সন্দীপ্তা ভঞ্জ: সিনেমা নয়, যেন আস্ত মনস্তত্ত্বের পাঠ দেন শিবু-নন্দিতা। আম দর্শকের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে শিবু-নন্দিতা যে বেজায় সিদ্ধহস্ত, তা এযাবৎকাল তাঁদের কাজই বাতলে দিয়েছে। ফ্রেমে বাস্তব প্রেক্ষাপট ধরতে উইন্ডোজ জুটির কলম-ক্যামেরা বরাবরই সাবলীল। বক্সঅফিসের নম্বরের প্রতিযোগিতা নেই।
টেলিভিশন, বড়পর্দা মিলিয়ে ২৫ বছরের পার্টনারশিপ। ২০১১ সালে ‘ইচ্ছে’র শুরু টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ার সেই হিট মেশিন এখনও অব্যাহত। তাঁদের ফিল্মোগ্রাফির উপর চোখ রাখলে বোঝা যায় যে, শিবু-নন্দিতার প্রত্যেকেটা ছবিই সমাজের আস্ত বাস্তব দলিল। আর USP? সিনেমার জটিল ব্যাকরণের ধাঁধায় না গিয়ে সহজ-সরল ন্যারেটিভই পরিচালকদ্বয়ের সম্বল। অতিনাটকীয়তা, কাকতালীয় বিষয়, যুক্তিবুদ্ধির মারপ্যাঁচ বর্জিত আবেগঘন দৃশ্যায়ণ। যা দেখে বক্সঅফিসের মার্কশিটেও ফুলমার্কস বসিয়ে এসেছেন দর্শকরা।
খবরের কাগজে পরা কোনও প্রতিবেদন হোক কিংবা লোকমুখে প্রচারিত কোনও গল্প, সেসবের মজ্জায় ঢুকে বরাবর কন্টেন্ট সাজিয়ে আসছেন শিবু-নন্দিতা। উইন্ডোজ-এর প্রতিটি কাজে কন্টেন্টই আসল ‘কিং’। আসলে বাড়ির বা আশেপাশের গল্প যখন রুপোলি পর্দায় ম্যাজিক তৈরি করে, তা উপভোগ করতে যে দর্শকরা বারবার হলমুখো হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাই কলকাতা টু মফঃস্বল সব হলেই হাউজফুল বোর্ড ঝোলাতে সক্ষম তাঁরা গত ১২ বছর ধরে।
কেষ্টপুর খাল দুর্ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১২ সালে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবির মাধ্যমে যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মরচে ধরা সিস্টেমকে, এগারো বছর বাদে গিয়েও সেই ছবি আর তার ভাবনা যে আজও প্রাসঙ্গিক, তার উদাহরণ সম্প্রতি বেহালার বাস দুর্ঘটনা।
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের (Shiboprosad Mukherjee) মন্তব্য, “কেষ্টপুর খালে বাস পড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা আমাদের নাড়া দিয়েছিল। সেখান থেকেই ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিটার ভাবনা। আজও সেই অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে আসছে। সেইসময় কোর্টে রায় দেওয়া হয়েছিল ১৫ বছরের পুরনো বাস কলকাতা শহরে চলবে না। সেটাও ‘অ্যাক্সিডেন্ট’-এ ছিল। তাপ্পি মারা টায়ারেই যে বাস চলছে, সেকথাও ওই সিনেমায় বলা হয়েছিল।”
কাট টু ‘মুক্তধারা’। সংশোধনাগারের আবাসিক, যাঁরা সমাজের চোখে অপরাধী, সেই মানুষগুলোকে ‘কালচার থেরাপি’র মাধ্যমে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন শিল্পী অলকানন্দা রায়। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে সঙ্গী করে সেই গল্প ফ্রেমে ধরলেন শিবু-নন্দিতা। পর্দায় ‘বাল্মিকী প্রতিভা’র ম্যাজিক দেখলেন দর্শকরা। বড় আবিষ্কার নাইজেল আকারা।
