কিশোর ঘোষ: ডিজনি হটস্টারের অ্যাকশন থ্রিলার ওয়েব সিরিজ ‘স্পেশ্যাল অপসে’র ( Special OPS) সঙ্গে সত্যজিতের (Satyajit Roy) ফেলুদার কাহিনির এলেবেলে মিল আছে। ‘এলেবেলে’ এই জন্যে যেহেতু ফেলুদার সঙ্গে স্পেশ্যাল অপসের সরাসরি মিল নেই, আবার আছেও। দু’টো মিলের কথা তোলাই যায়। যেমন, ‘র’-এর এজেন্ট হয়েও, প্রয়োজনে গুলিগোলা চালালেও নীরজ পাণ্ডের (Neeraj Pandey) জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রধানত মগজাস্ত্রে শান দিয়েই শত্রকে হার মানায়। আরও এক মিল- স্পেশ্যাল অপস দেখলে বিশ্ব ‘ভ্রমণ’ হয়ে যায়। যেহেতু সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আইএসআই তথা ভারত বিরোধী অন্য গুপ্তচরেরা। তাদের কীভাবে হিম্মত সিং ওরফে কে কে মেনন শায়েস্তা করেন, তা আমরা এই সিরিজের প্রথম পর্বে দেখেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি। সিরিজের নতুন মরশুমটি দেখে ততখানি মুগ্ধ হওয়া গেল না।
হিম্মত সিংহের সঙ্গে দর্শকদের আগেই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। পরিচালক নীরজ পাণ্ডে বরাবরই থ্রিলার ছবি বানাতে পছন্দ করেন। কে কে মেনন অভিনীত এই ওয়েব সিরিজও তার বাইরে নয়। কীভাবে ‘র’-এর এজেন্ট হয়ে উঠলেন হিম্মত? সিরিজে নতুন সিজনে সেই গল্প বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নীরজ। সেই কারণেই নতুন মরশুমের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পেশ্যাল অপস ১.৫ – দ্য হিম্মত স্টোরি’। নতুন পর্বের টিজার বাজারে আসার পর থেকে অপেক্ষার পারদ চড়ছিল, ইউটিউবে ট্রেলার মুক্তির পর চরমে উঠেছিল তা। কিন্তু অপেক্ষাই সার হল। একাধিক কারণে প্রথম পর্বের দুধের স্বাদ এই পর্বের ঘোলে এসে ঠেকল!
যদিও ট্রেলার দেখে চমকে ছিল দর্শক। কে কে মেননের প্রস্থেটিক মেকআপে কৌতূহল বেড়েছিল। এমনিতে নীরজ পাণ্ডে এবং পরিচালক শিবম নায়ার (Shivam Nair) নতুন এই পর্বকেও জমিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করেননি। এবারের গল্পও আগেরবারের মতোই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। সমস্যা হল আগের পর্বেও টানটান থ্রিলারের আড়ালে বিনোদনের গ্ল্যামার থাকলেও এবারের মতো উচ্চকিত ছিল না।
যুবক হিম্মত আর প্রাপ্ত বয়স্ক হিম্মতের মধ্য পার্থক্য কী? উত্তর হল প্রস্থেটিক মেকআপ। নচেত জন্মেই চ্যাম্পিয়ন সে ! সিনিয়ার অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তায়, বাদানুবাদে হিম্মতের আত্মবিশ্বাস, শত্রুকে কাবু করতে তার চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, নেতৃত্বের গুণ, সবটাই বড় বয়েসের অভিজ্ঞ হিম্মতের মতো! তবে প্রস্থেটিক মেকআপ দেখাতে গিয়ে বারবার হিম্মতের মুখের উপর ফেলা হয়েছে ক্যামেরা। পরিচালক ভীষণভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এই হিম্মতের বয়স কম। এগুলো তাঁর প্রথম দিককার কাজকম্ম। তবে অনিতার সঙ্গে যুবক হিম্মতের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা ও আচমকা ভেঙে যাওয়ার অংশে চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে যত্ন নিয়ে। তবে কিনা নীরজের থেকে এটুকু আশা করাই যায়।
