রেডিও ছাড়ার পরও তাঁর জার্নি অনন্য। মীর আফসার আলির সঙ্গে কথোপকথনে শম্পালী মৌলিক।
এই মুহূর্তে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ আপনার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে। একটু কি স্বস্তিদায়ক বোধ হচ্ছে?
হ্যাঁ, ভীষণ। কারণ যবে থেকে শুরু করেছিলাম তবে থেকে একটাই লক্ষ্য ছিল– মানুষকে ভালো গপ্পো শোনানো। আর তখন অত ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার্স-এর দিকে মন ছিল না। কারণ, শূন্য থেকে শুরু করছি, একটু একটু করে বাড়ছিল। তখন যদি অনবরত ভাবতাম যে, কতজন সাবস্ক্রাইবার হল, তাহলে এটা হত না। যে কোনও ইউটিউব চ্যানেলের ক্ষেত্রে সাধারণত মানুষ এটাই চায়। যত সাবস্ক্রাইবার বাড়বে তত বেশি ইনকাম ইত্যাদি। আমার সিঙ্গল ফোকাস ছিল যে, আমাকে বিভিন্ন স্বাদের গল্প পরিবেশন করতে হবে। যে কারণে, ‘গপ্পোমীর-এর ঠেক’ নামটা দেওয়া। মানুষের যে ভালো লেগেছে, সেইটা ট্রান্সলেট হয়েছে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যায়। এমন নয়, লোকজন হুড়মুড়িয়ে সাবস্ক্রাইব করেছে। প্রথমে লোকে কনটেন্টটা ভালোবেসেছে। আমার মনে হয়, প্রত্যেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরের জন্য এটাই মানদণ্ড হওয়া উচিত, আগে কনটেন্ট রেগুলারাইজ করব। সাবস্ক্রাইবারের অভ্যাসে পরিণত করব, তারপর বাকিটা এমনিই হবে। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
‘মীর’ একটা ব্র্যান্ড হলেও, রেডিওর সিকিওর চাকরি ছেড়ে এটা শুরু করেছিলেন, যেটা সহজ ছিল না। ফিরে তাকালে কেমন লাগে?
কোভিডের সময় সবারই প্রচণ্ড সেটব্যাক হয়েছিল। তারপর থেকে চাকরি আঁকড়ে থাকাটা প্রায়োরিটি হয়ে গিয়েছে সবার জীবনে। আপাতত কোভিড বিদায় নিয়েছে। তারপর থেকে সবাই হিসাব করল যে, কার কার চাকরি থাকল, আর কার থাকল না। আমার তো থেকে গিয়েছিল। আমার খুশি থাকা উচিত ছিল। যে আরও বেশকিছুদিন বহাল তবিয়তে কাজ করে যেতে পারব। কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল, একটা জায়গায় স্ট্যাগনেট করে গেলে, ব্র্যান্ড মীর আফসার আলির জন্য খুব একটা ভালো হবে না। সেই কারণে রেডিওর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বেরিয়ে আসব। প্র্যাকটিকালি ছয় থেকে আটমাস আমার কোনও উপার্জন ছিল না চাকরি ছাড়ার পর। চাকরি নেই, এদিকে সংসার আছে।
অর্থচিন্তা হবেই, যত বড়লোকই হোন না কেন…
অর্থচিন্তা যেকোনও মানুষেরই সবসময় থাকে। সে যতই এস্টাবলিশড হোক। হয়তো অনটনের জায়গায় আমি চলে যাইনি কিন্তু চিন্তাটা ছিল।
মাস গেলে টাকার দরকার সকলের।
