১০ মে মুক্তি পাচ্ছে পরিচালক সন্দীপ রায়ের ‘নয়ন রহস্য’। এর পর নতুন অ্যান্থোলজি ফিল্মের কাজে হাত দিতে চলেছেন তিনি। একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিচালক। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
‘নয়ন রহস্য’ ছবির ট্রেলারের প্রতিক্রিয়া কি আশানুরূপ হল না?
সন্দীপ রায়: এমনিতে তো ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। ভালো-খারাপ দুরকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আসলে এই ছবির ট্রেলার তৈরি করা খুব শক্ত ছিল। আমরা অনেক ঘটনা বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ট্রেলারে রাখতে পারিনি।
এই গল্পটাই বেছে নিলেন কেন?
সন্দীপ রায়: আসলে ‘হত্যাপুরী’ ছবিতে এই শিশু অভিনেতাকে পেয়ে, ওর কাজে মুগ্ধ হয়েছিলাম। নয়নের চরিত্রের জন্য ও পারফেক্ট। কিন্তু এর পরে করলে বয়স বেড়ে যেত, তাই তড়িঘড়ি এই গল্পটা নিয়ে ছবিটা করেছি। তাছাড়া এই গল্পে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষী রয়েছে। একটা প্যান-ইন্ডিয়ান টেক্সচার এসেছে। এই উপন্যাসের শুরুতে সত্যজিৎ রায় নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। যেমন ফেলুদার টার্গেট অডিয়েন্স। সেই সময়ের কিশোর-কিশোরীরা বড় হয়ে এখনকার আমরা। আপনার কী মনে হয়,
‘ফেলুদা’ কতটা প্রাসঙ্গিক এই আমাদের বাদ দিলে?
সন্দীপ রায়: আমার তো চিরকালই মনে হয়, আট থেকে আশি, ছোটরাও পড়েছে, বড়রাও পড়ছে।
কিন্তু এখনও কি ‘ফেলুদা’র এই রেঞ্জ অফ দর্শক আছে?
সন্দীপ রায়: আমাদের প্রজন্ম তো রয়েইছে। এখনকার প্রজন্মের কথাও ভাবতে হচ্ছে। তাদের কাছে পৌঁছনোর জন্য ফেলুদাকে আধুনিক করেছি। তাছাড়া পিরিয়ড পিস তৈরি করা মুশকিল। শহরের চেহারাগুলো একেবারে পাল্টে গেছে। বাজেটে সামলানো সম্ভব নয়।
এখনকার জেন-জি তো ফেলুদার গল্প পড়ে না, ম্যাজিক শো নিয়েও তাদের আগ্রহ নেই…
সন্দীপ রায়: সেই কারণেই আমার মনে হয়, ফেলে আসা বাঙালিয়ানা, ফেলুদার মধ্যেকার যে সততা, জীবনবোধ, আজকের ছেলেমেয়েদের জানা উচিত। তাছাড়া এখন তো আবার পুরনো, রেট্রো জিনিসের প্রতি দর্শকের উৎসাহ তৈরি হয়েছে। এখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলে গিয়েছে। তাই আমার আরও বেশি করে মনে হয়, পুরনো মূল্যবোধগুলো বারবার তুলে ধরা উচিত। কনশাস করে তোলা উচিত।
আপনি সবসময় সাহিত্যনির্ভর ছবি করেন। সত্যজিৎ রায় ছাড়াও শরদিন্দ্যু বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকী পরশুরামের গল্প নিয়ে ছবি করেছেন…
সন্দীপ রায়: বাংলা সাহিত্যে এত কিছু আছে যে কেন নয়? শরদিন্দুবাবু যেহেতু নিজে চিত্রনাট্যকার ছিলেন তাঁর লেখার মধ্যে ভিস্যুয়াল কোয়ালিটি রয়েছে এবং গল্পে সংলাপ অসম্ভব ভালো। ছোটগল্প তো অসাধারণ। আমার শরদিন্দুবাবুর প্রতি যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। বইগুলো হাতের কাছে রাখি, নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। ব্যোমকেশ করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে তো প্রায় সবাই করে ফেলেছে, সেটা আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
ব্যোমকেশের প্রিয় গল্প কী?
সন্দীপ রায়: আমার খুব প্রিয় হচ্ছে ‘দুর্গ রহস্য’। আরও সব দারুণ গল্প রয়েছে। আপাতত শরদিন্দুর ছোটগল্প নিয়ে কাজ করতে চাই। ঐতিহাসিক গল্পও অসাধারণ, বাজেট পারমিট করবে না।
কিন্তু কখনও মনে হয় না সমসময়ের গল্প বলবেন, চারপাশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়– সেই সব নিয়ে ছবি করবেন?
