আকাশ মিশ্র: ‘রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম/ রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম।’ শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নির্বাচনের কথা ভেবে এই লাইনগুলো লিখেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে দুয়ারে যখন নির্বাচন, তখন সিনেমাশিল্প কিংবা আরও নিঁখুতভাবে বলতে হলে বলিউডের দেশপ্রেম কিন্তু এই রক্তবমির কথাই বলে৷
বলিউডের ছবির কথা বলতে গেলে ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে ওঠে ১৯৩৩ সালের মার্চ মাস এবং হিটলারের হাতের মুঠোর জার্মানির ছবি। মিলেমিশে এক হয়ে যায় জার্মানি, হিটলার, প্রোপাগান্ডাসহ আরও অনেক কিছু। এত পর্যন্ত পড়ার পরে অনেকেই কৌতূহলী হতে পারেন। মনে হতে পারে, বলিউড আর হিটলারের জার্মানির মিল কোথায়? আছে, মিল আছে। মিল আছে ‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দবন্ধনীতে। মিল আছে আরও অনেককিছুতে। মনে হতেই পারে প্রায় একশো বছর আগে নিজের কথা প্রচার করার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন হিটলার, সেই একই পদ্ধতি, একই পন্থা আজও অনুসরণ করা হচ্ছে বলিউডে। শাসকগোষ্ঠী সুচারুভাবে নিজেদের আত্মগরিমার প্রচার করছে বলিউডের একাংশ ছবিতে।
‘প্রোপাগান্ডা’ একটি লাতিন শব্দ৷ যার অর্থ এমন ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশে ব্যবহৃত হয়৷ আর তা প্রচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র৷ এই তালিকায় নতুন সংযোজন সোশাল মিডিয়া। সিনেমার ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে, সিনেমা জন্ম থেকেই প্রতিবাদের ভাষা কিংবা কোনও সামাজিক বার্তাকে সহজ আঙ্গিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার হতো৷ বিনোদনের ফাঁকে এখনও গোটা বিশ্বে এরকমই হয়ে থাকে৷ আর এই সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার আধারকেই কৌশলে প্রোপাগান্ডার রূপ দেওয়া হয়৷ গোড়াতে বলা হচ্ছিল হিটলারের কথা। সেই এবার প্রসঙ্গে আসি।
সালটা ১৯৩৩৷ মার্চ মাস৷ হিটলার বুঝেছিলেন জার্মান যুবসমাজের কাছে পৌঁছতে হলে, তাঁদের মগজে ঢুকতে হলে, থিয়েটার, সিনেমাকে হাতিয়ার করতে হবে৷ তাই কিছু নাৎসি ভক্ত সিনেমা পরিচালকদের নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়৷ নাম রাখা হয় ‘রাইখ মিনিস্ট্রি ফর পিপলস এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’৷
এই কমিটির হাত ধরেই একে একে তৈরি হতে থাকে ‘ট্রাম্ফ অব দ্য উইল'(১৯৩৫), ‘জুড সুস’ (১৯৪০), ‘দ্য ইটারনাল জিউ’৷ এই সব ছবিতে শুধুই হিটলারের জয়গান এবং ইহুদিদের সামজিক কীট এবং শয়তানের জাত বলে প্রচার৷ আসলে প্রোপাগান্ডার উৎস সবসময়ে ছোট ছোট মিথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ঘটে। তারপর এত বড় মিথ্যে বলা শুরু হয়, যে মানুষ বুঝতেই পারে না সেটি ডাহা অসত্য। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শাসক নিজের স্বার্থে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার করে আসছে। ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি তৈরির জন্য ‘পৃষ্ঠপোষক’রা হাজির হন। কখনও সেখানে পরিচালক প্রচারের স্বার্থে মদতপুষ্ট ছবিটি তৈরি করতে রাজি হন। আবার কখনও ব্যক্তিগত দর্শনের কারণেও এই ধরনের ছবি তৈরি করে থাকেন।