একদম। আমি চাকরি ছাড়তে পেরেছিলাম এবং যে প্রোডাক্টে বিশ্বাস করি, সেটা বানাতে পেরেছিলাম বলে গর্বিত। আর লোকের জন্য সেটা পরিবেশন করতে পেরেছিলাম, যেমনটা তাঁরা চান সেইভাবে। সেখান থেকে আজকেও যে বিরাট রোজগার করতে পারছি তা কিন্তু নয়। রেডিও করে যে টাকা পেতাম, তা পাই না। কিন্তু নানারকম ইভেন্টস করি, সঞ্চালনা করি, সেখান থেকে টাকা আসে। অন্যান্য সোর্স থেকে যে টাকা উপার্জন করি, সেটা আমি ঢেলে দিচ্ছি ‘গপ্পোমীর-এর ঠেক’-এ। এটা খুব আনন্দের বিষয়। ব্যবসায়িক ভাষায় যাকে বলে ‘ব্রেক ইভেন’, ১৪ মাস হওয়ার অনেক আগেই সেটা আমি করতে পেরেছি। তাই সেই চিন্তা আমার নেই। এখন প্রোজেক্টটা নিজেই নিজেকে ফিড করবে। চাকরি ছেড়ে আমার সমস্ত টাকা, প্রয়াস এটাতেই দিয়েছিলাম। বেস্ট রিসোর্সেস হায়ার করেছি। এতজন সেলিব্রিটি কাজ করেছেন ‘গপ্পোমীর-এর ঠেক’-এ। সবটা নিজে হ্যান্ডল করেছি। স্পনসর পরে এসেছে, যখন তারা দেখেছে প্রোডাক্টের মধ্যে সম্ভাবনা আছে। শুরুতে আমি কোনও স্পনসরকে অ্যাপ্রোচ করিনি। ভেবেছিলাম আগে পাঁচ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার হোক। তারপর অনেকে এসেছেন, কেউ চলেও গেছেন। আমি খুশি এই জন্য যে, ‘গপ্পোমীর-এর ঠেক’-এর বাইরে যা করছি তার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এখানে লাগিয়ে ব্র্যান্ডটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।
প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারের সমর্থন তো ভীষণ জরুরি ছিল।
ভীষণ-ই জরুরি ছিল। যখন রেডিও ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমার স্ত্রী সোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এই সিদ্ধান্তটা কি নিতে পারি? কারণ, নিজের প্যাশনে এমন কিছু করতে চাই, যেটা অনেকবছর পর্যন্ত মানুষ শুনবে। এবং থেকে যাবে, যেদিন হয়তো আমি থাকব না। মাই ওয়াইফ ওয়াজ ভেরি সাপোর্টিভ। আমরা ওয়ার্কিং কাপ্ল। দুজনেই চাকরি করতাম। এখন একজন নিজের বিজনেস করছে। আমিও অন্ত্রেপ্রেনর, বিজনেস করছি। আমার কোম্পানি ‘নির্বাণা’ ২০১১-’১২ থেকে রয়েছে, কিন্তু সেই নিজের কোম্পানির জন্য এতদিন কিছু করে উঠতে পারিনি। গত ১৪ মাসে সেই কোম্পানির মাধ্যমে ‘গপ্পোমীর-এর ঠেক’ দাঁড় করাতে পেরেছি। এর পিছনে প্রধান কারণ এটাই যে, আমার ওয়াইফের ফুল অন সাপোর্ট ছিল। ওকে কনভিন্স করানোর জন্য আমাকে বাড়তি কোনও এফর্ট দিতে হয়নি। কারণ, আমার পরিবার বিশ্বাস করেছিল, নিজের সাহসে আমি এটা দাঁড় করাতে পারব।
কনটেন্ট এখন অনেকেই ক্রিয়েট করছেন। প্রচুর ইউটিউব চ্যানেল গজিয়ে গেছে। আপনি বাংলা সাহিত্যকেই বেছে নিলেন কেন?
কারণ, রেডিওতে কাজ করার সময় বাংলা সাহিত্য থেকেই নানা মণি-মাণিক্য পড়তাম। জানতাম, আমার গলায় গল্প শুনতে মানুষ ভালোবাসেন। আমার থেকে অনেক বিদগ্ধ কথক রয়েছেন। কিন্তু আমি তাঁদের অনুসরণ করতে চাইনি। কিছু শ্রুতিনাটক বা অডিও প্রেজেন্টেশন-এ সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনি। এখন আমার কাছে ‘গপ্পোমীর-এর’ জন্য নানারকম ইভেন্টের অফার আসছে। কিন্তু প্রথমে আমি এইগুলো করিনি, আগে ব্র্যান্ডটা এস্টাবলিশ করেছি। ফিডব্যাক পাই, বাংলা বই পড়ার সময় বা আগ্রহ আজকের প্রজন্মের কমে আসছে। তাদের কাছে প্রোডাক্টটা কী করে পৌঁছে দেব? যদি বিশ্লেষণ করি দেখব, ১৮-২৪ যাদের বয়স, তারাই সবচেয়ে বেশি শুনছে ‘গপ্পোমীর’।
তাই?