সন্দীপ রায়: সেই রকম ইন্টারেস্টিং গল্প হলে কেন নয়। বাবা যেটা করতেন একটা সলিড গল্প সামনে রেখে পিছনে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতেন। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে যেমন করেছিলেন। আবার এটাও একটা সমস্যা, কোনও সমসময়ের ঘটনা নিয়ে করলে সেটা দশ বছর পর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে।…
ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন একটা সমস্যা বলে মনে হয়?
সন্দীপ রায়: সেটা তো একটা ব্যাপার আছেই। এখন ছবি করতে গেলে অনেক ভাবনা-চিন্তা করে করতে হয়। অনেক টাকা-পয়সার লগ্নি, মাঝপথে ছবি আটকে গেলে সেটা খুবই বিপদের। ‘নয়ন রহস্য’ গল্পে যেমন লালমোহন বাবুর মুখে, বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা ছড়া আছে যেটাকে ‘অ্যান্টি-সিটি’ বলা যায়। চেন্নাই শহরটাকে নিয়ে একটা নেগেটিভ ছড়া, সিনেমায় এটা রাখা উচিত হবে কি না সেটা নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা করেছিলাম। আমার আবার চেন্নাই শহর খুব প্রিয়। বাবার সঙ্গে এখানে আমার একটা ক্ল্যাশ আছে। এবার কেউ যদি কলকাতা নিয়ে এরকম বেমক্কা ছড়া তৈরি করে সেটা এখানকার লোকের যেমন ভালো লাগবে না, তেমন দক্ষিণের দর্শকেরও ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে। তাই ছবি করার সময় নানা বিষয় নিয়ে কেয়ারফুল থাকতে হয়।
হ্যাঁ, যেমন কিছুদিন আগে অনুরাগ কাশ্যপের মন্তব্যে বাঙালি রেগে গিয়েছিল…
সন্দীপ রায়: (হাসি) হ্যাঁ, এখন অনেক বেশি সেনসিটিভ হয়ে কাজ করতে হয়।
‘নয়ন রহস্য’র প্রথম পরিচ্ছেদে সত্যজিৎ রায় প্রকাশকদেরও একহাত নিয়েছেন। প্রকাশকদের আবদারে তিনি কতটা জর্জরিত হয়েছিলেন?
সন্দীপ রায়: হ্যাঁ, বাবাকেও সেই সময় প্রকাশকদের চাহিদা ফেস করতে হয়েছিল। প্রথমে ঠিক করেছিলেন ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’-এর পর অলটারনেটিভ বছরে একটা করে ফেলুদা বেরবে। তারপর তো বছরে তিনটে-চারটে করে ফেলুদা লিখতে হয়েছিল। প্রচুর ফিডব্যাক আসত। তখন ফোন অথবা চিঠি। বাবা নিজেই ফোন ধরতেন, চিঠির উত্তরও দিতেন। এবং সেই সব ক্রিটিসিজম সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। আমারও কন্সট্রাকটিভ ক্রিটিসিজম নিতে অসুবিধা নেই। তবে এখন তো আর সেন্সরশিপ বলে কিছু নেই। ফলে নানা কথা শুনতে পাই এদিক-ওদিক থেকে। সবসময় যে ভালো লাগে এমনটা নয়। মনটা খারাপও হয়ে যায়।
শুনেছি এখন আর ফেলুদা করবেন না, অন্য ছবির কী প্ল্যান?
সন্দীপ রায়: ইচ্ছে আছে ফেলুদার গল্পে এক-দুবছর গ্যাপ দেওয়ার। ছোটগল্প নিয়ে কাজ করতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের গল্প হতে পারে কিংবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পও হতে পারে। জুন-জুলাই নাগাদ শুটিং শুরুর ইচ্ছে আছে। অ্যান্থোলজি ফিল্ম হবে। একটা গল্পের সঙ্গে অন্যটার কোনও সম্পর্ক থাকবে না।
শুনেছি ‘সোনি’ সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প নিয়ে অ্যানিমেশন তৈরি করতে চায়।
সন্দীপ রায়: হ্যাঁ, আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। গল্প বাছাইও হয়ে গিয়েছে। ওরা স্টোরিবোর্ড এবং ক্যারেকটার স্কেচ নিয়ে আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। আমি দায়িত্বে নেই, কিন্তু দেখে নিচ্ছি কারণ অনেক সময় বাবার গল্প নিয়েও গোলমাল হয়। বাবার গল্প বলে চেনাই যায় না।
নেটফ্লিক্স-এর ‘রে’ দেখেছেন?
সন্দীপ রায়: না, দেখিনি। শুনেছি মনোজ বাজপেয়ী যে গল্পেতে রয়েছেন সেটা ভালো হয়েছে। আমার দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ এবং সুজয় ঘোষ পরিচালিত ‘অনুকূল’ ভালো লেগেছিল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.