নির্মল ধর: সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জয়ললিতার (Jayalalithaa) স্থান আর কতটুকু! বরং তাঁর দীর্ঘ রাজত্ব তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে। পরিচালক বিজয় ‘থালাইভি’ (Thalaivii Review) ছবিতে জয়ার উত্থানের কাহিনিটুকুই শুধু ধরেছেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ফিল্মি নায়িকা হওয়া এবং তারপর তামিল সুপারস্টার এম জি রামচন্দ্রণের প্রথমে প্রেমিকা এবং পরে তাঁর রাজনৈতিক মন্ত্রশিষ্যা হয়ে ওঠার গল্প নিয়েই চিত্রনাট্য লেখা।
সিনেমার ক্ষেত্রে সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের চিন্তাটাই বেশি কাজ করেছে। সত্য ঘটনার সঙ্গে কল্পনা, গুজব ও গুঞ্জন মিশিয়ে বেশ মনোহারী এক পরিবেশন। ছবির শুরু তামিলনাড়ু বিধানসভায় AIDMK দলের একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি জয়ললিতার বক্তব্য পেশ করার দৃশ্য দিয়ে। যেখানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির ‘চ্যালা’রা তাঁকে শারীরিক হেনস্থা করে। বিধ্বস্ত জয়া বিধানসভা পরিত্যাগের আগে প্রতিজ্ঞা করেন, পরেরবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই বিধানসভায় ঢুকে অপমানের প্রতিশোধ নেবেন।
এরপরই ফ্ল্যাশব্যাক। শুরু হয় অতীতের কাহিনি। MGR-এর সঙ্গে নাচ-গান আর রোমান্সের শট দেওয়া থেকে, শিবাজি গণেশনের সঙ্গে মাত্র একটি ছবিতে অভিনয় করা, আর মাঝে মাঝেই MGR-এর সচিব করুণার সঙ্গে নীরব সংঘাত মিলিয়ে গল্পের মোচড়গুলো বেশ নাটুকে। MGR-এর সঙ্গে সত্যিই জয়ললিতার রাধা-কৃষ্ণের মতো প্রেম ছিল কিনা, তা নিয়ে সেকালে প্রচুর চর্চা হয়। কিন্তু জয়ার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু ছিলেন তিনিই। বলেছিলেন, “তুমি যদি মানুষকে সত্যিই ভালবাস, তাহলে তাঁরাও তোমাকে একইরকমভাবে ভালবাসবে।” এই মন্ত্রটুকু সম্বল করেই, অভিনয় জীবন ছেড়ে জয়া নেমে পড়েন তামিলনাড়ুর রাজনীতির পঙ্কিল মাঠে। যেখানে করুণানিধির মতো ব্যক্তিত্ব তাঁকে কম বেগ দেননি। শেষ পর্যন্ত তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কেমন করে জয়া একান্তই নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে জনগণের মন জয় করে কারুণানিধির পতন ঘটান, দিল্লির সংসদে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীরও মন জয় করে নেন, সেসব ঘটনার আঁচড়ে ছবিটি কিঞ্চিৎ পলিটিক্যাল তথ্যচিত্রের আকার নেয়।
মন্দ নয় এই ভাবনা। কিন্তু যাঁরা ‘থালাইভি’ অর্থাৎ নেত্রী জয়ললিতার রাজনৈতিক জীবন দেখার আশায় হলে ঢুকবেন, তাঁদের নিরাশ হতে হবে। কারণ ‘জয়া আম্মা’র রাজনৈতিক জীবন কতটা পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত, রঙিন এবং বিতর্কিত তা অনেকেই জানেন। পরিচালক বিজয় সেইমুখো একেবারেই হননি, মুখ্যমন্ত্রীর শপথবাক্য পাঠের পরই নিজের ঘরে ঢুকে MGR-এর ছবির সামনে জয়ার দাঁড়ানোতেই গল্পের ‘সমাপ্তি’।
এই ছবির প্রাপ্তি শুধু MGR-এর চরিত্রে অরবিন্দ স্বামীর অসাধারণ অভিনয়। দাক্ষিণাত্যের নেতাকে তিনি নকল বা ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু মুখে রুমাল ধরে রাখা, টুপি ও চশমা পরে তাঁর চাউনির ম্যানারিজম সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। চেহারাটাও অনেক বদলাতে হয়েছে অরবিন্দকে। তুলনায়, জয়ার চরিত্রে কঙ্গনা রানাউত (Kangana Ranaut) কিন্তু চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি, কঙ্গনাই রয়ে গেছেন। দু’টি সংলাপহীন ফোনালাপের দৃশ্যে অবশ্য অরবিন্দ এবং কঙ্গনা দু’জনেই সঙ্গত করেছেন সুন্দর। MGR-এর মৃত্যুদৃশ্যের উপস্থাপনা একটু বেশি নাটকীয়, কারণ মৃতদেহের কাছে জয়াকে যেতে না দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার ঘটনা মোটেই সত্য নয়। তা স্রেফ নাটক তৈরির মসলা, এই ছবির সঙ্গে খাপ খায় না।
বিশাল ভিত্তালের ক্যামেরার কাজ ব্যবসায়িক ছবির স্টাইল মেনেই। জি ডি প্রকাশ কুমারের সুরে দু’টি গান আবহ হিসেবে মন্দ নয়, কিন্তু না থাকলেও চলত। অন্তত ছবির দৈর্ঘ্য ক্লান্তিকর হত না। আমাদের দেশে পরিচিত মানুষের জীবনীমূলক ছবি মানেই তাঁর গুণকীর্তন! ‘থালাইভি’ কোনওভাবেই সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। শুধু ভাল ঘটনা, ভাল মানুষ, কুটিল রাজনীতির ঘোলা জল ছাড়া জয়া বা MGR-এর জীবনের ছায়া ছায়া দিকগুলো একেবারেই অনুপস্থিত। যেটা কখনই পুরো বাস্তব নয়। যেমন নয় জয়ার ‘থালাইভি’ হয়ে ওঠার জটিল রাস্তাটা। পরবর্তী জীবনে জয়া আরও জটিল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অস্তিত্ব ঘিরে ছিল রহস্যের কালো মেঘ। সেটা আর কোন পরিচালক স্পর্শ করার সাহস করবেন?
সিনেমা – থালাইভি
অভিনয়ে – কঙ্গনা রানাউত, অরবিন্দ স্বামী, নাসের, ভাগ্যশ্রী, মধু
পরিচালনা – এ. এল. বিজয়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.