ছেলেবেলায় ভেবেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হবেন। নকল করে গাইতেন তাঁর গান। বড় হয়ে তাঁকেই পেয়েছিলেন বড় দিদি হিসেবে। একদা এক স্মৃতিচারণায় ধরা পড়েছিল সেই সম্পর্কের রসায়ণ। কয়েকবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন বনশ্রী সেনগুপ্ত (Banashree Sengupta)। এবার চলে গেলেন তাঁর ‘বড়দি’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও। রইল সেই স্মৃতিকথার পুনর্মুদ্রণ।
পাঁচের দশক তখন শেষ হব হব। সেই সময় বিনোদনের দুনিয়ায় রেডিওর একচেটিয়া আধিপত্য। আকাশবাণীর অনুরোধের আসরের TRP তখন কলকাতার সঙ্গে সঙ্গে জেলাতেও ঊর্ধ্বগামী। তখন তো আর এখনকার মতো স্লিম অ্যান্ড ট্রিমের যুগ আসেনি। হুগলির চুঁচুড়ায় আমাদের বাড়ির দালানে রাখা থাকত এক ঢাউস রেডিও। আমি অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandhya Mukherjee) গান শুনব। তখন আমার প্রতিটি সন্ধ্যা ছিল সন্ধ্যাময়। তাঁর কিন্নর কণ্ঠের গান শুনে একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ওঁকে কেমন দেখতে জানতাম না। গান শুনতে শুনতেই স্বপ্ন দেখতাম, আমিও একদিন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হব।
কিশোরী বয়সে তো রীতিমতো ওকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। তারপর HMV শারদ অর্ঘ্যে ওঁর ছবি দেখলাম। গানের সঙ্গে সঙ্গে সাজপোশাকেও ওঁর প্রভাব পড়ল। ঠিক ওঁর মতো করে হাতখোঁপা, অথবা দু’টো বিনুনি, হালকা রংয়ের তাঁতের শাড়ি – এটাই আমার কাছে ক্রমশ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে উঠল। গানে হতে না হতে পারি, দেখতে তো ওঁর মতো হলাম!
আমাদের বাড়িতে বেশ গানের চর্চা ছিল। বাবার নির্দেশ ছিল শাস্ত্রীয় সংগীত ভাল করে শিখে তারপর আধুনিক গানের চর্চা করা। এদিকে আমি তো ঠিক করেই ফেলেছি যে গান করলে শুধু আধুনিক গানই করব, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandhya Mukherjee) মতো। ওদিকে বাড়িতে বাবার কড়া ফতোয়া। আমার বাবা ছিলেন কবিরাজ। সোম, শুক্র চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় যেতেন রোগী দেখতে। সারা সপ্তাহ এই দু’টো দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকতাম। বাবা বেরিয়ে গেলেই সব ভাই-বোন মিলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়তাম। তারপর আমাদের সারা বাড়িটাই একটা অনুরোধের আসর। তখন আর আমার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হওয়া আটকায় কে! আমরা যাতে বাবার কাছে ধরা না পড়ি, মা বাবাকে বলেছিলেন বাড়িতে ঢোকার আগে ড্রাইভারকে হর্ন দিতে বলতে। আমরা তাহলে আগে থেকে দরজা খুলে রাখতে পারব। এতে তো আমাদের খুব সুবিধা হল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
একদিন ঠিক ধরা পড়ে গেলাম। সেদিন বাড়ির চেম্বারে রোগী দেখছিলেন। আমি নিষেধাজ্ঞা ভুলে হঠাৎ খোলা গলায় ‘মায়ামৃগ’ সিনেমার ‘বকম বকম পায়রা’ গানটা গেয়ে উঠি। অবধারিতভাবে সেটা বাবার কানে গেল। চেম্বার ছেড়ে বাবা উপরে উঠে এলেন। আমি তো ভয়ে আধমরা। কিন্তু ওমা! বাবা আমার গানের বেশ তারিফই করলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে উপদেশ, আগে শাস্ত্রীয় সংগীত, তারপর অন্য কথা। আমার বিয়ের আগেই বাবা মারা গেলেন। ভয় ছিল বিয়ের পর বোধহয় আমার গান বাজনা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু স্বামীর উৎসাহে আমি পেশাদার গানের জগতে পা রাখলাম।
