বিশ্বদীপ দে: ভারত ও ইন্ডিয়া। যেন একই দেশের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা দুই সত্তা। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ”এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা।” কেবল কলকাতা শহরই নয়, বৃহত্তর এক প্রেক্ষাপটে দেখলে আমাদের দেশের ভিতরেও যেন লুকিয়ে রয়েছে ভিন্ন সত্তার উপস্থিতি। ‘জয় ভীম’ (Jai Bhim) দেখতে বসলে এই কথাটি একবার না একবার মনে উঁকি মেরে যাবেই। সেনগানি ও রাজাকান্নুদের এই কাহিনি চোখের সামনে ফুটে উঠলে বোঝা যায়, ইন্ডিয়ার আধুনিকতার সমান্তরালে রয়ে গিয়েছে শাশ্বত ভারতবর্ষের এক অন্য দুনিয়াও। যদিও এই ঘটনা গত শতাব্দীর শেষ দশকের। তবু মাঝের এই আড়াই দশকে ছবিটা কি খুব বেশি বদলেছে?
গত ২ নভেম্বর আমাজন প্রাইমে (Amazon Prime) মুক্তি পেয়েছিল ‘জয় ভীম’। তার ঠিক তিন দিনের মাথায় আবির্ভূত হয়েছিল ‘সূর্যবংশী’র। হেলিকপ্টার থেকে অক্ষয় কুমারের নেমে আসার দৃশ্যে হাততালির বান ডেকেছে হলে। রোহিত শেট্টির ‘সুপার কপ’ ঘরানার টিপিক্যাল মশলা মুভি। যেখানে পুলিশ এক অনন্ত ক্ষমতাধর মসিহা স্বরূপ। আশ্চর্য সমাপতন, একই সময়ে মুক্তি পাওয়া অন্য ছবিটিতে সেই পুলিশেরই এক ভিন্নতর রূপ। প্রভাবশালীদের অঙ্গুলিহেলনে আইনকে হেলায় হাতে তুলে নিতে সামান্যতম দ্বিধাও নেই সেই পুলিশকর্মীদের।
তবে কেবল পুলিশি অত্যাচারের কাহিনি নয় ‘জয় ভীম’। রীতিমতো সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ছবির আসল আকর্ষণ কিন্তু নাগরিক সভ্যতা থেকে বহু দূরে অবস্থিত প্রান্তিক ভারতবর্ষের মানুষদের রক্ত-ঘাম-অসহায়তার মরমি আখ্যান। রাজাকান্নু ও সেনগানির সংসারে আসতে চলেছে এক নতুন অতিথি। নিচু জাতের প্রতিনিধি এই দুই মানব-মানবীর নেই কোনও নিজস্ব ভূমি, স্থায়ী আবাস। রাতের অন্ধকারে তাদের নিবিড় মুহূর্তে হঠাৎই ভেঙে পড়ে ঘরের দেওয়ালের একাংশ। তবু, এই নিঃসীম দারিদ্রের মধ্যেও তারা অপেক্ষায় থাকে সুদিনের। স্বপ্ন দেখে একদিন তাদেরও মাথার উপরে থাকবে পাকা বাড়ির ছাদ।
কিন্তু বাস্তবে হয় ঠিক উলটোটা। গ্রামের এক ধনী ব্যক্তির বাড়ি থেকে গয়না চুরির মূল অভিযুক্ত হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ নির্দোষ রাজাকান্নু। নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে ক্রমেই প্রশাসনের উপর চাপ বাড়াতে থাকে সেই ব্যক্তি। আর পুলিশও হন্যে হয়ে খোঁজে রাজাকান্নুকে। তাদের প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা গড়ে উঠতে থাকে দর্শকদের। ছবির শুরুতে প্রান্তিক মানুষগুলির দৈনন্দিন জীবনকে ছুঁয়ে আসেন পরিচালক টি জে নান্নেভাল। আর তাই তাদের সংকটের মুহূর্তে ‘ক্যাথারসিসে’র ধাক্কায় দর্শকমনও বিপন্ন হয়ে পড়তে থাকে।
জেলে রাজাকান্নু, তার ভাই ইরুটাপ্পান ও আরেক সঙ্গী মউসা কুট্টির উপরে প্রবল অত্যাচার চালাতে থাকে পুলিশ। রাজাকান্নুর হদিশ অবশ্য শুরুতে মেলেনি। সে গিয়েছিল দূরের এক গ্রামে ইটভাঁটার কাজে। তাই তাকে না পেয়ে যাকে পায় তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। বাদ যায় না অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সেনগানিও। ছবির দীর্ঘ সময় জুড়েই রয়েছে লকআপে পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহ দৃশ্য। দেখতে দেখতে শিউরে উঠতে হয়। সহ্য করা যায় না। নিঃসন্দেহে সেটাই লক্ষ্য ছিল পরিচালকের।
এরপর এক ভোরে আচমকাই জানা যায়, পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে গিয়েছে রাজাকান্নু, ইরুটাপ্পান, মউসা কুট্টি। তাদের এই রহস্যজনক অন্তর্ধানের পরে সেনগানির চোখের সামনে যখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসতে থাকে, তখন গ্রামের শিক্ষিকা মিথরার সৌজন্যে সে এসে উপস্থিত হয় চন্দ্রুর কাছে। তামিল সুপারস্টার সূর্য অভিনয় করেছেন দাপুটে এই আইনজীবীর ভূমিকায়। হাইকোর্টে ‘হেবিয়াস করপাস’ মামলা দায়ের করে চন্দ্রু। শুরু হয় রাজাকান্নুদের ফিরে পাওয়ার লড়াই।
চন্দ্রু নামের ওই আইনজীবী বাস্তবে এক অসামান্য সফল মানুষ। বিনা পারিশ্রমিকে মানবাধিকার মামলা লড়া চন্দ্রু পরবর্তী কালে মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতিও হয়েছিলেন। ছবিতে চন্দ্রুর সঙ্গে আরেক তামিল সুপারস্টার প্রকাশ রাজ অভিনীত পুলিশ ইনস্পেক্টর জেনারেলের চরিত্রটির মধ্যে হওয়া কথোপকথনগুলি ছবির বাড়তি আকর্ষণ। তবে এই ছবিতে সবথেকে বেশি নজর কাড়েন সেনগানির ভূমিকায় লিজোমল জোসে। ছবির শুরুতে স্বামীর সঙ্গে কাটানো নিবিড় মুহূর্তগুলির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে মরিয়া ও বিষণ্ণ সেনগানির ফারাকটা স্পষ্ট নজরে আসে।
ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যে বাণিজ্যিক ছবির মেজাজ ফুটে ওঠে। যেমন চন্দ্রুর আবির্ভাবের মুহূর্তে যেভাবে ব্যারিকেড টপকে তাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়, তা যেন ছবির চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। এমন মুহূর্ত আরও আছে। কেবল সেই অংশগুলি বাদ দিলে ছবিজুড়ে রক্তমাংসের ভারতের মর্মবেদনা জলছবির মতো ফুটে থাকে। সম্পাদনা হোক কিংবা সিনেমাটোগ্রাফি, ‘জয় ভীম’ সর্বত্রই নিখুঁত। এ ছবি ভাবতে বাধ্য করে। বাধ্য করে ছবিশেষে চুপ করে বহুক্ষণ বসে থাকতে। যে কোনও সৎ ছবিরই যা প্রধান শর্ত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.