হ্যাঁ, আমিও অবাক হয়েছিলাম। তারা কিন্তু গল্প পড়তে অতটা আগ্রহী নয়। কারণ, সময় নেই বা বঙ্কিমের ভাষায় দাঁত ফোটাতে পারে না। এক্ষেত্রে আমার কনজিউমার বা শ্রোতাদের এই পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সহজ-সরল পথ ধরা দরকার ছিল। এই প্রজন্ম যথেষ্ট সেন্সিবল, তাদের গল্প শুনতে আগ্রহ আছে। এবারে আসছে ২৪টা নতুন গল্প। নতুন স্লেট দেখে অনেকে বলেছে, ‘এই গল্পটা তো আমাদের সিলেবাসে আছে। কত তাড়াতাড়ি এটা আসবে? বা আমার তো পরীক্ষা আছে। আগে শুনে নিলে ভালো হত।’ অর্থাৎ ক্লাসের পড়া না ধরতে পারলেও, নাট্যরূপ শুনলে সড়গড় লাগছে তাদের।
আপনি অনেককিছু করেছেন। রেডিও পার্সন, সংবাদ পাঠক, স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান রূপেও অবতীর্ণ হয়েছেন। আগামী দিনে নিজেকে কীভাবে দেখতে চান?
কোনও ইমেজ থেকেই সরে যেতে চাই বলব না। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে আমাকে পেয়েছেন। আমি হচ্ছি সেই কেটারারের মতো, যে সব ধরনের ডিশ সার্ভ করে। তিনটে ভেজ, চারটে নন ভেজ, ডাল, পোলাও সব সার্ভ করি। তারপর মানুষ খেতে এসে বলবেন, পনিরটা ভালো হয়েছে কিন্তু মাংসটা মিস কোরো না। আমিও সংবাদ পাঠক মীরকে পরিবেশন করেছি, কখনও মীরাক্কেলের কমেডিয়ান মীরকে, কখনও রেডিও মীরকে, আবার কখনও স্টোরি টেলার মীরকে বা অভিনেতা মীরকে। এবার মানুষ কখনও এসে বলেছেন, মীরাক্কেল বন্ধ করবেন না বা রেডিও-ই আপনার জায়গা। রেডিও ছাড়বেন না। আমি সবকিছু সার্ভ করেছি। মানুষ পছন্দটা বেছে নিয়েছে। সো শেফ বলো, কেটারার বলো, একই মীর আফসার আলি। নানা মানুষ নানা সময়ে কনজিউম করে নানা অনুভূতি জানিয়েছেন। আমি কোনও ডিশ বন্ধ করব না কিন্তু স্টোরি টেলিংকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। বিদেশের বাঙালির কাছে আরও বেশি পৌঁছতে চাই, যাদের কাছে বাংলা বই পৌঁছতে চাপ হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়ে না। অথচ নববর্ষ, দুর্গাপুজো উদযাপন করে, বাড়িতে ডাল-ভাত খায়, অর্থাৎ বাঙালি অভ্যাসগুলো একই আছে। তাহলে বাংলা বইয়ের জনপ্রিয়তা কেন কম হবে? আমি বিশ্বাস করি, বাংলা বইয়ের কাটতি আছে এবং থাকবে। বিদেশের বাঙালি, যাঁরা শুধু অনলাইনে এই ধরনের অডিও স্টোরিজ-এর স্বাদ পান তাঁদের ট্যাপ করা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। যে বাইরে থেকেও তাঁরা এভাবে বাংলার স্বাদ পেতে পারেন। বিশ্বাস করি বাংলা কনটেন্টের খিদে আছে বলেই তো বিদেশে এত ফেস্টিভ্যাল, সম্মেলন ইত্যাদি হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.