স্বপন মুখোপাধ্যায়: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিদিকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কতকিছু ভেবে রেখেছিলাম। এই বলব, সেই বলব। কিছুই বলা হল না। সব শেষ হয়ে গেল। ‘স্বপন একবার বাড়ি আসবে’ –বলে আর কেউ ফোন করবেন না।
আসলে অপারেশনের পর দিদির শরীর অনেকটাই ভাল হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম। আমিও ভেবেছিলাম, দিদি ফিরে এলে আবার গানের আড্ডা বসবে লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে। দিদি হারমোনিয়াম বাজাবেন। আমি গান গাইব। মাস দু’য়েক আগেও এভাবেই আমাদের আড্ডা হত। আমার সেই হারমোনিয়ামে সঙ্গত করার মানুষটা চিরতরে হারিয়ে গেল।
আজ কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনে। দিদির সঙ্গে ৩৫ বছরের সম্পর্ক। আমি থাকতাম ঢাকুরিয়ার ব্যানার্জিপাড়ায়। দিদি মুখার্জিপাড়ায়। পাড়াতুতো দিদি-ভাই থেকে একটা সময় দিদির ডানহাত হয়ে উঠলাম। অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রেকর্ডিং, কোনও অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া থেকে গ্যাস বুকিং, সবেতেই ছিলাম দিদির প্রধান ভরসা। এইবার যে হসপিটালে ভর্তি হলেন, তখনও আমাকেই ফোন করে নিজের অসুস্থতার কথা বলেছিলেন। আমিই ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গে কথা বলি। দিদিকে পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় অ্যাপোলোতে স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আমার সঙ্গে আর কথা হয়নি, দেখাও হয়নি। একটা বিষয় না বলে পারছি না। দিদি কিন্তু পিজিতে ভর্তির আগে আমায় স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, “ডাক্তাররা বলছে আমার ফিমার বোন ভেঙেছে। কিন্তু আমি কোনও যন্ত্রণা অনুভব করছি না।” আসলে প্রবল সহ্যশক্তি ছিল দিদির। কোনওদিন কারও বিরুদ্ধে কোনও নালিশ করেননি। নিজের মতো থাকতেন। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। রেওয়াজ, গান, অনুষ্ঠান, কাছের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা। ব্যস, এইটুকুই।
করোনার প্রবল দাপাদাপির মধ্যেও সন্ধ্যাদির বাড়িতে নিয়মিত গানের আড্ডা বসেছে। ইদানীং বাড়ির বাইরে তেমন বেরোতেন না। টেলিফোনেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেও টেলিফোনে নিয়মিত কথা হত সন্ধ্যাদির। দু’জনের খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। প্রিয় বন্ধুর ন’দিন পর সন্ধ্যাদিও চলে গেলেন মা সরস্বতীর কাছে।
কত শিল্পীর কত গল্প শুনেছি দিদির কাছে। লতা, হেমন্ত, মান্না, শ্যামল মিত্র মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়…। কত কথা মনে পড়ছে। একবার কাকদ্বীপে প্রোগ্রাম করতে গিয়েছেন দিদি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও আছেন। ভিড়ে ভিড়াক্কার অনুষ্ঠান। হেমন্তদা আমায় কাছে ডেকে বললেন, “জানো স্বপন, এই ভিড় কিন্তু আমাদের জন্যে নয়, সন্ধ্যার জন্যে।” আসলে সন্ধ্যাদি খোলা আকাশের নিচে পাবলিক ফাংশন খুব কম করতেন। তাই ওঁর লাইভ প্রোগ্রামের এত চাহিদা ছিল। শেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন মান্না দে’র সঙ্গে সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে। দুজনেই সেদিন অনেকক্ষণ রিহার্সাল করেছিলেন। সব স্মৃতি হয়ে গেল।
একবার শ্যামল মিত্রকে নিয়ে দিদির বাড়ি যেতে হয়েছিল। শ্যামলদা আগে থেকে বলতে বারণ করেছিলেন। সারপ্রাইজ দেবেন বলে। আমি কলিং বেল বাজিয়েছিলেন। আর দরজা খুলে দিদি দেখেছিলেন গোলাপের তোড়া হাতে ধরা শ্যামল মিত্রকে। সেদিন দিদির জন্মদিন ছিল।
শেষবেলায় খামোখা পদ্মশ্রী পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হল। দিদি কিন্তু বরাবর প্রচারের বাইরে থাকতেই পছন্দ করতেন। বিতর্ক থেকেও থাকতেন শত যোজন দূরে। কারও সঙ্গে কখনও মনোমালিন্য হয়েছে বলেও শুনিনি। শ্রীকান্ত আচার্যর মতো এই প্রজন্মের শিল্পীরাও তাই দিদিকে খুব ভালবাসতেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দিদির দারুণ সম্পর্ক ছিল। এর আগে মাত্র বার দুয়েক দিদিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী দুবারই হাসপাতালে গিয়েছিলেন দেখা করতে। মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে কতবার কত অনুষ্ঠানে সন্ধ্যাদি গিয়েছেন। সঙ্গী হয়েছি আমি। আর দিদিকে নিয়ে কোথাও যেতে হবে না। আর লেক গার্ডেন্সের বাড়ি থেকে ফোন আসবে না, “স্বপন আমার গ্যাসটা বুক করে দিতে হবে। শেষ হয়ে গিয়েছে।” জলজ্যান্ত মানুষটাই তো শেষ হয়ে গেলেন। সুরের আকাশে সন্ধ্যাতারা হয়ে গেলেন আমার সন্ধ্যাদি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.