সুরের জগৎে নক্ষত্রপতন। রবিবার সকালে মুম্বইয়ের হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। ২০১৭ সালে সংবাদ প্রতিদিন-কে দিয়েছিলেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেখানেই জানিয়েছিলেন মনের কথা। শুনেছিলেন গৌতম ভট্টাচার্য। সেটিই ছিল বাংলা সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া কিংবদন্তি শিল্পীর শেষ সাক্ষাৎকার।
পঁ-চা-ত্ত-র বছর একটানা। আপনাকে প্রশ্ন করব কী, লতাজি জাস্ট সংখ্যাটাই ধুকপুক করিয়ে দেওয়ার মতো–টানা ৭৫ বছর !!!
(মৃদু হাসি) সবই ঈশ্বরের কৃপা। যা পেয়েছি সব ওঁর দান।
বলছেন কী! ঈশ্বর বর দিলেও কেউ পঁচাত্তর বছর ধরে একই জিনিসের মধ্যে এমন আাপ্রাণ আবদ্ধ থাকতে পারে নাকি? সে তো বোর হতে হতে পাগল হয়ে যাবে।
-আমার কখনও হয়নি। পেশায় আমার প্রথম দিন থেকে আজও গোটাটাই ভীষণ উপভোগ্য কেটেছে। গান গাওয়া এমন আনন্দের ঝরনা, যে কখনও বিরক্তি দেয়নি। গান ছাড়া জীবনে তো কিছু শিখিওনি। বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের চব্বিশ ঘণ্টা এটা নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকি। সারাক্ষণ ভাবি, কী করে আরও ভাল গাইতে পারি?
কিছু মনে করবেন না আপনাকে থামাচ্ছি। পঁচাত্তর বছর টানা গানবাজনা করে আসার পর এখনও ভাবেন কী করে বেটার গাইব?
হ্যাঁ, আমি তো জীবনে আর কিছু নিয়ে সময় কাটাইনি। আমার মনে হয়েছে আমার জীবনধারণ গান গাইবার জন্য, তাই গেয়ে গেছি।
গানের শুদ্ধতা সম্পর্কে অজ্ঞ হয়েও সবিনয়ে বলছি, আপনার গান মানে একটা অদ্ভুত ফ্রেশনেস। লতা মঙ্গেশকরের যে কোনও গান মানে যেন জীবনে তাঁর প্রথম গান। এত তাজা!
ঠিক কথা বলেছেন। ফ্রেশনেস। গলার ফ্রেশনেস থাকতেই হবে। সবসময় থাকতে হবে। আমার জীবনে এমন হয়েছে যে, ভরতি রেকর্ডিংয়ের শিডিউল। অথচ হঠাৎ করে আমার সাইনাসের প্রবলেম। আমি দ্রুত বলেছি সব ক্যানসেল করছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনারা অন্য কাউকে দিয়ে প্লে ব্যাক করিয়ে নিন। তারা অবাক হয়ে বলেছে, আপনার তো সাইনাস প্রবলেম। তার জন্য সব ক্যানসেল করছেন? আমি অনড় থেকেছি, কোয়ালিটির সঙ্গে কখনও কম্প্রোমাইজ করতে চাইনি। সাইনাসের সামান্য সমস্যাও গলাকে আক্রান্ত করতে পারে। ওই তাজা ভাবটাই তখন থাকবে না। সেই ঝুঁকি আমি নেব না। ঈশ্বর জানেন, কোনওদিন নিইনি।
পঁচাত্তর বছর দৌড়ে যাওয়ার জন্য কী পরিমাণ শৃঙ্খলা লাগে আন্দাজ করাই যায়। একটু বলবেন গলার শৃঙ্খলা কী লাগে? মানে কী কী খাব? কী কী চোখ তুলেও তাকাব না?
সত্যি বলতে কী, আমি যে খাবার-দাবারের ব্যাপারে দারুণ ডিসিপ্লিন দেখিয়েছি তা কিন্তু নয়। মারাঠি মেয়ে আমি। আচার খেতাম। টক চাটনি খেতাম। তারপর হরি মির্চি খেতে ভালবাসতাম। হরি মির্চিকে যেন কী বলে বাংলায়?
কাঁচা লঙ্কা। সবুজ লঙ্কা।
কাঁচালঙ্কা ইয়েস। আমি তো সেটাও খেতাম। তেতো খেতাম। তারপর একটা সময় মনে হল বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এত চান্স না নেওয়াই ভাল। তখন তেতো ছেড়ে দিলাম। নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আমি বলব ঈশ্বর খুব দয়ালু যে, উনি আমাকে কৃপা করেই গেছেন। অনেকের যেমন হয়, রেওয়াজ না করলে গাইতেই পারবে না, আমি তেমন কিছু অনুভব করিনি।
অবিশ্বাস্য লাগছে। লতা মঙ্গেশকর খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম মানেননি হতে পারে? তাহলে গাড়ি এত লম্বা চলল কী করে?
