শম্পালী মৌলিক: লন্ডনে গিয়েছিলেন ‘বাজি’র শুটিং করতে। বুধবার সকালে কলকাতায় ফেরেন সাংসদ-অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। সঙ্গে প্রযোজক-অভিনেতা জিৎ-ও ছিলেন। লকডাউন হয়ে যাওয়ার আগেই, তাঁরা তড়িঘড়ি ফিরে আসেন শুটিং শেষ না করেই। ইংল্যান্ডে Covid-19-এর মারাত্মক প্রভাব সকলেই জানি আমরা। কাজেই সে দেশে যাওয়া এবং ফেরা দুই-ই এখন যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল। দুবাই হয়ে মিমি ফেরেন কলকাতায়। খুবই টেনশনে ছিলেন যে, ঠিকভাবে বাড়িতে ফিরতে পারেন কিনা। বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন। সন্ধে গড়ালে হোয়াটসঅ্যাপের উত্তর আসে তাঁর কাছ থেকে। তখনই বলেন হোম আইসোলেশনে রয়েছেন। কিন্তু মোবাইলে কথা বলতে কোনও অসুবিধা নেই। তিনি সুস্থ রয়েছেন। তবে হাড়হিম করা অভিজ্ঞতা যাকে বলে। মিমির ইন্টারভিউ আর নেওয়া হয়নি। দেশে ফেরার রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাটুকু তিনি বলে গেলেন। শুনলাম আর নোট নিলাম। তাঁকে একবারও থামাতে ইচ্ছে করেনি। কী বললেন মিমি চক্রবর্তী?
মিমির কথায়, “কাজের ক্ষেত্রে আমার ডিকশনারিতে ভয় শব্দটা সেভাবে নেই। আমার কাছে কমিটমেন্ট সকলের আগে। তার জন্য আমি সবকিছু দিতে পারি। কিন্তু এবার, বিষয়টা সত্যি কঠিন ছিল। ১৩ মার্চ আমার ফ্লাইট ছিল সকালবেলায়। আমাকে রাত দুটো অবধি অনেকে বারণ করেছিল যে, যেও না। কিন্তু প্রোডাকশন হাউস, আমার হিরো জিৎ ওখানে ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছিল। তো আমাকে যেতেই হত। আমি না গেলে তো আরও অনেক টাকা লস হয়ে যেত। যাওয়ার সময় দুবাইয়ে আমার লে-ওভার ছিল না খুব একটা। কানেক্টিং ফ্লাইট ছিল। মাস্ক পরে ছিলাম। ডিসপোজেবল গ্লাভসও পরেছিলাম, যাতে ফেলে দিতে পারি। হ্যান্ডলাগেজ স্ক্যানিং হল। আমি তো বাতিকগ্রস্তর মতো এক নাগাড়ে হাত ধুয়ে গেছি। যারা আমাকে চেনেন, যেমন আপনি জানেন আমার ‘ওসিডি’ আছে। এখন তো আরওই। আমার হ্যান্ড ব্যাগভর্তি স্যানিটাইজার, স্প্রে, টয়লেট সিট স্যানিটাইজার সব ছিল এই জার্নিতে। ফ্লাইটে আমার সিটটা স্প্রে করে বসেছিলাম। যে কম্বল গায়ে দিয়েছিলাম, সেটায় স্প্রে করেছিলাম। যে এলসিডি টিভিটা দেখছিলাম সেটায় স্প্রে করেছিলাম। এমনকী ডোর হ্যান্ডেল পর্যন্ত ফ্লাইটে নিজে স্প্রে করেছিলাম। বাথরুমে তো বটেই। এমনকী ডোর নব পর্যন্ত, কিছুতেই স্প্রে করতে বাকি রাখিনি নিজের মুখটা ছাড়া! এইভাবে গেলাম লন্ডন”, একনাগাড়ে বলে গেলেন মিমি।
“ফাইনালি হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম না ঘুমিয়ে। কেউ যদি হেঁচে দেয় গায়ে বা ঘাড়ে পড়ে কেশে যায় এই ভেবে ভেবে। কিন্তু লন্ডন গিয়ে দেখলাম ওখানটা পুরো স্বাভাবিক। এয়ারপোর্ট মানে হিথরো পুরো ফাঁকা ছিল। খুব কম লোক ছিল। ফেরার সময়েও তাই দেখলাম। আর ভারতীয়রাই শুধু মাস্ক পরে। আর হ্যাঁ, কোরিয়ানরাও পরেছিল। বৃটিশদের কেউ দেখলাম মাস্ক পরেনি। প্রথমদিন ওখানে গিয়ে আমার শুট ছিল না। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গেলাম যে, ওখানে অবস্থাটা কী দেখে আসি। দেয়ার ওয়াজ নট আ সিঙ্গল পার্সন ওয়্যারিং মাস্ক। মনেই হচ্ছিল না করোনার প্রভাবে সারা বিশ্ব এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সবাই শপিং, খাওয়া দাওয়া নরম্যালি করছিল। ওখানে হাইজিন মেনটেন, ব্যাপারটা এমনিতেই জোরালো। কিন্তু পরে শুনলাম ড্রাইভার বলল আর টিভিতে দেখলাম লকডাউন হবে। তখন আমি বুঝলাম লকডাউন হলে তো আমাদেরও চলে যেতে হবে। ইট ওয়াজ ফোরটিনথ!, মন্তব্য মিমির।
