পেরিয়ে গিয়েছে ৩০ বছরের বেশি। তাঁর প্রথম এবং শেষ সিনেমাই ছিল ‘কোনি’। প্রথম ছবির সংলাপ আজও শোনা যায়। সেই ‘কোনি’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল বোসপুকুরে। এক বিকেলে নানা কথায় উঠে এল পুরনো স্মৃতি। শুনলেন নীল।
‘কোনি ফাইট কোনি ফাইট’ এই লাইনটা প্রায় প্রতিটা বাঙালিরই চেনা কিন্তু সেই কোনি অর্থাৎ শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কোথায়? একটা কৌতূহল আমাদের মধ্যে সবসময়ই ছিল, অন্য ছবিতে তাঁকে দেখতে না পাওয়ায়! ঘটনাচক্রে আলাপ হল কিছুদিন আগে। বোসপুকুরের কাছে স্কুল শিক্ষিকার থেকে খোলামেলা কথা বলে জানতে পারলাম পরিচালক সরোজ দে থেকে শুরু করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে নানা কথা।
সালটা ১৯৮২, বয়স কুড়ি কী একুশ, শ্রীপর্ণা তখন যাদবপুরে ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কাটছেন আইএলএসএসএ। একটি পুজো সংখ্যায় তঁার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নের খবরের সঙ্গে ছাপা হয় মতি নন্দীর ‘কোনি’ উপন্যাসটিও। সরোজ দে ‘কোনি উপন্যাসটি পড়েন এবং পাশাপাশি শ্রীপর্ণার সাঁতারের খবরটি দেখে সিদ্ধান্ত নেন এই উপন্যাসটি নিয়ে ছবি বানানোর। সরোজবাবু শ্রীপর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ করে সামনাসামনি দেখা করার কথা বলেন।
[ প্রকাশ্যে হানি সিংয়ের ‘উর্বশী’, মাতালেন কিয়ারা ও শাহিদ ]
কলেজ থেকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে শ্রীপর্ণা দেখেন সরোজ দে আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের বাড়িতে বসে আছেন। যথেষ্ট আধুনিকা শ্রীপর্ণাকে দেখে সরোজ দের যে খুব একটা ভাল লাগেনি সেটা বেশ অনুভব করেছিলেন শ্রীপর্ণা সেই মুহূর্তেই। কোনির চেহারার সঙ্গে সেই সময় কোনও মিল ছিল না শ্রীপর্ণার, সৌমিত্রবাবুও একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু শ্রীপর্ণার মনে তখন ভীষণ ইচ্ছে ছবিতে অভিনয় করার। প্রতিদিন প্রহর গোনেন সরোজ দের ফোনের।
বছর ঘুরে যায়, তারপর একদিন হঠাৎ ফোন এল ছবিতে তাঁকে সিলেক্ট করা হয়েছে। কোনি চরিত্র করার জন্য সরোজ দে অনেক খুঁজেও মনের মতো কাউকেই পাননি। কোনও প্রফেশনাল আর্টিস্টকে দিয়ে এই চরিত্র তিনি করাতে চাননি কারণ একজন সুইমার যেভাবে জলের ব্যাকরণ জানেন অন্য অভিনেত্রীর পক্ষে তা জানা কখনওই সম্ভব নয়। তাই তাঁর কাছেই ফিরে এসেছিলেন সরোজবাবু। ক্ষিদ্দার চরিত্র প্রথমে করার কথা ছিল উত্তমকুমারের, কিন্তু তিনি মারা যান। তারপর নাসিরউদ্দিন শাহকে বলা হয় উনিও রাজি হন কিন্তু শুটিংয়ের ডেট দিচ্ছিলেন শীতকালে। সাঁতারের ছবি শীতে শুটিং করা একটু অসুবিধার বলে তারপর সৌমিত্রবাবুকে বলা হয়। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “আসলে বৃহস্পতি তুঙ্গে না হলে ভাগ্যে যে শিকে ছেঁড়ে না আমি আর সৌমিত্রদা তার প্রমাণ।”
এই ছবি করার আগে অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, তবুও কোনও জড়তা হয়নি অভিনয় করতে গিয়ে সেই কথা নিজে মুখেই জানান শ্রীপর্ণা। সৌমিত্রবাবুও অনেক ভাবে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন অভিনয় বিষয়ে। সেই সময় যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত একজন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তবুও নিজের কাজকে আরও ভাল করতে প্রায়দিনই চলে যেতেন শ্রীপর্ণাদের ক্লাবে। একজন কোচের রোল সঠিক ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য, সেখানে গিয়ে শ্রীপর্ণার কোচ অনিল দাসগুপ্তকে লক্ষ করতেন খুব মন দিয়ে। একজন কোচের চলাফেরা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ–সব তখন তাঁর নখদর্পণে।
