মনে হয় কোথাও যেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনটা দেশপ্রেম, কোনটা নয়! কী করলে নিজের দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন যথাযথ হবে, কী করলেই বা উল্টোটা প্রতিপন্ন হবে? সম্প্রদায়ের প্রতি কোন কাজে একনিষ্ঠ থাকা যাবে, কোন কাজ করলে নয়? সব ধারণা এই মুহূর্তে এক জগাখিচুড়ি অবস্থানে। লিখলেন, সরোজ দরবার
Advertisement
গমগম করে দিকে দিকে বাজছে পাকবিরোধী শব্দরা। পতপত করে উড়ছে চিনা দ্রব্য বয়কটের নিশান। ক্ষোভ এতটাই জোরদার যে কেউ কেউ জানতে চাইছেন, চিনা বাদামও কি চিন থেকে আসে? হাওয়া যেদিকে জাতীয়তাবোধের দিকনির্দেশও সেদিকে। আর তা যদি না হয়, তবে অবধারিত বিরোধিতার অভিযোগ। সত্যির উল্টো মাত্রই মিথ্যে নয়, তবু এর মধ্যে কোনও আবছায়াকে পাত্তা দিতে নারাজ এই সময়। অতএব ফেরত পাঠাও পাক অভিনেতাদের। সমর্থন করো ফেরত পাঠানোয়, নইলে দেশকে তো তুমি ভালবাস না!
এদিকে করণ জোহর খুব চোখ ছলছল করে বলছেন যে, এরকমই অভিযোগ শুনে তিনি এতটাই ব্যথা পেয়েছেন যে কদিন মুখে টুঁ শব্দটি করতে পারেননি। পরে অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, ছবিতে আর পাক অভিনেতা নৈব নৈব চ। তবে এবারের মতো ছাড় দেওয়া হোক। তাহলে এই যে তিনি বলছিলেন, শিল্পীরা কাঁটাতারের বেড়াতে আটকে থাকেন না। পাক শিল্পীদের ভারতই ভিসা দিয়েছে, তাই কাজ করেছেন তাঁরা। এই যে বলছিলেন, শিল্পীদের ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান নয়, সে সবের কি হল? কী আবার হবে, একটা ছবির পিছনে তিনশো জন ভারতীয় কলাকুশলীদের যে ঘাম-রক্ত মিশে আছে, তা ভাবতে হবে না! আর সেই ভেবেই তো তিনি ছবি-মুক্তি নিয়ে এত কাঁদো কাঁদো ভিডিও বার্তা প্রচার করলেন। তাহলে এই ঘাম রক্তের কথা তিনি আগে ভাবেননি কেন? মনে হয়নি যে, এক ফওয়াদ খানের জন্য এতজনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না? নাকি, বিপদটা তিনি ঠিক আঁচ করতে পারেননি!
আসলে আঁচ করতে না পারাই স্বাভাবিক। কেননা, পাকবিরোধী হাওয়া থেকে থেকেই তো জোরদার হয়। আবার থেমেও যায়। শিবসেনা বা মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ তো প্রায়শই এরকম হুড়ুম দাড়ুম করে। কিন্তু এবার যে এই বিরোধিতা এমন জনগণমন-কথা হয়ে উঠবে কে জানত! ফলত বুদ্ধিজীবী করণ যে প্রসঙ্গ তুলে শিল্পসত্তার সার্বজনীনতায় বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন, তাই ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফওয়াদ খানকে ফিরে বা যেতেই হবে কেন? প্রশ্ন দুই, ফওয়াদ খান ফিরে না গেলেই বা কী ক্ষতি হবে? ফওয়াদ খানকে ফিরতেই হবে, কেননা জনগণ তাই চায়। জনগণ তারাই, যারা প্রধানমন্ত্রীর ১০০ ইঞ্চি ছাতিতে বিশ্বাস করে। জনগণ চায় বলেই, প্রধানমন্ত্রীকে পাকবিরোধী কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ফলাও করে প্রচার করতে হয়। না প্রধানমন্ত্রী নিজে করেন না বটে, কিন্তু কে না জানে বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। তা কেন চায় এমন জনগণ? না, প্রধানমন্ত্রী যখন প্রধানমন্ত্রী হননি, তখন তিনি এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর শতগুণে বলা পারিষদবর্গ সীমান্ত কাল্পনিক কাঁটাতারে সিল করে দিয়ে ইঁদুরের প্রবেশও আটকে দিয়েছিল। এখন ক্ষমতার ফাঁক দিয়ে জঙ্গি ঢুকে পড়বে, তা কী করে হয়! ফলে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তার বিজ্ঞাপনও করতে হয়। অতীতে কি দেশে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি? সে প্রশ্ন গৌণ, কেননা অতীতে কেউ কি বিজ্ঞাপন করেছে! তোমার ঘরে কোন বেদজ্ঞ বসে আছে আমি কী করে জানব, যদি না তুমি বিজ্ঞাপন করো? কিন্তু অমুখদার কোচিং সেন্টারে যে জ্ঞানী মাস্টারমশাই পাশ করানোর গ্যারান্টি দেন সে তো শিয়ালদা স্টেশনে চোখ মেললেই বোঝা যায়। অতএব বিজ্ঞাপন জরুরি। এখন এই বিজ্ঞাপনের ক্ষমতা এতটাই যে জনগণ টপাটপ নিজেদের প্রোফাইল পিকচার জাতীয়তাবোধে ছাপিয়ে নেয়। আর এর অন্যথা কিছু হলেই বলে দূর হটো। অতএব ফওয়াদ খানকে ফিরতে হবে।
