বিশ্বদীপ দে: কলকাতার আকাশ আজ অংশত মেঘলা। গতকাল রাতের বিষাদ তিলোত্তমার মুখে জড়িয়ে গিয়েছে ধোঁয়াশার মতোই। মনখারাপ কি শুধু কলকাতার? না। গোটা দেশ তথা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই যাঁরা হিন্দি গান তথা বলিউডের সংগীতের অনুরাগী, তাঁদের সকলের হৃদয় আজ পাষাণভার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারই প্রতিফলন। ছড়িয়ে পড়েছে কেকে’র (KK) শেষ অনুষ্ঠানের ভিডিও। পরপর দু’দিন যে মানুষটা এমন আনন্দ দিলেন এত মানুষকে, সেই তিনিই মঙ্গলবাসরীয় রাতে হঠাৎই ‘নেই’ হয়ে গেলেন! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই মৃত্যুর অভিঘাতে সর্বত্রই শোকের কালো রঙের পোঁচ।
কেকে। পুরো নাম কৃষ্ণকুমার কুন্নথ। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩। যিনি গেয়েছিলেন, ‘হাম রহে ইয়া না রহে ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’। সেই গানে মুহূর্তের যে উদযাপন, সেটাই হয়ে রইল তাঁর এপিটাফ। নজরুল মঞ্চে এই গানই যে ছিল তাঁর শেষ নিবেদন। কী অদ্ভুত সমাপতন!
১৯৬৮ সালে দিল্লিতে জন্ম কেকে’র। শুরুটা খুব মসৃণ ছিল না তাঁর। বলিউডে প্লেব্যাকের সুযোগ মোটেই সহজে আসেনি। হিন্দি সিনেমায় গান গাওয়ার আগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল গেয়েছেন। একসময় মার্কেটিংয়ের কাজও সামলেছেন। প্লেব্যাকের প্রথম সুযোগ বিশাল ভরদ্বাজের সঙ্গে। ‘ছোড় আয়ে হাম উও গঁলিয়া’। সেখানে অবশ্য অনেকের সঙ্গে গলা মেলানো।
প্রকৃত অর্থে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয় ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ ছবির ‘তড়প তড়প কে’ গানের মাধ্যমে। ওটাই কেকে’র প্রথম সোলো প্লেব্যাক। আর তাতেই কী অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ! ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘পল’ অ্যালবামটিও। আটের দশকে যাঁদের জন্ম, তাঁদের কৈশোর অথবা তারুণ্যের প্রথম দিকের সময় সেটা। ‘পল’ গানটি ছাড়াও ‘ইয়ারো’ গানটি সেই সময় স্কুলের টিফিনবেলা থেকে কলেজ ক্যান্টিনে একরকম লুপে গাওয়া হত। প্রেম, বিষাদ, বন্ধুত্বের আশ্চর্য মিশেলে এই গান সহজেই স্পর্শ করেছিল তরুণ, তরুণীদের হৃদয়। এরপর ক্রমেই দীর্ঘ হয়েছে কেকে’র গাওয়া স্মরণীয় গানের সংখ্যা। ‘রোগ’ (২০০৫), ‘গ্যাংস্টার’ (২০০৬), ‘উও লমহে’ (২০০৬), ‘ওম শান্তি ওম’ (২০০৭), ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ (২০০৭) থেকে শুরু করে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ (২০১৪),’বজরঙ্গি ভাইজান’ (২০১৫)… তালিকা বিরাট। এই সব ছবিতে একাধিক হোক বা স্রেফ একটি গান- কেকে’কে তাঁর কবজির মোচড়ে বল ফেলেছেন গ্যালারিতেই।
আসলে গান তো অনেকেই করেন। সুর, তাল, লয়ের নিখুঁত প্রয়োগে মুগ্ধও করে ফেলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যাঁরা থেকে যান হৃদয়ের কাছাকাছি, তাঁদের সমীকরণ আসলে অন্য। তাঁরা হয়ে ওঠেন ‘ব্যক্তিগত’ সঙ্গী। কেকে ছিলেন তেমনই একজন। তাঁর মৃত্যুর খবর তাই যেন কোনও নিকট বন্ধুর প্রয়াণ সংবাদের মতো বুক কাঁপিয়ে দেয়।
কুমার শানু, উদিত নারায়ণরা যখন বলিউড কাঁপাচ্ছেন, সেই সময় কেকে’র উত্থানের পিছনে আসলে মূল ফ্যাক্টর ছিল তাঁর গলার তারুণ্য ও ব্যতিক্রমী মেজাজ। সেটাই তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিল। শান কিংবা সোনু নিগমের মতোই নতুন প্রজন্ম সেই কণ্ঠস্বরেও খুঁজে পেয়েছিল নিজেদের সময়ের স্পন্দন। ‘ইয়ারো’ যেমন বলে বন্ধুত্বের কথা, তেমনই ‘তু হি মেরি শব হ্যায়’ গানে প্রেমের সোচ্চার ঘোষণা। আবার ‘সচ কহে রাহা হ্যায়’ গানে প্রেম ভাঙার যন্ত্রণা। ‘তড়প তড়প কে’ গানে সেই ভগ্ন হৃদয়ের আরও মর্মান্তিক এক ট্র্যাজেডির সুর। কৈশোর, তারুণ্যের প্রায় সব আবেগই ধরা পড়েছিল তাঁর গানে। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে হোক কিংবা একলা ছাদের নির্জনতায়, সেই সব গানের আবেদন রয়ে গিয়েছে অমোঘ মাইলফলক হয়ে। কত স্মৃতি, হারিয়ে ফেলা জড়িয়ে মড়িয়ে রয়ে গিয়েছে আজও। তাই এই ২০২২ সালেও হঠাৎই ইউটিউবে লুপে বাজতে শুরু করে দেয় এরই কোনও একটা।
সময় বদলেছে। সেদিনের তরুণ, এমনকী কিশোরও আজ জীবনের অন্য এক পর্বে। কিন্তু ফেলে আসা প্রেম বা বন্ধুত্বের স্মারক হয়ে আজও হয়ে রয়েছে সেই সব গান। গায়ক কেকে, আসমুদ্রহিমাচলকে নিজের কণ্ঠে জয় করে ফেলা কেকে ঠিক সেই অর্থে নয়, তাঁদের কাছে কেকে’র মৃত্যু সবচেয়ে আগে নিজেদের জীবনেরই একটা অংশকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। আজ তাই লুপে বেজে চলতে থাকা কেকে’র সেই সব গান আসলে প্রয়াত শিল্পীর স্মৃতিচারণই কেবল নয়, নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিকেও আরেকবার ফিরে দেখাও বটে। কেকে চলে গিয়েছেন। যেতে যেতে তাঁর গানটি গিয়েছেন ফেলে। সেই গান হারাবে না। নিজের ফেলে আসা দিন কখনও হারাতে পারে?
দেখুন ভিডিও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.