Advertisement
Advertisement
paparazzi

বর্ষশেষের ছুটির দুনিয়ায় তারকা নিজে পাপারাৎজি

পুরনো দিনের প্রাইভেসি এখন বিলুপ্ত।

Nowadays stars become paparazzi। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:December 30, 2021 11:51 am
  • Updated:December 30, 2021 12:42 pm  

গৌতম ভট্টাচার্য: ভয়ংকর রকম টেকনির্ভর দু’হাজার একুশের শেষে পুরনো সেই পৃথিবী প্রায় অবাস্তব। বর্ষশেষের ছুটি কাটানোর সনাতনী মডেলও হুমড়ি খেয়ে নিজেকে নতুন আবিষ্কার করছে। দেখছে, না চাইতেও সে যেন একটা আস্ত অ্যাপ হয়ে গিয়েছে। ডাউনলোড করো আর গুগল ম্যাপের মতো তার সংকেত বুঝে চলো।

আজকের দুনিয়ায় প্রাইভেসি বলে কিছু বস্তুত অদৃশ্য। ভক্তরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারের মতো মোবাইল-নিষিদ্ধ এলাকাতেও টুক করে ফোন-ক্যামেরায় ছুটি কাটাতে যাওয়া শচীনকে (Sachin Tendulkar) ধরে রাখে। বা আজও ঐশ্বর্য রাইকে আচমকা এয়ারপোর্টে আবিষ্কার করলে ছবি তোলার অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে না। ওমিক্রনে আক্রান্ত বিশ্ব তার একুশের বর্ষশেষের সময় পৃথিবীব্যাপী ফ্লাইট ক্যানসেল করিয়ে ছুটির অর্ধেক প্ল্যানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারকাদের মনোবাসনা ধ্বংস করতে পারেনি। অনিশ্চিত সময় অনুযায়ী তারকাদের ছুটির রোডম্যাপও তো বদলেছে। স্পেন বা ইতালি এখন টার্গেট না করে তাঁরা বেশির ভাগ বেছে নিচ্ছেন কাছের দুবাই বা আরও বেশি করে মলদ্বীপ (Maldives)। দু’জায়গাতেই কোভিডের ঝক্কি নেই। ফ্লাইট বাতিল হওয়ার ঝুঁকি কম। আর দুর্ধর্ষ লোকেশন। যাকে বলে ছবির জন্য খাসা। হাই স্পিড ওয়াই ফাই-ও রয়েছে। পরিবর্তিত পৃথিবীতে আর তাঁদের কী চাওয়ার থাকতে পারে?

Advertisement

[আরও পড়ুন: বিক্ষোভ, প্রতিবাদে কর্ণপাত নয়, নাগাল্যান্ডে আফস্পার মেয়াদ আরও ছ’মাস বাড়িয়ে দিল কেন্দ্র]

Big b

কত তফাত পুরনো সময়ের চেয়ে তার নমুনা পেশ করি। নয়ের দশকের শুরু। নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ম্যানহাটন অঞ্চল দিয়ে ক্রিসমাসের দোকানসজ্জা দেখতে দেখতে অফিস যাচ্ছেন এক উত্তর ভারতীয়। হঠাৎ উলটো দিকের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসতে দেখলেন জ্যাকেট পরা দীর্ঘকায় মুখকে। আর পাঁচজন পথচারীর সঙ্গে। কিন্তু মুখ আর ওই হাঁটা তো খুব পরিচিত। অমিতাভ বচ্চন না?