আর ভদ্রলোক না ফিরলে কী হত? হ্যাঁ, করণ জোহর যা বলেছিলেন সব সত্যি। সত্যিই পাক অভিনেতাকে ফেরত পাঠানোতেই তো সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু সঠিক সময়ে তিনিও মচকালেন। সত্যিই তো, ফওয়াদ ফিরলেই কী সীমান্তচুক্তি লঙ্ঘন করা বন্ধ করে দিচ্ছে পাকিস্তান? নাকি ভারত সব কূটনৈতিক স্তরে সাফল্য পেয়ে পাকিস্তানকে একেবারে কোণঠাসা করে দিতে পারছে? বরং ফওয়াদ খান ফিরুক আর নাই ফিরুক, চিন-আমেরিকা যে ভারতকে ল্যাজে খেলাচ্ছে সে সত্যি স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। তবু করণ যখন ঢোঁক গিললেনই তখন প্রশ্ন এখানে দুটি। এক, ফওয়াদ খান কি সত্যিই ছবিতে অপরিহার্য ছিলেন? তাঁকে ছাড়া অন্য কোনও অভিনেতাকে দিয়ে ওই একটি চরিত্র ফুটিয়ে তোল সম্ভবই হত না? নাকি, প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বলে ভারত-পাক সম্পর্কের একটা গুডি গুডি ইমেজ ফুটিয়ে তুলতে সুচতুর কাস্টিং করেছিলেন তিনি? তাঁর কথাবার্তায় ও দোসর অনুরাগ কাশ্যপের সওয়ালের জোর থেকে বলা যায়, চরিত্রের অপরিহার্যতার থেকেও এদিকেই জোর ছিল বেশি। হায় পরিচালক! সিনেমা বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপা চায় ঠিকই, তবে সিনেমা শিল্পও বটে। স্রেফ বাণিজ্য তো নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, যদি পাক শিল্পীদের ফেরত পাঠানোয় করণ জোহর বিশ্বাসী নাই হন, তাহলে কেন মেনে নিলেন তিনি? আসলে না মেনে উপায় নেই। এই পুলিশ-প্রশাসনকে তুচ্ছ করে শিবসেনা বা মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাদের বাড়বাড়ন্ত, তা থেকে বাঁচতে আপাতত তাঁকে পিঠে কুলো বাঁধতেই হবে।
এখন শিবসেনাদের এই দাদাগিরি আজ করণ জোহরকে রুখে দিল এবং প্রশাসন ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে দেখেও দেখল না, তাতেই ধন্দ জাগে। আজ যে সবকিছু ফলাও করে বলতে হচ্ছে তার নেপথ্যে যে স্রেফ রাজনীতি আছে তা বলাই বাহুল্য। তা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকেই পুষ্টি জোগাবে। তথাকথিত জনগণের এতে ইতরবিশেষ কিছু হবে না। কিন্তু আজকের এই তোল্লাই দেওয়ার ফল, পরে প্রশাসন সামলাতে পারবে তো? যে গো-রক্ষক বাহিনীকে একদা শাসকদল প্রশ্রয় দিয়েছিল, তারাই একদিন মাথায় চড়ে বসে যে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছিল তা শাসকদল বিলক্ষণ জানে। কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে, মতবাদকে তথা তোল্লাই দেওয়ার ফল যে মৌলবাদের জন্ম দেওয়াই, তা বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতেই স্পষ্ট। তাহলে এই প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তর সম্ভবত একটাই, ওই হাওয়া। হাওয়া যখন যেদিকে ঘোরে সেদিক থেকে ঝুলি ভরে সমর্থনের ধুলো কুড়িয়ে আনা।
আর এসব দেখতে দেখতেই মনে হয় কোথাও যেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনটা দেশপ্রেম, কোনটা নয়! কী করলে নিজের দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন যথাযথ হবে, কী করলেই বা উল্টোটা প্রতিপন্ন হবে? সম্প্রদায়ের প্রতি কোন কাজে একনিষ্ঠ থাকা যাবে, কোন কাজ করলে নয়? সব ধারণা এই মুহূর্তে এক জগাখিচুড়ি অবস্থানে। কতটা পথ পেরলে দেশপ্রেমিক হওয়া যায়, আর কতটা পথ পেরলে তা সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে-সেই সীমারেখা খুব সচেতনভাবেই গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই হাঁসজারু সময়ে তাই সকলেই নিজেকে বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিক ভাবছে। সকলেই নিজস্ব সম্প্রদায়ের প্রতি সৎ থেকে কাজ করছে। আর তার ফল কি দাঁড়াচ্ছে। ফওয়াদ খান নিজের দেশে ফিরে ভালই থাকবেন, করণ জোহররা আবার একটি প্রেম-পরিবার ভাঙা গল্প বলে সবকিছু ভুলিয়ে দেবেন। আর জনগণ? মজারু সময়ে একমাত্র ইঁদুর বেচারাই যে মরবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.