কাট টু বলিউড৷ আলো ফেলা যাক বলিউড এবং সাম্প্রতিক সময়ে৷ বলিউডে সেইভাবে ফলাও করা কোনও নির্দিষ্ট কমিটি নেই৷ তবে প্রচ্ছন্ন এক পরিবার রয়েছে৷ ‘মোদি পরিবার।’ ১৯ এপ্রিল থেকে গোটা দেশজুড়ে গণতন্ত্রের উৎসব ওরফে নির্বাচন। তৃতীয়বার দেশের সিংহাসন দখল করতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। আর বিরোধীরা তাদের রুখতে মরিয়া। এই লড়াই জেতার ফন্দি হিসেবেই বলিউড বরাবরই প্রিয় শাসকদলের।
মনে করে দেখুন, গত লোকসভা ভোটের আগে একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে প্রোপাগান্ডা ছবি। ‘দ্য তসখন্দ ফাইলস’, মোদির বায়োপিক-এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
তবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের দড়ি টানাটানির লড়াইয়ে শাসকদলের পৃষ্ঠপোষক বলিউডের একাংশ অনেক আগে থেকেই যেন কোমর বেঁধে নামলেন।
২০২২ সালে মুক্তি পেল পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। ইসলামোফোবিয়াকে সঙ্গী করে দেশের সফট পয়েন্ট কাশ্মীরকে টার্গেট করলেন পরিচালক। অবশ্য বিবেক অগ্নিহোত্রীর কথায়, ”দ্য কাশ্মীর ফাইলস মোটেই প্রোপাগান্ডা ছবি নয়। এই ছবি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। যা দেখানো হয়েছে, তা একেবারেই সত্য।”
বিবেকের একথার বিপরীত মতামতও রয়েছে। সেই সময় ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ছবির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহের মতো দিকপালরা। তবে শুধুই অভিনেতা নাসিরউদ্দিন নয়, ৫৩ তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জুরিবোর্ডের প্রধান হিসেবে ইজরায়েলি চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদাভ লাপিদ সেই সময় ভারতে আসেন। তিনি বিবেক অগ্নিহোত্রীর এই ছবিটিকে ‘নোংরা এবং প্রোপাগান্ডা’ সিনেমা বলে মন্তব্য করেছিলেন। লাপিদের এই মন্তব্যের সমালোচনা করে বিবেক অগ্নিহোত্রী টুইটে লিখেছিলেন, ”সত্য হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। এটা মানুষকে মিথ্যা বলায়।” সেই সময় লাপিদের সমালোচনা করে বিবেকের পাশে দাঁড়িয়ে পরিচালক সুদীপ্ত সেন। আসলে, তখন সুদীপ্ত নিজেও কোমর বাঁধছিলেন আরেকটি প্রোপাগান্ডা ছবির যার নাম ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র।
বক্স অফিস ঝড় তুলেছিল বিবেকের ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল’ এবং সুদীপ্তর ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। দুই ছবিরই তথ্যগত ভুল নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন বহু পরিচালক। কিন্তু সেই সমালোচনাকে ছাপিয়ে এই দুই ছবিকে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এমনকী, সংসদেও এই ছবির ভূয়শী প্রশংসাও হয়। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র সমালোচক তনুল ঠাকুর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, ”বলিউডের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের সম্পর্ক দেওয়া-নেওয়ার। চলচ্চিত্রশিল্প রাজনৈতিক সমর্থন থেকে উপকৃত হচ্ছে, আবার তাদের কর মকুব হচ্ছে।”