চলল ঈশ্বরের দয়ায়। নইলে অনিয়ম কি কম হয়েছে? হেমন্তদার বাড়িতে গেলে উনি দারুণ সুস্বাদু সব খাবার খাওয়াতেন। কিন্তু আমার লোভের মাছ-টাছ সবই থাকত সরষেতে। কখনও কখনও সরষে তেলাপিয়া। আমি ইতস্তত করতাম, খাওয়া ঠিক হবে কি না? আর হেমন্তদা এক ধমক লাগাতেন, লতা খাও খাও।
সলিল চৌধুরীও তো আপনাকে খুব পছন্দ করতেন।
খুব ভালবাসতেন। একটাই সমস্যা ছিল (হাসি)। সলিলদা আমার সঙ্গে শুধু পরিষ্কার বাংলা বলতেন না। উনি চাইতেন আমি যাতে বাংলাতেই উত্তর দিই। আমি আপ্রাণ বোঝাতাম যে, দাদা, আপনি বাংলায় বলুন এই অবধি ঠিক আছে। আমি ভাল বুঝতে পারছি, আপনি কী বলছেন। কিন্তু বাংলায় উত্তর দিতে বলবেন না। ওটা পারব না। কে শোনে কার কথা। সলিলদা অনড়, তুমি বাংলা বলতে থাকো। ও ঠিক এসে যাবে (হাসি)।
আপনাকে ঘিরে তো তখন বাঙালিরা। কিশোর কুমার, মান্না দে।
মান্নাদাও খুব মজা করতেন। মান্নাদার একটা ক্ল্যাসিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল বলে ওঁর প্লে ব্যাকে প্রিপারেশনটা ছিল অন্যরকমের। উনি নোটেশন করে আনতেন। মান্নাদার গোটা ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুতরকম শুদ্ধতাও ছিল। আমার সঙ্গে খুব জমত ওঁর।
কিশোর কুমার?
কিশোরদা! উরিব্বাস। কিশোরদা ছিলেন লাইভ এন্টারটেনমেন্ট। কী হুল্লোড়ে ছিলেন মানুষটা ভাবাই যায় না। সারাক্ষণ হাসাতেন। ওঁর সঙ্গে প্লে ব্যাক করতে যাওয়া মানে একটা এক্সপিরিয়েন্স হত বটে। গান গাইব কী, হাসতে হাসতে পেটের খিল ধরে যেত।
তখন কি প্লে ব্যাকে একইসঙ্গে মেল আর ফিমেল ভয়েস-এর রেকর্ডিং হত? এখন তো শুনি গায়ক আর গায়িকা আলাদা আলাদা রেকর্ডিং করেন।
(একটু চুপ) না, তখন একসঙ্গে হত। আর কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট থাকলে কনসেনট্রেট করাই মুশকিল হত। স্যাড সং-এর আগেও ওঁর জোকস চলত। আমি তখন ওঁকে হুমকি দিতাম (হাসি)। কিশোরদা আমি কিন্তু মিউজিক ডিরেক্টরকে আপনার এগেইনস্টে কমপ্লেন করব। হাসানো এখুনি বন্ধ করুন। মহম্মদ রফিও এরকম ছিলেন…বহু বছর আগে আমি একবার রাজ কাপুরের জন্মদিনে গেছিলাম। আর কোনও ফাংশনে যাইনি।
সেটাই জিজ্ঞেস করছি। ‘না’ করেন কী করে? এত ইনভিটিশন আসে আপনার!
আমি বলেই দিই যে, অত ভিড়ে আমি কমফর্টেবল ফিল করি না। আমাকে ডেকে কী লাভ? আমি স্রেফ এক কোণে গিয়ে মুখ গোঁজ করে বসে থাকব। সেটা আনন্দ অনুষ্ঠানে কাঙ্ক্ষিতও নয়। ওরা তখন বোঝে।
যশ চোপড়ার বাড়িতে তবু আপনি গেছেন। ওঁর ছবি মানে অবধারিত ভাবে পাঞ্জাবি জৌলুস আর লতার গান।
কোনও বড় পার্টিতে যাইনি। প্রাইভেটলি দেখা করতে গেছি। যশজি আমার কাছের মানুষ ছিলেন। দিদি বলে ডাকতেন আমায়। আর ওঁর একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, আমি খুব লাকি। বলতেন লতার অন্তত একটা গান না থাকলে ছবি হিট হবে না।
প্লে ব্যাক সিঙ্গিংয়ে এত সব অবিস্মরণীয় গান আছে আপনার। প্লে ব্যাক ভাল করার রহস্যটা কী? অভিনয়টাও ভাল জানতে হয়?
