরিয়ে দিল না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.