১৯৬৫ বা ১৯৬৬, সালকিয়া ব্যায়াম সমিতির অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছি। ওখানে আমি ছাড়াও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান গাওয়ার কথা। আমি একদম নবীন শিল্পী। অনুষ্ঠান শুরুর আগে গ্রিন রুমে বসে আছি। হঠাৎ একজন এসে বললেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। গেলাম ওনার কাছে। স্বপ্নের গায়িকার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তো উত্তেজনায় কাঁপছি। সন্ধ্যাদি আমার গানের প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “তুমি গ্রিন রুমে বসে আছো কেন? অনুষ্ঠানের আগে ওখানে থাকলে গানে কনসেনট্রেট করা যায় না। একান্তই যদি অন্য কোথাও জায়গা না পাও, গাড়িতে বসে থাকবে। দেখবে এতে মঞ্চে উঠে গান গাইতে সুবিধা হবে।” সেদিনের পর থেকে এই উপদেশ আমি সারাজীবন ফলো করে এসেছি। সেই প্রথম আলাপেই উনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় থেকে আমার কাছে সন্ধ্যাদি হয়ে গেলেন।
এমন বড় মাপের শিল্পী যে এত ডাউন টু আর্থ হতে পারে, তা সন্ধ্যাদিকে না দেখলে বোঝাই যায় না। কী অমায়িক ব্যবহার, জোরে কথা বলা একদম পছন্দ করতেন না। আমাদের সবাইকেও ধীরে ধীরে কথা বলতে বলতেন। দিদি সবসময় শেখাতেন, কন্ঠস্বর ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পদ। তাকে কেন অবহেলা করবে? ওঁর লেকগার্ডেন্সের বাড়িতে প্রথমবার গিয়ে আমি অভিভূত। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও কতটা সুচারুভাবে সংসারের সব কাজ পরিচালনা করেন। সন্ধ্যাদি ফল খেতে খুব ভালবাসতেন। ওঁর বাড়ির ডাইনিং টেবিলের উপর প্রচুর ফল রাখা থাকত। দিদি বলতেন, মরশুমি ফল খেলে শরীর ভাল থাকে আবার গলারও উপকার হয়। একবার জন্মাষ্টমীতে দিদি আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছেন। কী সুন্দর ওনার ঠাকুরঘর।
দিদির কথা কত বলব? আমি তখন লেক মার্কেটে থাকি। একদিন সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে ঢুকটাক বাজার করছি। একজন এসে বললেন, দিদি আপনাকে ডাকছেন। আমি তো অবাক! কে আমায় ডাকল? দেখি, সন্ধ্যাদি গাড়ির কালো কাচ নামিয়ে আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, ”এখানে কী করছ?” উত্তর দিলাম, ”একটু বাজার করছি।” প্রতি উত্তরে, দিদি বললেন, “ধর তোমার পাড়ায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। যেখানে উদ্যোক্তারা তোমায় ডেকে এভাবে পরিচয় করিয়ে বলবে যে বনশ্রীদিকে আমরা রোজই দোকান-বাজার করতে দেখি। সেটা তোমার ভাল লাগবে? নাকি যদি বলেন বনশ্রীদি খুবই ব্যস্ত আমাদের সঙ্গে দেখাই হয় না। সেটা ভাল লাগবে? সবসময় একটা দূরত্ব বজায় রাখবে। তাহলে দেখবে লোকে তোমার কদর করছে।”
গান করার সময় ছোটবেলায় ওঁকে নকল করতাম। কিন্তু পরে সুধীন দাশগুপ্ত, প্রবীর মজুমদারের কাছে শিখতে গিয়ে বুঝলাম। নিজের স্বকীয়তা ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না। তাঁদের কথা শুনেছি বলেই আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি। নইলে হয়তো সন্ধ্যাকণ্ঠী হয়েই থেকে যেতাম। তবে আমার বনশ্রী সেনগুপ্ত হওয়ার নেপথ্যে সন্ধ্যাদির প্রভাব ও আশীর্বাদ অনস্বীকার্য। আমাদের ফুল, জল, মেঘ, বৃষ্টি দিনের দিবারাত্রির, শ্রাবণ সন্ধ্যার পর জেগে ওঠা রোদ ঝলমলে কি মিষ্টি ছিল সেই “সোনা ঝরছে, ঝরে পড়ছে’র দিনগুলি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.