গতবারের মতোই এবারও দুই সদস্যের তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে গল্প বলে সিরিজ। তবে এবারের তদন্ত হিম্মতের বিরুদ্ধে নয়। বরং তাঁর কর্মজীবনের বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য। চিত্রনাট্য অনুযায়ী এই তদন্তের উপর ভিত্তি করেই অবসর পরবর্তী সুযোগসুবিধা পাবেন হিম্মত সিং। তদন্ত কমিশনকে হিম্মতের কর্মজীবনের শুরুর দিকের গল্প বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ দিল্লি পুলিশের অফিসার বিনয় পাঠক (Binay Pathak) অভিনীত চরিত্র আব্বাস শেখ। এরপর থেকেই আমারা প্রস্থেটিক মেকআপ নেওয়া কে কে মেননকে দেখি। এইসঙ্গে পাই আফতাব শিবদাসানি (Aftab Shivdasani) অভিনীত হিম্মতের কলেজের বন্ধু বিজয় চরিত্রটিকে। দু’জনের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘র’-এর একটি মিশন। মূল কারণ বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত থাকা ভারতীয় গুপ্তচর এজেন্সির অধিকারিকদের রহস্যমৃত্যু। এই রহস্য উন্মোচনে শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড, সার্বিয়া, ইউক্রেনের মতো বিভিন্ন দেশ ছড়ায় গল্প। ক্রমশ প্রকাশ্যে আসে ‘ভিলেন’ আসলে প্রাক্তন ‘র’ এজেন্ট মনিন্দর। যাঁর সঙ্গে একসময় বাংলাদেশে একটি মিশনে হিম্মত নিজেও ছিলেন।
এরপর কী হল? কেন মনিন্দর বিগড়ে গেল, তা বলা ঠিক হবে না। তবে এটুকু বলা যায়, অ্যাকশনে ভরপুর মিশন দেখানোর ফাঁকেই ব্যক্তি হিম্মতের কাহিনি বোনার চেষ্টা করেছেন চিত্রনাট্যকার নীরজ ও পরিচালক শিবম। কিন্তু তা হয়ে উঠেছে বেশ চড়া দাগের বিনোদন। ফলে বহু দৃশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে সার্বিয়ার অংশটি। যেখানে একটি মিশনে গিয়েছিলেন মনিন্দর। কিন্তু শত্রপক্ষ তাঁকে কবজা করে ফেলে। একটানা ছ’দিন তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলে। উলটো করে ঝুলিয়ে মারধর করা হয় মনিন্দরকে। নেতানো শরীরের আধমরা মনিন্দর ষষ্ঠ দিনে আচমকাই ‘দাবাং’ সলমন খান হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজের বাঁধন খুলে রজনীকান্ত স্টাইলে হাঁটতে হাঁটতে একের পর এক শত্রুকে খতম করতে করতে পর্দা ছাড়েন! অতখানি দুর্বল চিত্রনাট্য নীরজ পাণ্ডের থেকে আশা করে না দর্শক।
আসলে গতবারের চিত্রনাট্য আর এবারের চিত্রনাট্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য ঘটে গিয়েছে। গতবারের চিত্রনাট্যে অপ্রত্যাশিত চমক ছিল। এবারে চমকই চিত্রনাট্য! যা ডিঙিয়ে অভিনয় স্বাক্ষর রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কে কে মেনন। যার পাশে আফতাবের অভিনয়কে অতি দুর্বল লাগে। তবে তাঁর নতুন লুক হয়তো পছন্দ হবে দর্শকের। অন্যরা যথাযথ অভিনয় করেছেন। থ্রিলারের মেজাজ বজায় রেখেছে ভাল আবহসঙ্গীত। এইসঙ্গে ঘাতপ্রতিঘাতে ভরা জটিল কাহিনি বিন্যাস ভাল সম্পাদনার গুণে স্পষ্ট হয়েছে।
তবে নীরজের ‘স্পেশ্যাল অপস’ সিরিজের সঙ্গে সত্যজিতের ফেলুদার কাহিনির যে এলেবেলে মিলের কথা শুরুতেই বলা হয়েছিল, যার অন্যতম কারণ হিম্মতের ঝকঝকে মগজাস্ত্র। এবার তা পাওয়া গেল কই? সিরিজের প্রথম পর্বের মতোই ১.৫ পর্বেও হিম্মত সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরেন বটে, তবে তাঁর হাবভাব যেন সিংহমের অজয় দেবগনের মতো অতিকায়। ফলে এবারের অপসকে স্পেশ্যাল লাগল না। বরং তা মশলায় ভরপুর রঙিন ‘এন্টারটেইনমেন্ট’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.