প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ছোটবেলায় আর পাঁচজনের মতো আমিও কত ১৫ আগস্ট পিকনিক করে কাটিয়েছি। বেশ একটা উৎসবের আমেজ থাকত বাড়িতে। তখনও দিনটার মানে বুঝি না ভাল করে। একটু বড় হওয়ার পর ওই দিনটায় নতুন নতুন সিনেমা দেখেছি। সেসব আজ সুদূর অতীত।
একজন সুপারস্টারের জীবনে যত দিন যায় স্বাধীনতা কমে আসে। নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচার পরিসর কমে যায় ক্রমশ। করোনার সংকটকাল এসে সেই স্বাধীনতার পরিধি আরও ছোট করেছে। কতদিন ফ্যানেদের মুখোমুখি হইনি। লাইভে আসাটা ভারচুয়াল রিয়েলিটি মাত্র। ‘বুম্বাদা একটা সেলফি’– সেই সাউথ আফ্রিকা থেকে ফেরার পর আর শুনিনি! তারপর তো হোম আইসোলেশন ইত্যাদি। কেটে গিয়েছে প্রায় চার মাস। ছবি তোলার জন্য সামনে থেকে ফোটোগ্রাফারদের ওই সমস্বরে ‘বুম্বাদা এদিকে, এদিকে’ ডাকটা মিস করছি। ভীষণ মিস করছি শুটিং ফ্লোরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো।
এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভাল হয়েছে, অনেকটা সময় হাতে পেয়েছি। আমার ছেলে মিশুক এখন বাড়িতে। টানা অনেকগুলো দিন মিশুকের সঙ্গে কাটালাম। আমি অত ভাল বাবা নই। এবারে ফাঁকা সময়টা পেয়ে বুঝলাম বাড়িতে নিজের ইচ্ছেমতো সময় কাটানোও কতটা জরুরি। আমরা অনেক তো দৌড়েছি, একটু থামলাম ক’টাদিন। মিশুকের সঙ্গে সেরা সময় অতিক্রম করছি। রোজই ওর থেকে কিছু না কিছু শিখছি। করোনা যেমন আমাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার কেড়েছে, গৃহবন্দি করেছে, তেমন কিছু ভাল জিনিসও ঘটেছে। আমরা ঘরমুখী হয়েছি।
তবে মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছাড়া কি বাঁচা যায়? একজন শিল্পী, সে যদি মানুষ না দেখে, জীবনের স্বাভাবিক চলন থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে কি সে ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে যাবে না? বাড়িতে এখন চেনা মানুষজনকে ডাকতেও ভয় করছে। একটা ভাইরাস এসে অবিশ্বাস আর সন্দেহের বীজ রোপণ করে দিল আমাদের মধ্যে। স্বাভাবিক জীবনের স্বাধীনতা কেড়ে নিল। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে গলা জড়িয়ে ধরে কি বলতে পারব, ‘কী রে ভাই কেমন আছিস? সব ভাল তো?’
এখন দিনের অনেকটা সময় ‘উৎসব’-এর লনে বসে থাকি। অনেকটা সবুজ। আকাশ যেন আগের চেয়ে নীল দেখায়। আমার বিশ্বাস, খুব তাড়াতাড়ি আমরা সবাই শুটিংয়ে ফিরব। টেলিভিশনের ছেলেমেয়েরা কাজ শুরু করেছে আগেই, আনলক শুরু হতেই। সিনেমার কাজও একটা-দুটো হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে আক্রান্তও হচ্ছেন কেউ কেউ, সাবধানতা অবলম্বন করেও। চিন্তাটা থেকেই যায় তাই। কিন্তু যাঁরা রোজের ভিত্তিতে টাকা পান, কাজ না করলে চলবে কী করে তাঁদের? প্রশ্নটা এসে দাঁড়ায়, জীবন আগে, না জীবিকা? আমি আশাবাদী, আমরা পারব। একটু একটু করে কাজও এগোতে হবে। সেইদিন দূরে নেই, যখন আবার সাইকেডেলিক আলো আর মাচার ভিড় ফের দেখতে পাব আমরা। এবারে বাড়ি বসেই স্বাধীনতা দিবস পালন করব আমরা। চলাফেরার স্বাধীনতা যতই বাধা পাক, মনটা তো কেউ আটকে রাখতে পারে না। মনে মনে আমি দেখতে পাচ্ছি– আগের মতো লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন, গমগম করছে শুটিং ফ্লোর। সুভাষ আমাকে আয়নাটা এগিয়ে দিচ্ছে। মোহর শিডিউল চেক করছে। নির্ভয়ে আবার নায়িকার হাত ধরতে পারব তো? আশা রাখি, পারব।
সামাজিক দূরত্ব মেনটেন করতে গিয়ে আমরা যেন পরস্পরের থেকে দূরে না চলে যাই। এই আটকে পড়া সাময়িক, আমি মনে করি। আমাকে শেষ করতে হবে ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর ডাবিং। শুরু করতে হবে নতুন কাজ। ঘরে বসে সিনেমা দেখা এখনকার মতো চলতে পারে। তবে আশা করি, পুজোর আগে সিনেমা হল খোলার ব্যবস্থা হবে।
অতিমারীর এমন দিনে হেরে যাওয়ার আগে ভয়ের কাছে হারব কেন আমরা? আমি নিশ্চিত, ভালবাসার স্বাধীনতা অতি-দুর্যোগও ছিনিয়ে নিতে পারে না। সেই ভালবাসার জোরেই আমরা ঘুরে দাঁড়াব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.