‘রামধনু’ ছবিটাও বাস্তবের ঘটনা। ভাল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর জন্য সন্তানদের ইঁদুরদৌঁড়ে শামিল হতে বাবা-মায়েদেরও যে স্কুলে ভরতি হয়, সেকথা সেইসময়ে অনেকেই জানতেন না। অভিভাবকদের গ্রুমিং স্কুলের কথা জানতে পেরেই মজার মোড়কে ‘রামধনু’ তৈরি করে ফেললেন পরিচালকজুটি।
২০১৭ সালে তৈরি হল ‘পোস্ত’। কলকাতা হাইকোর্টে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে চলা মামলায় সাত বছরের নাতনিকে কাস্টডি দেওয়া হয়েছিল দাদু-দিদার কাছে। জন্ম দিলেই যে আসলে অভিভাবক হওয়া যায় না, সেই সারা ফেলে দেওয়া কোর্টের রায় ‘পোস্ত’র মাধ্যমে সিনেপর্দায় দেখালেন শিবু-নন্দিতা। বাংলা পেরিয়ে সেই ছবি ইতিমধ্যেই বলিউড যাত্রা করে ফেলেছে। যেখানে পরেশ রাওয়ালের মতো দক্ষ অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিনশেয়ার করে বলিউড ডেবিউ করছেন মিমি চক্রবর্তী।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে ক্যালকাটা ওয়াকসের ঋত্বিক চক্রবর্তীর নামে জনৈকর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উইন্ডোজ জুটি বানিয়ে ফেললেন ‘প্রাক্তন’ ছবিটা। বুম্বা-ঋতু জুটিকে ফিরে পেয়ে বাঙালি দর্শক দলে দলে হল ভরালো। ‘মোটা ম্যাগি’ আর ‘লুচি-পুরি’র সেই দুষ্টু-মিষ্টি গল্প ‘হামি’ও দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত স্কুলের ঘটনা অবলম্বনে তৈরি।
ল্যারিঞ্জিক্যাল ক্যানসারে আক্রান্ত বিভূতি চক্রবর্তীর বেঁচে থাকার লড়াই শিবু-নন্দিতার হাত ধরে দক্ষিণী সিনেইন্ডাস্ট্রিতে হয়ে উঠল বাংলাছবির ‘কণ্ঠ’। মারণরোগে আক্রান্ত হয়ে কণ্ঠনালী বাদ পড়া এক ব্যক্তি কীভাবে খাদ্যনালীকে হাতিয়ার করে কথা বলা শুরু করেন এবং শুধু তাই নয় অসংখ্য মানুষের কণ্ঠ হয়ে ওঠেন, সেই ঘটনাও বাংলা কেন গোটা দেশকে উপহার দিল উইন্ডোজ। দমদমের বাসিন্দা পবিত্র চিত্ত নন্দী এবং তাঁর স্ত্রী গীতা নন্দীর জীবনচর্যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নন্দিতা-শিবপ্রসাদ বানালেন ‘বেলাশুরু’। এবার ‘রক্তবীজ’-এর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ২০১৪ সালে বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে দুর্গাষ্টমীর দিনের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেই গল্প দর্শকদের জন্য পুজোর উপহার হিসেবে তুলে রেখেছেন তাঁরা।
তবে শুধু পরিচালকের আসনে বসেই নন, প্রযোজনার ক্ষেত্রেও বাস্তবের গল্পেই জোর দিয়েছেন শিবু-নন্দিতা (Nandita Roy) জুটি। তার উদাহরণ ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’,’লক্ষ্মীছেলে’র মতো ছবিগুলো। আমজনতার ঘরের লোক হয়ে ওঠার শুরু সেই ‘জনতা এক্সপ্রেস’-এর হাত ধরে, আজও কন্টেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিচালকজুটির কাছে জনতাই জনার্দন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.