অবশ্যই। সিচুয়েশনটা জানতে হয় খুব ভাল করে। তারপর গলাকে সেই অনুযায়ী নিয়ে যেতে হয়। আমাকে বহু বছর আগে অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, লতা প্লে ব্যাক গাইতে হলে সব সময় আগে সিচুয়েশন জেনে নেবে। যার জন্য গাইছ সে গরিব না পয়সাওয়ালা? প্রেমে পড়েছে না প্রেমে বিক্ষত? হতাশ, কি উৎফুল্ল? ভাল করে জানবে। মেন্টালি নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে ইম্যাজিন করতে হবে। তোমার ক্যারেক্টার কী? সিচুয়েশন কী? প্লে ব্যাক সিঙ্গিং মানে মারাত্মক রকম অ্যাক্টিং। সেখানে শুধু গাইছ ভাবলে হবে না। আমি অভিনয় করছি সেই বোধটাও থাকতে হবে।
পঁচাত্তর বছর ধরে অন্তত দেড়শো নায়িকা-সহনায়িকা আপনার গানে লিপ দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সেরা লিপ সিঙ্কিং কার?
আমি তিনজনকে বাছব। মীনা কুমারী, নূতন আর মাধুরী।
তাই?
লিপ ভাল দিয়েছে এ রকম অনেকেই আছে। নার্গিস খুব ভাল ছিল। মধুবালা, ওয়াহিদা, রেখা, কাজল, রানি। কিন্তু আমি যে তিনজনের কথা বললাম, এরা প্রত্যেকেই নিজেরা ভাল গাইত বলে অ্যাডভান্টেজ ছিল। নূতন তো নিজে ফিল্মে গান গেয়েছে। মাধুরী ফিল্মে না গাইলেও শো-তে গাইবার মতো তৈরি গলা ওর। তাই মাধুরীর মতো কেউ যখন ‘দিদি তেরা দেওয়ার দিওয়ানা’-তে লিপ দেয়, সেটা অনেক বিশ্বাসযোগ্য হয়।
আর কোনও টিপস?
ওই যে মনটা ফ্রেশ রেখে গাওয়া। ভীষণ জরুরি। মনকে গানের জন্য সম্পূর্ণ তাজা রাখতে হবে। মন যেন পরিষ্কার ধবধবে থাকে। তবেই না ভাল গান হবে। আমি আবার বলছি মন ফ্রেশ না থাকলে গান চেষ্টা করা উচিত নয়। আমি কখনও করিনি। তাহলে সংগীতকে ধোঁকা দেওয়া হবে।
এত বছর থেকে শুধুই গানের জন্য নিজেকে সমর্পিত রাখা তো ভাবাই যায় না।
জানি না। আমার জীবনে এই ঘর আর রেকর্ডিং স্টুডিয়ো। যে মনোভাব নিয়ে জীবনে প্রথম দিন কাজ শুরু করেছিলাম, আজও তা থেকে চলে যাইনি। নো চেঞ্জ। আমি হয়তো ভাগ্যবান। আমার পরিবার। আমার ভাইবোন, এরা সবাই এত সিম্পল যে, জীবনের কোনও মোড়েই বদলায়নি। আজও সংগীতই আমাদের ধ্রুবতারা। অনেকের সামান্য সাফল্যে চলন বদলে যায়। অনিবার্যভাবে তার গানের লাইফস্প্যানও যায় কমে। আমাদের যেগুলো ভাবনাতেও আসেনি।
তবু এত সব ঢেউয়ের মতো ধেয়ে আসা সাফল্যের এক-একটা মুকুট। আপনার তো গর্বে বুক ভরে থাকা উচিত ছিল।
জানি না। নিজেকে কখনও বড় সিঙ্গার ভাবিনি। বরং জেনেছি মানুষের সঙ্গে নম্রতা নিয়ে কথা বলা উচিত। গরিবদের দয়া করা উচিত। জীবনে যা কিছু ঘটেছে সব মা-বাবার আশীর্বাদ আর ঈশ্বরের দয়া হিসেবেই নিয়েছি। হয়তো সেজন্যই গর্ব বোধ হয়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.