বিশ্বদীপ দে: বিদায় ‘জীবনপুরের পথিক’। ‘চাওয়া পাওয়া’র ঊর্ধ্বে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের যে খেলা প্রকৃতিতে, বাঙালির জীবনের সেই খেলাই তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar) তুলে ধরতেন নিজের ছবিতে। বাঙালি, বলা ভাল মধ্যবিত্ত বাঙালি বলতে যে আর্কিটাইপ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেই বাঙালিকে চিনতে হলে আগামী দিনেও নতুন প্রজন্মকে দেখতে হবে তাঁর ছবি। দেখতেই হবে। দেখতে দেখতে তারা বুঝতে পারবে, বাঙালি একসময় এমনই ছিল। সেই হাসি-কান্না-অভিমান আর হৃদয় উপচে পড়া ভালবাসাকে সেলুলয়েডে ধরে রেখে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ‘পলাতক’, ‘বালিকা বধূ’ থেকে শুরু করে একেবারে শেষের ‘ভালবাসার বাড়ি’-তে সেই ধারা অটুট ছিল।
বাঙালির কেবল সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-তপন সিনহা ছিল না। ছিলেন তরুণ মজুমদাররাও। যাঁদের ছবি দেখতে ভিড় জমাত সব বয়সিরাই। কেননা, সকলের জন্য়ই কিছু না কিছু থাকত সেই ছবিগুলিতে। সবথেকে বড় কথা, অন্ধকার হলে নায়কের ‘লার্জার দ্যান লাইফ বীরগাথা’র আবেদন ছাড়াও স্রেফ চেনা জীবনের গল্পকেও যে রূপকথা করে তোলা যায়, সেটাই তরুণ মজুমদারের ইউএসপি।
বাঙালির যৌথ পরিবার আর নেই। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির স্কোয়ার ফুটে মাপা জীবনের বিপ্রতীপে তরুণবাবুর ছবিগুলি দেখলে আজ সমান্তরাল বিশ্বের কথা মনে হতে পারে। অথচ কয়েক দশক আগে এটাই ছিল বাঙালির চেনা জীবন। সেই জলছাপ খুঁজতে চাইলে আপনাকে দেখতেই হবে ‘সংসার সীমান্তে’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’র মতো ছবি। ‘দাদার কীর্তি’র কথাই ধরা যাক। এই ছবির নায়ক কেদারের পড়াশোনায় মাথা নেই। অনেক চেষ্টাতেও বিএ পরীক্ষায় আর পাশ করতে পারে না। বাবা রেগে গিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বিহারে কাকার বাড়িতে। নেহাতই ক্যাবলা, সরলপ্রাণ কেদারের মনে ধরে সরস্বতীকে। আদ্যন্ত সিরিয়াস মেয়ে সে। তবু কেদার যখন পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে ওঠে, তখন সেই পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকা তরুণীর দুই চোখে মনকেমনের মেঘ ভেসে ওঠে। এই প্রেমের মাঝে এসে দাঁড়ায় ভোম্বলদার মতো এক নিষ্ঠুর মানুষ। নিষ্ঠুর, তবু সে হৃদয়হীন নয়। শেষপর্যন্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে কেদার-সরস্বতীর অভিমানের পাথর ঠেলে সরিয়ে দেয় আমোদগেঁড়ে ভোম্বলদাই। গোটা ছবি জুড়ে ঝিকমিক করছে বাঙালিয়ানা। দোলখেলা থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মিলনীর যে ডকুমেন্টেশন ধরা রয়েছে ‘দাদার কীর্তি’তে তা তুলনাহীন। দেখলে মনে হয়, টাইম মেশিনে চড়ে কয়েক দশক পরের সেই আপাত শান্ত সময় থেকে ঘুরে আসতে।
কিংবা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’। দুই কিশোর-কিশোরীর প্রেম, বয়ঃসন্ধির সীমানা পেরিয়ে একটু একটু করে জীবনকে চিনে নেওয়ার গল্প। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের সম্পর্কের মধ্যে থাকা সীমাহীন সারল্য। যে সরলতা আজ বোধহয় লুপ্তপ্রায় অঙ্গের মতো হয়ে গিয়েছে। ছবি ধরে ধরে আলোচনার পরিসর এখানে নেই। কিন্তু ঘটনা হল, তরুণ মজুমদারের সব ছবিতেই এই আলোময় ও প্রীতিকর মুহূর্তগুলি ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত।
তরুণ মজুমদারের (Tarun Majumdar) ছবির আরেক বড় শক্তি তার গান। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানকে বাণিজ্যিক ছবিতে ব্যবহার করাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযোজকদেরও নাকি প্রথম দিকে আপত্তি থাকত। আপাত ধীরগতির গান। কিন্তু সিচুয়েশন বুঝে প্রয়োগ করলে সাধারণ দর্শককেও মুগ্ধ করা যায়, তা প্রতিটি ছবিতেই প্রমাণ করে দিয়েছেন তরুণবাবু। ‘আলো’ ছবির একেবারে শেষে যখন মৃতা আলো চ্যাটার্জির গান বেজে ওঠে গ্রামাফোনে, তখন কার্যত একটা ম্যাজিক তৈরি হয়ে যায়। কিংবা ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’। গানটির প্রয়োগ যে কতটা সুপ্রযুক্ত হয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিংবা ‘পলাতক’ ছবির সেই গান ‘জীবনপুরের পথিক’। এটা অবশ্য রবীন্দ্রসংগীত নয়। কিন্তু প্রয়োগকৌশলের নৈপুণ্যে তা অব্যর্থ হয়ে ওঠে যেন।
কোথাও পড়েছিলাম, তিনি বরাবরই জোর দিয়েছেন মানবিক মূল্যবোধের উপরে। তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। জানতেন, আজ যা আধুনিক, কাল তা পুরনো। কিন্তু মূল্যবোধের দ্যুতি চিরকালীন। সেই সুরকেই তাই তিনি তাঁর ছবির উপজীব্য করে তুলতে চেয়েছেন। বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ে বাঙালির হেঁসেল থেকে বৈঠকখানা- সবই বদলেছে।
মূল্যবোধও আপাত ভাবে কি বদলায়নি? কিন্তু সেই বদল আসলে বহিরঙ্গে। ভিতরে ভিতরে প্রেম-অভিমান-বিচ্ছেদের সুরে কোনও পরিবর্তন বোধহয় হয়নি। আজও তাই তরুণ মজুমদারের ছবি, বিশেষ করে আটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বানানো ছবিগুলি দেখতে বসলে সময় নিজের মতো করে বয়ে যেতে থাকে। বুঝিয়ে দেয়, এর আবেদন তামাদি হয়নি। হবেও না। ব্যক্তি তরুণ মজুমদার হারিয়ে গেলেন চিরকালের জন্য। কিন্তু রয়ে গেল তাঁর কাজ। টিভির পরদা হোক কিংবা মুঠোফোনের স্ক্রিন- আগামিদিনেও তা দর্শককে বসিয়ে রাখবে। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুর কি কখনও পুরনো হয়?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.