বলিউডের এই প্রোপাগান্ডা আবার দুরকমের নিয়ম মেনে চলে। একপ্রকার ছবিতে শুধুই দেশপ্রেম, পাক-ভারত সম্পর্ক দেখিয়ে গেরুয়া শিবিরের জয়গান। তা ভিকি কৌশলের ‘উরি’ হোক কিংবা হৃতিক-দীপিকার ‘ফাইটার’। আর দ্বিতীয় প্রকারে সত্য ঘটনা অবলম্বনের আড়ালে কিছু বিভ্রান্তিকর বার্তাকে সাজিয়ে দেওয়া হয় খুবই কৌশলে। প্রমাণ ‘বাস্তার’, ‘জেএনইউ’, ‘৭২ হুর’-এর মতো ছবি।
‘দ্য কেরালা স্টোরি’র পরিচালক সুদীপ্ত সেনের কথায়, ”সত্য দেখানো মানে সেটা প্রোপাগান্ডা নয়!” সুদীপ্ত অবশ্য তাঁর ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ও ‘বাস্তার’কে প্রোপাগান্ডা ছবি বলতে নারাজ।
দুয়ারে নির্বাচন এলে বক্স অফিসে বেড়ে চলে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির সংখ্যা। সিনেমামাধ্যম বিনোদন দেওয়ার বদলে রাজনীতির মগজ ধোলাই যন্ত্র। ঠিক যেমন বীর সাভারকরের বায়োপিক। এই ছবিতে অভিনেতা ও পরিচালক রণদীপ হুডার ‘ভয়ংকর’ দাবি, নেতাজি, ভগৎ সিং এবং ক্ষুদিরাম বসুর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন নাকি সাভারকর! আর একথা কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বলে যায় সাভারকারের বায়োপিক।
টলিউডের জনপ্রিয় পরিচালক অতনু ঘোষ। তাঁর ছবির গল্পে বরাবরই উঠে আসে সাধারণ মানুষের সাধারণ গল্প। তা ‘তখন তেইশ’ কিংবা হালফিলের ‘শেষপাতা’। সম্পর্ক, টানাপোড়েনকে সঙ্গী করে ছবির পর্দায় জীবনের নতুন অঙ্ক কষেন অতনু। তাঁর ছবিকে কখনই প্রোপাগান্ডা ছবি বলা যায় না। তবে অতনু ঘোষের কথায়, ”হালফিলের যে ছবিগুলোকে প্রোপাগান্ডা তকমা দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো একটাও আমি দেখিনি। আসলে দেখতে ইচ্ছেই করেনি। তবে এটুকু বলতে পারি, সিনেমার জন্ম থেকেই তা প্রোপাগান্ডা। ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’, ‘বার্থ অফ আ নেশন’ ছবিগুলো তো এক কথায় প্রোপাগান্ডা ছবিই। আসলে, সিনেমার জন্মলগ্নে, একে বিনোদনের মাধ্যম বলা হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দৃষ্টিভঙ্গিটা একেবারে পালটে গেল। ধীরে ধীরে বিশ্ব সিনেমার ক্ষেত্রে সিনেমা যে প্রতিবাদের ধ্বনি তা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে অর্থে সিনেমা কিন্তু বরাবরই প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার। তবে এখন যে ছবিগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো না দেখে মতামত প্রকাশ করা উচিত নয়। ”
সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে মানুষ যত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কোনও ঘটনায় কল্পিত একটি ভাষ্য নির্মাণ করা ততই সহজ হয়ে পড়ছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে ‘আজমের ৯২’। ১৯৯২ সালে আজমেরে এক গণধর্ষণকাণ্ডের উপর তৈরি হয়েছে এই ছবি। এই ছবির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিনেমা এবং সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে নিশানা করে তার সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে জুড়ে দেওয়াই এই ধরনের সিনেমার কৌশল। তাই ফিল্ম সমালোচকরা মনে করছেন, সিনেমা আর নিছক কোনও শিল্প নয়, বরং কোন নির্দিষ্ট শিবিরের ব্যক্তিগত লিফলেট। সেখানে পাথুরে প্রমাণের চেয়ে আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে স্পটলাইটে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.