সেলফি আর মোবাইল ফোনের জগৎ তখন পশ্চিমি দেশেও আবির্ভূত হয়নি। অমিতাভ (Amitabh Bachchan) সামনের এক বহুতলে ঢুকে যাওয়ার আগে সেই ফ্যান প্রাণপণ ধাওয়া করে কোনওরকমে অটোগ্রাফ নিলেন। ভদ্রলোক জানতেও পারলেন না বলিউড থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেওয়া অমিতাভ এখন নিউ ইয়র্কেই ঘাঁটি গেড়েছেন। ম্যানহাটন চত্বরে একটা দু’রুমের ঘর ভাড়া করে সেখানেই থাকতেন। নিজের ব্রেকফাস্ট নিজে বানাতেন। আর কালো মার্সিডিজটা নিচের গ্যারাজ থেকে বার করে ছুটতেন একঘণ্টা দূরে নিউ জার্সির অফিসে। বহির্জগতের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক ও পেশাদার যোগাযোগ চালু রাখত একটা ফ্যাক্স মেশিন। চুরানব্বইয়ের ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন মারাদোনা নিয়ে সাক্ষাৎকারের জন্য সেই ফ্যাক্স মেশিনেরই শরণাপন্ন হয়েছিলাম। যার পাশের চেয়ারটা ছিল তাঁর সেক্রেটারির। অনাবাসীদের জন্য বচ্চনভাইরা যে টিভি চ্যানেল খুলেছিলেন তার মার্কিন নার্ভ সেন্টার ছিল ওই অফিস। টিভি এশিয়া ইউএসএ।

[আরও পড়ুন: সানির ‘মধুবন’ গানের ভিডিও ঘিরে তুমুল বিক্ষোভ, মুম্বইয়ে জ্বালানো হল অভিনেত্রীর পোস্টার]

তখনকার পৃথিবীতে ইন্টারনেট বলে কিছু নেই। তাই নিউজ পোর্টাল একমাত্র কল্পবিজ্ঞানে। এত চ্যানেল ছিল না। আজকের মতো ভারতীয়দের এত আগ্রাসন হয়নি বিদেশের শহরগুলোয়। অমিতাভ সকলের মধ্যে থেকেও খুব নিভৃতভাবে থাকতে পারতেন। আজ প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার দিনলিপি দূর লস এঞ্জেলেস থেকে ভক্তদের জন্য নিয়ত ভেসে আসে। অথচ তিনি, বচ্চন যে বলিউডের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়ে পাঁচ বছর মার্কিন প্রবাসী ছিলেন ক’জনের জানা? সত্যি হোক মিথ্যে হোক, রটেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও বিচে তাঁকে এমন বিশেষ কারও সঙ্গে পর্যটক দেখেছে যা আজকের দিনে হলে ভিডিও হয়ে সিলসিলার গানের চেয়েও বেশি ভাইরাল হয়ে যেত।

Madhuri

কিন্তু বলিউডের ফিল্ম পোর্টালগুলোর কখনও কোনও বিদেশি পাপারাৎজি পোষার ক্ষমতা হয়নি। না ছিল স্টারডাস্ট জাতীয় ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোর। তখনকার দিনে বিশ্বাসযোগ্য রেকর্ডিংয়ের জন্য টেলি ফটো লেন্স বাদ দিয়ে কিছুই ছিল না। ক’জনের জানা যে সাউথ অফ ফ্রান্সে আজও বচ্চন পরিবারের সুদৃশ্য বাংলো রয়েছে? তিনি, মাধুরী দীক্ষিত তাঁর বহুচর্চিত বিয়ের পর হানিমুন করেছিলেন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। কেউ কখনও সেই ছবি দেখেছে? নাকি পেয়েছে? ছুটি কাটাতে যাওয়া তখন ছিল বেডরুমের দরজা। একটা সময় পর যা ভক্ত ও মিডিয়ার সামনে বন্ধ হয়ে যাবেই। তারকাদের মানসিকতা অন্যরকম ছিল।