শ্রীপর্ণাও চরিত্রের জন্য অনেক খেটেছিলেন, প্রতি মুহূর্তে ভেঙেছিলেন শ্রীপর্ণা থেকে কোনিতে রূপদান করতে। রোদের মধ্যে তেল মেখে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফর্সা রংকে কালো করতে, রাস্তায় পথ চলতে চলতে গরিব মেয়েদের চলাফেরা লক্ষ করতেন নিবিড়ভাবে তারপর যাদবপুরের আধুনিক মেয়েটি কখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ২৬ নম্বর রূপচাঁদ সাহা লেনের বস্তির কনকচাঁপা পাল তা সে নিজেও বুঝতে পারেননি।
প্রথম দিনের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে একটা মজার কথা বললেন হাসতে হাসতে। শ্রীপর্ণা শুটিংয়ে গিয়ে দেখেন সরোজবাবু মাঝের একটি দৃশ্য আগে শুট করছেন দেখে শ্রীপর্ণা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। কারণ শ্রীপর্ণার ধারণা ছিল, যেভাবে আমরা সিনেমা দেখি সেই ভাবেই বুঝি পরপর সিন শুটিং হয়। শ্রীপর্ণার বন্ধুরাও শুটিংয়ের মজা পেতে চলে যেতেন শুটিং স্পটে। যাদবপুরের বন্ধুদের আদরের পজী বন্ধুদের কাছে তখনই রীতিমতো স্টার। শ্রীপর্ণার যাদবপুরের বন্ধু ছিল পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। শ্রীপর্ণা আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনির শুটিং স্পটেই প্রথম আলাপ হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের। শুটিংয়ের অভিজ্ঞতার মুহূর্তগুলো আজও তঁার কাছে ভীষণ ভাবে জীবন্ত। মজা করে শ্রীপর্ণা বলে ওঠেন, “শুটিং চলাকালীন কত কিছু যে হয় সেটা এই ছবিটা না করলে অজানাই থেকে যেত…!”
দু’বছর পর ছবি যখন রিলিজ করে তখন শ্রীপর্ণা পড়া শেষ করে সংসারে মন দিয়েছেন। অনেক পরিচালক তাঁদের ছবিতে অভিনয় করার জন্য শ্রীপর্ণাকে অফার করেন সেই সময় কিন্তু সব কিছু সামলে অভিনয় আর করা হয়নি। আজ আর তঁার কোনও আফসোস নেই পরবর্তীতে ছবিতে অভিনয় না করার। তাঁর স্কুল, সাঁতার, স্বামী, সংসার, বিদেশে থাকা দুই মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় বেশ কেটেই যায় আজকাল। কথা প্রসঙ্গে এক পরম তৃপ্তি নিয়ে বলেন, কোনি তাঁকে অনেক দিয়েছে সারা জীবন ধরে। অনেক ছবি করলে এই ভাললাগাটা হয়তো উপলব্ধি করতে পারতেন না সঠিক ভাবে।
[ তনুশ্রীর অভিযোগ ওড়ালেন নানা পাটেকর, আইনি নোটিসের ভাবনা ]
পথচলতি রাস্তায় আজও কখনও কখনও তাঁকে চিনে ফেলেন মানুষজন, কিছু আবেগ উজাড় করে দেন তারা…! কেউ বলেন, তাঁকে দেখে একদিন সাঁতার কাটা শিখেছিলেন। কেউ আবার শিখেছে কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে জয় করা যায়! তঁার অভিনীত চরিত্র দেখে মানুষের অনুপ্রাণিত হওয়ার থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী বা হতে পারে…! পরম তৃপ্তির সঙ্গে কথাগুলো বলে ফেলেন এক নিশ্বাসে।
জীবনে চলার পথে ব্যক্তি শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে আজও কনকচাঁপা পাল। ক্লান্ত শরীরে বিষণ্ণতার কালো মেঘ যদি তাকে ঢেকে দিতে চায় কখনও তখন বৃষ্টির ফোঁটার মতো ছুটে আসে তাঁর কানে ‘ফাইট, কোনি ফাইট’…
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.