বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: “বিইং ডিফারেন্ট ইজ ডেঞ্জারাস।” বললেন পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এই পরিচয়ের সংকট নিয়ে তাঁর ইংরেজি ছবি “নো ল্যান্ড’স ম্যান”। ছবিতে অভিনয় করছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি।
ইরফান খানের পর এবার নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরবর্তী ছবিতে। নওয়াজুদ্দিন নিজে টুইটারে এই কথা ঘোষণা করেছেন সম্প্রতি। তিনি লিখেছেন ‘দ্য মোস্ট কভেটেড স্ক্রিপ্ট ইজ ফাইনালি গোইং টু বি মেড ইন্টু আ ফিল্ম।’ ছবির নাম “নো ল্যান্ড’স ম্যান”। ‘ফটোগ্রাফ’ এবং ‘মান্টো’র পর নওয়াজকে আবারও এই গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে দেখা যাবে। এক দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করবেন নওয়াজ। আমেরিকাতে গিয়ে এক অস্ট্রেলীয় মেয়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর কীভাবে তার জীবন পালটে যায় সেটাই দেখাবে এই ছবি। এই মুহূর্তে চলছে ছবির প্রি-প্রোডাকশন। ছবিটি প্রযোজনায় থাকছেন নওয়াজুদ্দিন নিজেই। সেই সঙ্গে প্রযোজনা করছেন বাংলাদেশের পরিচালক ফারুকী, অভিনেত্রী নুসরত ইমরোজ তিশা, অঞ্জন চৌধুরি (বাংলাদেশ)। এবং আরও বেশ কিছু জনের সঙ্গে কথা চলছে। নওয়াজ নিজে জানিয়েছেন, ‘আই ফেল্ট কমপেল্ড টু বি অ্যাসোসিয়েটেড উইথ দ্য প্রোজেক্ট ইন মোর দ্যান জাস্ট দ্য ক্যাপাসিটি অফ অ্যান অ্যাক্টর, অ্যাজ আই থট দিস ইজ দ্যাট কাইন্ড অফ ফিল্ম হুইচ রিয়্যালি নিডস টু বি মেড।’
মোবাইলে কথা হল পরিচালক ফারুকীর সঙ্গে। তিনি এখন বাংলাদেশে। জানালেন “নো ল্যান্ড’স ম্যান” আইডেন্টিটি ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি। বিশদে কথা বললেন তিনি।
আপনি নিজেই বলেছেন আইডেন্টিটি ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি এটি। কীভাবে এই ছবির জন্ম?
ফারুকী: আসলে এটাই প্রথম ছবি হওয়ার কথা ছিল। ঘটনাচক্রে হয়ে গেল দ্বিতীয়। এই ছবির ভাবনা শুরু হয় ২০১০ সালে। তখনই লেখালিখির শুরু। ২০১৪ সালে বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এশিয়ান প্রোজেক্ট মার্কেটে বেস্ট প্রোজেক্ট পুরস্কার পায়। এই ছবি ছাড়া জাফর পানাহির একটি স্ক্রিপ্টও পুরস্কৃত হয়। তারপর ফিল্ম বাজারেও পুরস্কৃত হয়। এই ছবিটা দ্রুত তৈরি করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই ছবির আয়োজনটা বিশাল। ফিন্যান্স জোগাড় করার ব্যাপার ছিল। চারটে দেশে শুটিং হওয়ার কথা। যখন এই ভাবনা চলছে তখনই আমাদের দেশের এক ক্যাফেতে টেরর অ্যাটাক হয়। সেই সময় দাঁড়িয়ে মনে হয় এটা নিয়েও কাজ করা দরকার। ‘শনিবার বিকেলে’ প্রচ্ছন্নভাবে ঢাকার টেরর অ্যাটাক নিয়ে তৈরি। তৃতীয় ছবি হবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে।
[ আরও পড়ুন: বিজেপি ও তৃণমূলকে ভোট নয়, ডাক দিল বাংলার বিদ্বজ্জনদের একাংশ ]
এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নিয়ে ছবি কেন?
ফারুকী: হ্যাঁ, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেন উঠছে আইডেন্টিটির প্রসঙ্গ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যদি তাকাই দেখব খুব উত্তপ্ত এবং বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এই উত্তাপ এবং বিপজ্জনক অবস্থার জন্য দায়ী হল পরিচয়ের সংকট। অর্থাৎ একদল বলবে আমার জাতি শ্রেষ্ঠ, তোমার নয়। আমার ধর্মীয় পরিচয় শ্রেষ্ঠ, তোমার নয়। গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে এই ম্যানিয়া। ছোটবেলায় দেখতাম একজন মানুষ যখন অন্যকে অপছন্দ করে তখন তার পিছনে কারণ থাকে। হয় সেই ব্যক্তি তার সঙ্গে বা অন্য কারও সঙ্গে কোনও খারাপ আচরণ করেছে তাই তাকে অপছন্দের তালিকায় ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ তার কাজের ওপর নির্ভর করত সে কেমন মানুষ। এখন পৃথিবীতে কাজের নিরিখে মানুষের বিচার হয় না। তার জাতি বা ধর্মের নিরিখে বিচার হয়। এই যে লোকটা ক্যাফেতে ঢুকে অ্যাটাক করল, ক্যাফের যে মানুষগুলো তার সঙ্গে এই সন্ত্রাসবাদীর কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। সে তাদের চেনেও না। হয়তো তাদের সঙ্গে কথা বললে সে গল্পই করত। কিন্তু সে প্রাণ নিল। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে যে ঘটনা ঘটল, সেখানেও একই কথা বলব। যে মানুষগুলো মারা গেল এবং যে তাদের মারল তারা পরস্পরকে চেনেই না। যাদের মারল তাদের সম্পর্কে এই সন্ত্রাসবাদীর কোনও ধারণাই নেই। জাস্ট বিকজ হু দে আর, দে আর বিইং কিলড। এটা ভয়ের। আমার আইডেনটিটি শ্রেষ্ঠ, এই ধারণা খুব বিপজ্জনক। কারণ ভিন্ন হলেই মুশকিল। বিইং ডিফারেন্ট ইজ ডেঞ্জারাস। আপনি এই দেশে গরু খেলে মুশকিল, আরেক দেশে পোর্ক খেলে মুশকিল। এক দেশে খোদায় বিশ্বাস করলে মুশকিল, আরেক দেশে ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে সমস্যা! এক দেশে গায়ের রং ফর্সা হলে বিপদ, আরেক দেশে গায়ের রং কালো হলে বিপদ। এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই আইডেন্টিটি নিয়ে। তাই সেটা নিয়েই এই আইডেন্টিটি ট্রিলজি।
এই তিনটে ছবির স্বাদ কেমন?