এই যে ‘৮৩’ ছবির আসল নায়ক তিনি, কপিল দেব! বছরদশেক আগে বিদেশে ছুটি কাটানোর ফাঁকে ফোনে আমায় ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। দিনটা সেই ২৫ জুন। তাঁদের বিশ্বকাপ জয়ের বার্ষিকী। সাক্ষাৎকারের বিষয়ও তাই। জানতাম উনি ফ্যামিলি নিয়ে আমেরিকায়। শুধু জানতাম না কোন শহরে। শহরটা জানলে কপি বা ইন্ট্রোতে রাখা যায়। কিন্তু জিজ্ঞেস করামাত্র কপিল যেন চটেই গেলেন, “শহর দিয়ে কী করবেন? আপনার দরকার তো আমার ইন্টারভিউ।” বুঝলাম ছুটি কাটানোর লোকেশন জনসমক্ষে আবৃত করতে চান না। ঠিক যেমন চাইতেন না প্র্যাকটিসে তাঁর খালি গায়ে বল করার ছবি কোনও ফোটোগ্রাফার তুলুক।

Akshay Kumar

জাম্প কাট ২০২১ ডিসেম্বর। মলদ্বীপে সাধারণ পর্যটকের মতো সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অক্ষয় কুমার। সেখানে ছোট দ্বীপসমেত সাততারা হোটেলের প্রাইভেট সব বিচ। যা আম পাবলিক কেন, কোটিপতিরাও বুকিংয়ের আগে দু’বার ভাববে। তাহলে এই ভিডিও কে তুলল? উত্তর, অক্ষয়ের নিজের নির্দেশনায়। কেবল এই ছবি দেখে অবাক হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এবার মলদ্বীপের সমুদ্রের ধারে সাসপেন্ডেড নেটের উপর তিনি ও স্ত্রী টুইংকল কীভাবে শুয়ে সেই গোপন ছবিও নেটিজেনদের দেখিয়ে দিয়েছেন খিলাড়ি। ছুটি কাটানোর ফাঁকে তারকাদের এমন সুপার এক্সক্লুসিভ ছবি বিক্রি করেই এককালে পেট চালিয়েছে পাপারাৎজিরা। সমস্যা হল এখন তাদের ব্যবসায় তালা। এযুগে তারকা নিজেই তো পাপারাৎজি।

প্রাইভেট অন্তরঙ্গ ছবি যে যুগে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করে এক্সক্লুসিভ খবর দিচ্ছেন, সেখানে তারকারা যে আরও খুল্লমখুল্লা হবেন তাতে আশ্চর্য কী? কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংয়ের সঙ্গে রাজ্যসভার টিভি অ্যাংকর অমৃতা রাইয়ের অন্তরঙ্গ ছবি বেরিয়ে পড়ে কম বিতর্ক হয়নি। ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল ছবিগুলো। কিন্তু তখন সাতষট্টি বছর বয়সি দিগ্বিজয় টুইটারে দ্রুত পোস্ট করে জানিয়ে দেন যে অমৃতার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে এবং তাঁকে নিজের নতুন জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছেন। স্ক্যান্ডাল এবং স্ক্যান্ডালের অবসান দুটোই সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাবেকি মডেল অনুযায়ী প্রথম খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনে বেরোবে এবং মীমাংসিত হবে, সেই দিন শেষ। ছুটি কাটানোর কভারেজ মডেল তাই বদলে স্বয়ং তারকাদের হাতে চলে যাবে তা আর বিচিত্র কী? নতুন সময়ে তাঁরাই একমাত্র ছবি উৎক্ষেপণ স্টেশন।

বছরখানেক আগে ইনস্টাগ্রামের আবির্ভাব এই পরিবর্তনকে যেন ফাস্ট ফরওয়ার্ড মোডে এনে দিয়েছে। ইনস্টাগ্রামে কারও ছবি যত বেশি লাইক হবে। ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামে সেই ভিডিও যত শেয়ার হবে তত বেশি টাকা। আধুনিক জমানায় তাই ফিল্মস্টারদের নতুন ছবি বাগাতে চাওয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে ফলোয়ার্স বাড়ানো। যত বেশি ফলোয়ার্স তত বেশি রোজগারের সুযোগ। বিরাট কোহলি-অনুষ্কারা যেসব ছবি আপলোড করেন তা তাঁদের পরিচিত ঘনিষ্ঠতম ফটোগ্রাফারও কখনও পাবে না। প্রতিটি ছবির মূল্য যে কোটি কোটি টাকা। দায় পড়েছে অন্য কাউকে দিয়ে চ্যারিটি করার।

