শম্পালী মৌলিক ও বিশাখা পাল: জর্জ ফ্লয়েড। নামটা এখন কান্নাভেজা স্মৃতির পাশাপাশি উত্তাল প্রতিবাদ ঘূর্ণির আর এক নাম। প্রায় প্রায় ন’দিন কেটে গিয়েছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হাঁটুর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটির মৃত্যুর। আমেরিকার পথে পথে বিক্ষোভের ঢল। মিনিয়াপোলিস তোলপাড়।
বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে উঠেছেন সমাজের সব স্তরের মানুষ। বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে মানুষ। ফ্লয়েডের মৃত্যু নিয়ে ক্রীড়াজগতের ব্যক্তিত্বরা মুখ খুলেছেন। বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত তারকারাও সরব হয়েছেন। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের বক্তব্য রেখেছেন অনেকেই। হলিউডের নক্ষত্রদের সঙ্গে ভারতের বলিউড থেকেও প্রথম সরব হয়েছেন করিনা কাপুর। তিনি ছাড়াও করণ জোহর, ভিকি কৌশল, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রাধিকা আপ্টে, সারা আলি খান প্রমুখ তারকারা প্রতিবাদ প্রকাশ করতে পিছপা হননি। পিছিয়ে নেই আমাদের টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিও। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সুস্পষ্টভাবে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত সিঙ্গাপুর থেকে ফোনে জানালেন, ‘জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে আমি ভীষণ ডিসটার্বড। আমেরিকায় অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু এই ভিডিওতে যা দেখেছি, এইভাবে অত্যাচারিত হয়ে মানুষটি চলে গেলেন! কী বলব? এই অবস্থাতেও এই রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তাও আমেরিকায়! এটা অবিশ্বাস্য। একটার পর একটা চলছে আমাদের জীবনে। আমেরিকায় তো করোনা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। এই ঘটনার পর প্রায় সমস্ত জায়গায় আগুন জ্বলছে, অরাজকতা-অস্থিরতা আমেরিকায়। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। প্রতিবাদের পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এতই কষ্টে রয়েছে বা পিঠ ঠেকে গিয়েছে যে ওদের কাছে এর কোনও বিকল্প নেই মানুষকে বা প্রশাসনকে জানানোর যে কতটা অত্যাচারিত হচ্ছে তারা। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুটা শকিং। জানি না কীভাবে এটার সঙ্গে রিজনিং করব বা ব্যাখ্যা করব। অত্যন্ত নিন্দনীয়। এই অবস্থায় আমেরিকাবাসীও ভীত সন্ত্রস্ত। চাই এর সুরাহা হোক। জর্জ ফ্লয়েডে সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা যেন পৃথিবীর কোনও জর্জের সঙ্গে না ঘটে, সেই বোধ যেন আসে।’
আবির চট্টোপাধ্যায়কে মোবাইলে ধরতে তিনি জানালেন, ‘আমাদের এখানে আমি ইন্ডাস্ট্রির অনেককেই লিখতে দেখেছি এই বিষয়ে। সেটা খুবই প্রয়োজন। কারণ আমরা COVID-19, সুপার সাইক্লোনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, কারও মনে হতেই পারে সেখানে, ও আমেরিকায় কী হল। কিন্তু COVID-19 প্রমাণ করে দিয়েছে পৃথিবীটা কত ছোট। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম আমাদের কিছু হবে না। এখন অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। সবাই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। ওখানে ঘটনাটা হয়েছে ত্বকের রং নিয়ে। এটা আদতে অসহিষ্ণুতা। এবং অন্য মানুষকে মানুষ বলে গণ্য না করা। সেটা কোথাও চামড়ার রং, কোথাও জাত, শ্রেণি বিভেদ বা ধর্ম। আমরা প্রতিদিন নানা উপায় বার করছি মানুষকে কী করে ঘেন্না করা যায়। এই ঘৃণা করে আমরা ভাবছি নিজেরটুকু নিয়ে থাকব। ভাল থাকব। সেটাই সবচেয়ে বড় ভুল। আমরা কিছুতেই ভাল থাকতে পারি না। এটা মনুষ্যত্বের পরিচয় নয় যে রং-জাত-ধর্ম এগুলো নিয়ে অন্য মানুষকে হেয় করা হবে। আজ থেকে কত বছর আগে মার্টিন লুথার বলে গিয়েছিলেন ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। কিন্তু আমরা যেন সেটাকে দুঃস্বপ্নে নিয়ে যাচ্ছি। এত প্রযুক্তিগত উন্নতি হচ্ছে, অথচ আমরা এগনোর বদলে যেন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। তারপর যখন বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হলেন, আমরা দেখলাম ঐতিহাসিক ঘটনা। একজন ব্ল্যাক প্রেসিডেন্ট পাওয়া গেল। কী বদল হল? তারপর বর্তমান রাষ্ট্রনায়ক আসার পর তো আরও অবনতি। কিছু মানুষ সারা জীবন পরিশ্রম করবেন, সংগ্রাম করবেন সাম্য আনার জন্য। আমরা সেটা মূর্খের মতো আবর্জনায় ফেলে যাব? এটা শুধু আমেরিকার সমস্যা নয়, গোটা ভারতের তথা বিশ্বের সমস্যা। আমরা ছোটবেলায় পড়তাম বিভিন্ন কবি, লেখকের লেখায় যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব এক। যত বড় হচ্ছি, আমাদের আবার নতুন করে বোঝানো হচ্ছে আসলে আমরা এক নই। আসলে আমরা এক হয়ে গেলে বোধহয় যাঁরা শাসন করছেন, সে যে কোনও দল হোক, যে কোনও দেশে তাদের সুবিধা হয়। তাই আমাদের আলাদা করার চেষ্টা করা হয় সারাক্ষণ। আমরা বোকার মতো সেই ফাঁদে পা দিই। যেটা ভাল, এই করোনা আক্রান্ত সময়ে আমারিকার মানুষ প্রতিবাদ করছে। আবার বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছি। প্রতিবাদটা তো হচ্ছে অন্তত। কিছু মানুষ ঠিকঠাকভাবে ভাবছে। এই যে অন্য মানুষকে গায়ের রং বা জাতের ভিত্তিতে সম্মান না দেওয়া এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় ভাইরাস।’
অন্যদিকে অভিনেত্রী পার্নো মিত্র বলেছেন, ‘এভরি লাইফ ম্যাটারস টু মি। প্রত্যেকটা জীবনই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকী এই যে হাতিটার মৃত্যু হল এটাও তো ভাবা যায় না। ভীষণ দুঃখজনক প্রতিটা মৃত্যু। ২০২০তে দাঁড়িয়ে আমরা সাদাকালো নিয়ে যুদ্ধ করছি। এটাই তো খুব খারাপ। দুঃখের বিষয় এখনও মানুষকে অধিকারের জন্য লড়তে হচ্ছে। মানুষকে বলতে হচ্ছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। এত বছরেও কিছু পালটায়নি। এই আন্দোলন, ক্ষোভ তো আজকের নয়। চলছেই। পিরিয়ড ফিল্ম পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। এখনও যে মানুষকে অধিকার নিয়ে লড়তে হচ্ছে, এটাই তো ভাবা যায় না। আমার মনে হয় হতাশা আর ঘৃণা থেকেই এটা আসে। মানুষ বড্ড অমানবিক হয়ে যাচ্ছে।’ ভারাক্রান্ত শোনায় পার্নোর কণ্ঠ। তবুও মানুষ আশা রাখে অন্ধকার সময় কেটে যাবে একদিন। দেখা দেবে বৈষম্যহীন নতুন সকাল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.