ফারুকী: প্রত্যেকটাই একে অপরের থেকে আলাদা। ‘শনিবারের বিকেল’ ডার্ক এবং সাফোকেটিং। “নো ল্যান্ড’স ম্যান” হিউমারাস এবং ইমোশনাল। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ছবিটা পিওরলি ইমোশনাল।
“নো ল্যান্ড’স ম্যান”-এর জন্য নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিকে কীভাবে রাজি করালেন?
ফারুকী: ২০১৪ সালে যখন ‘ফিল্ম বাজার’-এর জন্য মুম্বইয়ে গিয়েছিলাম তখন আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। নওয়াজের সঙ্গে তার আলাপ ছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করায় আমি তাকে বলেছিলাম, এই ছবিতে আমি নওয়াজকে ভাবছি। সেই আমাকে নওয়াজের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যায়। এবং সেদিন গল্পটা শোনাব এমন প্ল্যান ঠিক করা ছিল না। আড্ডা হবে এমনটাই ভেবেছিলাম। কথায় কথায় ছবির কথা ওঠে। তখন নওয়াজ জানতে চায় গল্পটা। আমি ঠিক গল্প বলব বলে তো আসিনি। তবুও গল্প বলা শুরু করলাম। তখনও ওকে বলিনি যে ওর কথা ভাবছি। আমি গল্প বলছি আর দেখছি নওয়াজের চোখে নানারকম প্রতিক্রিয়া খেলা করছে। ও মন দিয়ে গল্পটা শুনছিল। গল্প শেষ করে বললাম, আই ওয়ান্ট ইউ টু ডু ইট। নওয়াজ সঙ্গে সঙ্গে রাজি। এই ছবিটা যে সম্ভব হয়েছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে নওয়াজ।
এই ছবির জন্য নওয়াজুদ্দিনকেই কেন ভাবলেন?
ফারুকী: নওয়াজের অভিনয় আমি দেখেছি। ওর অভিনয়ের মধ্যে আমার যেটা ভাল লাগে সেটা হল, ওর অভিনয়ে একটা তাৎক্ষণিকতা আছে। বা সেটাকে বাস্তবিকতাও বলা যায়। ও যখন অভিনয় করে তখন ওর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা ‘সাডেননেস’ দেখা যায়। অর্থাৎ এর পর কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সেটা আগে থেকে বলা যায় না। একটা স্পনটেনিটি আছে। ওর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হল, সেটা আনপ্রিটেনশাস। ইট মেকস দ্য অ্যাক্ট ভেরি ভেরি রিয়্যাল। এবং দ্বিতীয় হল ওর চোখের মধে্য একটা ‘নাইভ’ বা ‘সরল’ ব্যাপার আছে যেটা আমার এই চরিত্রের জন্য দরকার ছিল।
[ আরও পড়ুন: গ্লাভস পরে অনুরাগীদের সঙ্গে করমর্দন! নেটদুনিয়ায় ট্রোলড মিমি ]
কোথায় কোথায় শুটিং হবে?
ফারুকী: নিউ ইয়র্কে বেশিরভাগটাই হবে। এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়াতে হবে।
ভারতের কোথায় হবে?
ফারুকী: বেশিরভাগ হবে মুম্বইয়ে। এছাড়া হয় পাঞ্জাব অথবা রাজস্থানে হবে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে ছবিটা কীভাবে ভাবছেন?
ফারুকী: এই মুহূর্তে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দয়ায় বাংলাদেশের অনেকটা পপুলেশন জুড়ে এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এসেছে। বড় ‘জেনোসাইড’-এর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলা যায়। এটা একদিকে যেমন হয়েছে অন্য দিকে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা, চাপ পড়ছে ইকো সিস্টেমের ওপর। এই যে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা তারা যে বাংলাদেশে এসেছে, নিজের ইচ্ছেয় তো আসেনি। রাজনীতি ঠিক করে দিচ্ছে তারা কোন দেশে থাকবে। তারা নিজেরা রাষ্ট্র তৈরি করেনি, মানচিত্রও বানায়নি। একদল এসে তাদের মাথার ওপর দেশ চাপিয়ে দিচ্ছে। আবার অন্য দল এসে সেই দেশ কেড়েও নিচ্ছে। তাদের সংকট এবং বাংলাদেশের সংকট এই নিয়েই মানবিক একটি গল্প দেখানোর চেষ্টা করব ট্রিলজির তৃতীয় ছবিতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.