বাংলায় মিমি-শ্রাবন্তী -শুভশ্রী-পার্নো-ঋতুপর্ণাদেরও তাই। প্রত্যেকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ইনস্টাগ্রাম রিল আর ছবি নির্দিষ্ট সময়ে দিতেই হবে। সোশ্যাল মিডিয়া রিসার্চ বলছে, নেটিজেনরা সবচেয়ে বেশি চায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি দেখতে। যা একেবারে অন্যরকম এবং প্রাইভেট ছবি। মানে শচীন ব্যাট নিয়ে দাঁড়ালে হবে না। সে তো সবার দেখা। কিন্তু ছুটিতে গিটার নিয়ে সমুদ্রের ধরে দাঁড়ালে অবধারিত সুপারহিট।

হালফিল বাংলা ফিল্মজগতের হিরো-হিরোইনরা যখন বেড়াতে যান, প্রথম শর্ত থাকে কে ছবি তুলবে? সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে সবচেয়ে খুঁতখুঁতে শোনা যায় মিমি। মিমি বেড়াতে দুবাই যান বা গোয়া। সঙ্গে এমন কাউকে সঙ্গী নির্বাচন করেন যে ভাল ছবি এবং ভিডিও তুলতে পারবে। ঠিকঠাক ছবি এবং ভিডিও আপলোড করতে না পারলে তো গোটা সফর বৃথা। শুভশ্রী মালদ্বীপ সফর থেকে এত দুর্দান্ত ছবি আপলোড করতে পারার সব কৃতিত্ব দেন স্বামী রাজকে। বলেন, “রাজ তো একরকম ওর নিজের ফিল্মেরও ডিওপি। ওর ফোটোগ্রাফিক সেন্সটা খুব ভাল।”

শ্রাবন্তীও পিছিয়ে নেই। ব্যাপক ফলোয়ার তাঁর দুই বাংলায়। ইদানীং যে সব আউটডোর ভিডিও এবং ছবি আপলোড করছেন তাতে পরিষ্কার, জীবনে তাঁর নতুন সঙ্গীর ছবি তোলার হাত ভাল। ঋতুপর্ণা সম্প্রতি লন্ডনে ছুটি কাটাতে নামামাত্র খূঁজেছেন একজন কাউকে যে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে তাঁর ইনস্টাগ্রাম রিলস তুলে দিতে পারবে। সেলফি একটা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করে। কিন্তু নিজের ভালো ভিডিও তুলতে হলে সাহায্যকারী লাগবেই। আবার বলা যাক ভিডিওর রিচ যত বেশি, পোস্টের হিট যত বেশি—— তত ডলার। এই একটা ব্যাপার কোভিডেও আটকাচ্ছে না বরং ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জমানায় তারকা-পোস্টে মনোযোগ আরও বাড়ছে। লোকে যেন ধরে নিচ্ছে, এটাই সিনেমা।

ভাবতে পারেন এত বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যিনি আসবেন না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়েছিলেন সেই সুনীল গাভাসকর অবধি সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে যোগ দিয়েছেন। আর সেই লম্বা লোকটি? যিনি পেশাদার জীবনের সেরা সময় এত প্রাইভেট ছিলেন যে মিডিয়া থেকে নিয়মিত সরে থাকতেন, শেষ জন্মদিনে কিনা মালদ্বীপ থেকে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটানোর অন্তরঙ্গ ছবি দিব্যি পোস্ট করেছেন।

বললাম না, নয়ের দশক নয়। এটা শেষ ২০২১। তারারা নিজেই যখন পাপারাৎজি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement