অপরাজিতা সেন: রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার, না কি সীমাহীন অপব্যবহার? নেটফ্লিক্সে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েই তুমুল জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা ‘ডাব্বা কার্টেল’ সিরিজটি এই পুরনো বিতর্ককে একেবারে নতুন চেহারায় হাজির করে দিচ্ছে। কাহিনি, চিত্রনাট্য, অভিনয়, প্রোডাকশনে ফুল মার্কস পাওয়া সিরিজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভিন্ন কায়দায় কিছু গানের প্রয়োগ। এখানেই অবাক হয়ে দেখতে হয় মাদক এবং সমকামিতার উদ্দাম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ব্যবহার হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীত। বিতর্ক হতেই পারে, হয়তো ক’দিনের মধ্যেই মাথাচাড়া দেবে, কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য, এই প্রয়োগ নিয়ে কোনও উপসংহারে পৌঁছনোর আগে সবিস্তার আলোচনার অবকাশ থাকছে এবং সেটাও খোলামন নিয়ে।
‘ডাব্বা কার্টেল’ ছবিটি ক্রাইম থ্রিলার টাইপের। কয়েকজন মহিলা টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার সরবরাহের কাজ করছেন। কেন করছেন, আসলে কী ঘটছে, তা নিয়ে জমজমাট কাহিনি। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নিষিদ্ধ ওষুধ বাজারে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে এক প্রথম সারির কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত এবং সে সব ধামাচাপার চেষ্টা। অভিনয়ে শাবানা আজমি থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই দর্শককে আকর্ষণ করে রেখেছেন। কিন্তু এই প্রতিবেদনে সেটা আলোচ্য নয়। এখানে আলোচ্য শুধু রবীন্দ্রসংগীতের বিষয়টি।
গানটি বহুল পরিচিত। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’। ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবিতে তো বটেই, বহু শিল্পীর মুখে বহু ক্ষেত্রে গানটি ব্যবহার হয়েছে। ‘ডাব্বা কার্টেল’-এ এই গানটি একটু স্বতন্ত্রভাবে গাওয়া, শুনতে মন্দ লাগে না, কিন্তু বিতর্কের জায়গাটা হচ্ছে তার দৃশ্যায়নে। দুটি মেয়ে, যাদের মধ্যে সমকামিতার আকর্ষণ তীব্র, তারা নতুন সম্পর্কে ক্রমশ জড়াচ্ছে, তারা একটি প্রতীকী দৃশ্যে মাদকাসক্ত অবস্থায় ঘোরের মাথায় এই গানটির ব্যাকগ্রাউন্ডে নাচছে। মূলত শাহেদা আর মালা, অভিনেত্রী অঞ্জলি আনন্দ এবং নিমিশা সাজায়নের দৃশ্য। শাহেদা জমি-বাড়ির দালালের কাজ করে। নিমিশা পরিচারিকা। তাদের আর্থিক উত্তরণ ঘটছে ঝুঁকির অনৈতিক পথে। মূলত এই দুজনে মাদকাসক্ত হয়ে উদ্দাম আচরণের ব্যাকগ্রাউন্ডেই ‘মম চিত্তে…’র প্রয়োগ। এর মধ্যেই খানিক কল্পনাদৃশ্য, যেখানে শাহেদা তার নেশার চোখে মালার জায়গায় দেখতে পাচ্ছে প্রীতিকে। অভিনয়ে এক সাই তামান্কর। মহিলা পুলিশের চরিত্র। চিত্রনাট্য দেখিয়েছে শাহেদা আর প্রীতি পরস্পরের প্রতি শারীরিকভাবেই আকৃষ্ট হচ্ছে।
এখানেই প্রশ্ন ওঠার অবকাশ আছে মাদক এবং সমকামিতার দৃশ্যের সঙ্গে ‘মম চিত্তে..’র মতো রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার কতটা ঠিক। সাধারণ ছুঁৎমার্গ দেখলে এর প্রতিবাদীর সংখ্যাই নিশ্চিতভাবে বাড়বে। কিন্তু ঘটনা হল, নির্মাতারা এত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি এবং দৃশ্যটি তৈরি করেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে প্রয়োগে আপত্তি থাকে না। তার চেয়েও বড় কথা, এই সাহসী প্রয়োগ গানের প্রতিটি শব্দকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। ‘ডাব্বা কার্টেল’-এ শাহেদা একটি সাধারণ মেয়ে, যার স্বাধীনভাবে বঁাচার ইচ্ছা, স্বপ্নপূরণে চাই টাকা, হয়তো বিদেশে কোনও নতুন জীবন তাকে হাতছানি দেয়। অন্যদিকে প্রীতি একজন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, যে শার্ট-প্যান্ট ছাড়া নারীসুলভ অন্য কোনও পোশাক পরেই না; তাকে সৌন্দর্যময় অন্য পোশাক উপহার দেয় শাহেদা। এও এক সাধারণ ভাঙা আবাসনে থাকে, স্বপ্ন দেখে কোনও আধুনিক ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার। এই দুটি মেয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে বা নিয়ম ভেঙে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে শারীরিক এবং মানসিক সম্পর্কে।
যৌনতার অংশটি পরিচালক অত্যন্ত সুরুচির সঙ্গে ইঙ্গিতপূর্ণ রেখেই যা বোঝার বুঝিয়েছেন। দু’জনের সংলাপেও বিপন্ন ভীরুতা। প্রীতি কি এই সম্পর্ক তার বাবাকে বলতে পারবে? কিংবা পুলিশে তার কর্মক্ষেত্রে? শাহেদাও কি বলে উঠতে পারবে প্রকাশ্যে? সেখানে সমাজ তো পুরনোপন্থী মানসিকতা ভেঙে বেরোতে পারবে না। এ হেন দোদুল্যমান অবস্থায় পরিস্থিতির ঘটনাপ্রবাহে একটি মাদকাসক্ত হয়ে বেলাগাম আচরণের সময়ে শাহেদা এবং প্রীতির কল্পিত উচ্ছ্বাসের ব্যাকগ্রাউন্ডের ‘মম চিত্তে…’। গানের কথাগুলি ধরলে এক ভয়ানক সাদৃশ্য : ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ/তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে/ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।’ আবার শাহেদা-প্রীতি বা তাদের সমনোভাবাপন্ন মহিলারা ঠিক-ভুলের বিতর্ককে সময়োপযোগী সাহসে উড়িয়ে দিয়ে যে মুক্তি খুঁজছে, গানের পরের কথাগুলি যেন তারই প্রতিধ্বনি– ‘হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে, / কঁাপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে…।’ কিংবা তার পরেই কবিগুরুর কথায়, ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ/ দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ…’। শাহেদা এবং প্রীতির ভূমিকায় দুই অভিনেত্রী অঞ্জলি আনন্দ এবং সাই তামান্কর, এমনকী, কিছু অংশে নিমিশা সাজায়নও অপূর্ব অভিব্যক্তি এবং অভিনয়ে যেন ‘মম চিত্তে…’র এক অন্যরকম অাবিষ্কারের অভিযাত্রী হয়েছেন।
বহু ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু এত ব্যাকরণ ভাঙা চরিত্রে এবং পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রসংগীতের এই ব্যবহার, বলা ভালো সাহসী ব্যবহার খানিকটা চমকে দিয়েছে। খঁাটি হিন্দি ওয়েব সিরিজে বাংলা গান, তাও রবীন্দ্রসংগীত। সেটাও আবার পরীক্ষামূলক ভিন্ন গায়কী এবং ছকভাঙা সুরে, যা নিয়েও আপত্তি বা বিতর্কের দরজাটা খোলা আছে। তবে একবাক্যে নাক সিঁটকে নিন্দা করার মতো সিচুয়েশনটা কিন্তু পরিচালক দেননি। বরং এ ভাবেও ভাবা ভালো, রবীন্দ্রসংগীতকে আজকের বলিউডি প্রোডাকশনে জীবনদর্শনের প্রতিফলনের চালচিত্র হিসাবে দেখানোর এই চেষ্টা যদি আরও ছড়িয়ে পড়ে, তাতে ক্ষতি কী? ‘ডাব্বা কার্টেল’ সিরিজে বং কানেকশন প্রবল, যিশু সেনগুপ্তও ফাটিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু ‘মম চিত্তে…’র এই প্রয়োগ আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের সব পর্বে, সব মুহূর্তে আছেন। প্রেম, বিরহ, পূজা, বিদ্রোহ, গড়ার গান, নিয়ম ভাঙার গান, আনন্দ, শোক সবেতে আছেন। নিজের জীবনের নানা মুহূর্তে বৈধ, অবৈধর তথাকথিত প্রাচীর ভেঙে এতবার এতরকম সম্পর্কে জড়িয়েছেন কবিগুরু, নতুন ধারার সম্পর্ক উদযাপনে তাঁর গানের প্রয়োগে অসন্তুষ্ট হতেন না কখনই, সেটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’য় ‘মম চিত্ত..’কে পেয়েছিলাম স্নিগ্ধ পাহাড়ি ঝরনার মতো। বলিউডি এই নতুন সিরিজটি এই একই গানকে দেখাল ঝরনা থেকে উত্তরণ হওয়া এক উদ্দাম সৌন্দর্যের বিশাল জলপ্রপাতের মতো। দৃশ্যটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, হে রবীন্দ্রনাথ, আপনি এখানেও, আজও! ঠিক এই গল্পের এই চরিত্রটার জন্য, জীবনের এই আবেগের যথাযথ বহিঃপ্রকাশেও, আপনি, শুধু আপনিই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.