পাশাপাশি মিমি এও জানালেন যে, “আমার দ্বিতীয় দিন শুট। ষোলোতেও শুট করলাম। সতেরোতেও শুট করব যখন কো-অর্ডিনেটর বলল, এটা এসেছে হেল্থ অ্যান্ড হোম মিনিস্ট্রি থেকে। কালকের মধ্যেই পাততাড়ি গোটাতে হবে। হয়তো বা আজ রাতেই! তখনও শুটিং চলছে। পুরো টিম তখনও জানত না। প্যাক আপের পর সবাইকে বলা হল যে যেতে হবে। রাতারাতি টিকিট বুক করা হল। একটা ফ্লাইটে সবার হয়নি। দুটো ফ্লাইটে আমাদের আসতে হল। আমার দুবাইয়ে লেওভার ছিল পাঁচ ঘণ্টা, আমি কোথাও যাইনি। ফ্লাইট থেকে নেমে লাউঞ্জে ঢুকে গিয়েছিলাম। স্প্রে করে একটা জায়গাতেই বসেছিলাম। কিচ্ছু খাইনি পুরো সময়টা, গরম চা আর কফি ছাড়া। মানে গরম ছাড়া কিচ্ছু ছুঁইনি বলতে পারেন। আর গরম ঠান্ডা জল মিশিয়ে খেয়েছিলাম, যেটা সঙ্গে ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল কখন কলকাতায় ঢুকব।”
“লন্ডনে নানা জায়গায় শুটিং ছিল। একটা হিথরো থেকে এক ঘণ্টা দূরে। ইট ওয়াজ আ বিউটিফুল ভিলেজ। আরেকদিন একদম শহরে শুটিং ছিল। আমার খারাপ লাগছে যে গল্পটা লন্ডন বেসড কিন্তু আমরা পুরো শুটিং ওখানে করতে পারলাম না। আমাদের ইদ রিলিজ ছিল। কিন্তু মানুষের প্রাণের চেয়ে বেশি দাম তো কিছুরই হতে পারে না। জীবন থাকলে পরে আবার সব হবে। ফেরার সময় জিৎ আর আমি এক ফ্লাইটেই ছিলাম। আমার পাশে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। তিনি ছেলের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন। হঠাৎ বললেন, ‘আমি তো তোমার যাদবপুর থেকেই।’ একটা হেলথ ফর্ম ফিলআপ করতে হচ্ছিল সবাইকে। আমি নিজেরটা করলাম, সঙ্গে ওঁরটাও। আমার মা সঙ্গে থাকলেও তো এটা করতাম। উনি খুব খুশি হলেন। বললেন, লন্ডনে ছেলের বাড়িতে মে মাস অবধি থাকার কথা ছিল। কিন্তু আর হল না। সকলেই প্যারানয়েড হয়ে আছে আসলে। কলকাতায় ল্যান্ড করে ভয় হল। পুরো এয়ারপোর্ট খাঁ খাঁ করছে। হেলথ লাইনের জায়গায় ভিড়। এখনও বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ওখানে দাঁড়িয়ে চেকিং হচ্ছিল। ‘টারমিনেটর’ দেখেছেন তো? ওই রেড গ্রিন আলো জম্বিদের মতো চেহারা- সব দৃশ্যগুলো মনে পড়ছিল। দু’সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হচ্ছিল কী হচ্ছে! কলকাতার এই সাবধানতার কারণ একদম সঠিক। ওই দশ সেকেন্ড আমি স্তব্ধ হয়েছিলাম। আমার স্ক্যানিং হল। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ওরা পেপার দিল। পরীক্ষায় অসুস্থতার কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি। ইমিগ্রেশন থেকে ছাড়ল। বাড়ি যেতে পারব! আমার মনে হল, ওহ্! মাই গড। তার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম লন্ডনেই যে, আন্ডার আইসোলেশন থাকব। কারণ আমি কোনওভাবেই চাই না আমার থেকে আর কারও হোক। তাই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার সিদ্ধান্ত। এইটুকু সামাজিক সচেতনতা থাকা জরুরি। নয়তো করোনা ছড়াবে। ঈশ্বরের দয়ায় যদি চার-পাঁচদিনে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ না দেখা যায় ভাল। যদি দেখা যায়, আমি কোয়ারান্টাইন যাব। পাপাকেও বলেছি, কোনও লোকজনের সংস্পর্শে না আসতে। পাপা অন্য ঘরে, আমি অন্য ঘরে এখন। অফিসও বন্ধ করেছি। এটাই বলব সবাই সচেতন থাকুন। অনেকেই বলছে মিমি মাস্ক পরেনি কেন? আমি বলব কারণ আমি তো অসুস্থ নই। আমার চেয়ে বেশি পরা দরকার যারা অসুস্থ তাদের এবং যারা রাস্তায় ট্রাভেল করছে বা হাসপাতালে কাজ করছে তাদের। চোদ্দোদিন পরেও আমি যদি সুস্থ থাকি, আমি হাসপাতালের কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে চাই, যদি আমাকে প্রয়োজন হয়। যতটা হেল্প করতে পারব, করতে চাই। সবাই মিলে একজোট হলেই আমরা এই মহামারী প্রতিরোধ করতে পারব। যেন একটা প্রাণও না যায়, এটাই ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.