সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত জুটির পঞ্চাশতম ছবি ‘অযোগ্য’। তার আগে নিজের বাড়িতে একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। মুখোমুখি শম্পালী মৌলিক।
আপনার ‘অযোগ্য’ ছবির অন্যতম প্রধান অভিনেতা শিলাজিৎ মজা করে ‘শয়তান খোপরি’ বলছেন আপনাকে। নিজেকে কি ইন্ডাস্ট্রির মাস্টারমাইন্ড মনে করেন?
না, না কখনওই না। আর সত্যিই যারা নিজেদের মাস্টারমাইন্ড মনে করে, তারা সাক্ষাৎকারে আশা করি বলবে না। কারণ, তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়ার কথা। ইন্ডাস্ট্রির মাস্টারমাইন্ড বলে কিছু হয় না। সারাক্ষণ ইন্ডাস্ট্রি এত ভাবে ইভলভ করছে– ভালো, খারাপ, নানান ভাবে, সেখানে কোনও মাস্টারমাইন্ড সামলাতে পারবে না। এক-একটা পিরিয়ডে দু-তিনজন সফল লোক থাকে। দশজন নয় কোনওদিন। বিভিন্ন সময়ে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো হয় সেই সফল ব্যক্তিদের মধ্যে। কেউ চলে যায়, আরেকজন বসে পড়ে। আমি এটুকু বলতে পারি, আমি অনেকদিন ধরে একটা চেয়ারে বসার সুযোগ পাচ্ছি মাঝে মাঝে। ঘুরে এসে আবার চেয়ারটা পেয়ে যাচ্ছি। হয় আমি আন্দাজ করতে পারছি গানের কোথায় থামতে হবে। অথবা যে গানটা চালায় তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছি (হাসি)।
এতগুলো জাতীয় পুরস্কার আপনার ঝুলিতে, গত বছর আপনার ‘অর্ধাঙ্গিনী’ অর্গানিক বক্স অফিস সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে তারপর ‘পালান’ সেভাবে চলেনি। শিল্প আর বাণিজ্যের যে বিরোধের কথা বলা হয়, সেটা কতটা সামাল দিতে পেরেছেন মনে হয়?
দেখো, ‘পালান’ চালানোর জন্য বানানোই হয়নি। যাঁকে উৎসর্গ করে বানানো হয়েছে, তাঁর বক্স অফিসের দিকে পৃথিবীতে কেউ তাকায়নি। না তাকানোই ভালো। কাজেই ‘পালান’-এর জায়গাই আলাদা। যেমন বারোয়ারি পুজোয় ঘটা করে থিম পুজো হয়। কিন্তু বাড়ির নাটাই চণ্ডী পুজো, বাড়ির মধ্যেই হয়। ছোট করে হয়, তার জন্য অত দর্শনার্থী থাকে না। ঠিক সেরকমই ‘পালান’-এর জন্য দর্শনার্থীর কথা ভাবিওনি। আর ‘অর্ধাঙ্গিনী’-র ক্ষেত্রে তুমি যেটা বললে, অর্গানিক আর তুমুল বক্স অফিস। সুরিন্দর ফিল্মস ঠিক এটাই করে। ওরা কোনওদিন কোনওকিছু বুস্ট করবে না। সেটা আমি শ্রদ্ধা করি। এমনও দেখেছি গানের কোটি কোটি ভিউস হয়েও সে ছবি চলে না। আর শিল্প আর বাণিজ্যের বিরোধের প্রসঙ্গে বলি, আমি মনে হয় কিছুটা হলেও সামলাতে পেরেছি। একদম ধুয়ে মুছে গেছে বা সত্তর-আশি দিনের কম চলেছে, এমন ছবি প্রায় নেই আমার।
‘অযোগ্য’ প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির ৫০তম ছবি, আজ মুক্তি। মাল্টিপ্লেক্স-শহর ছাড়িয়ে শহরতলি-গ্রামের দর্শকের মন জয় করতে পারবে?
পারা উচিত। ছবিটা পৌঁছে দিতে পারলেই হবে। আমার মনে হয়, রানে শতাধিক হল-এ রিলিজ করবে। শুধু তাই নয়, জাতীয় রিলিজও হচ্ছে ৭ জুনই। মানে বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, দিল্লি, মুম্বই, পুণে সব জায়গায় মুক্তি পাচ্ছে একসঙ্গে। আমার বিশ্বাস মানুষ দেখবে ছবিটা। দুরকমের দর্শক এক্ষেত্রে, একদল প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি দেখতে চান। আরেক দল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি দেখতে চান। আরেকটা দর্শক আছে যারা ধারাবাহিকতার দর্শক। যারা ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’, ‘দৃষ্টিকোণ’, ‘নগরকীর্তন’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’ তারপর ‘অযোগ্য’ (Ajogyo Movie) দেখবে। এটা ওই বিশ্বাসযোগ্যতার বোরোলিনের মতো যেন হয় সিনেমাটা (জোরে হাসি)।
আপনার ছবি যদি প্রেমের গল্প নিয়ে হয়, সেখানে তৃতীয় ব্যক্তির একটা ভূমিকা থাকেই। এই টানাপোড়েন কি খুব উপভোগ করেন? বা চিত্রনাট্যে কি ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া পড়ে?
না, সেটা থাকে না। ‘তৃতীয়’ কথাটা খুব ইন্টারেস্টিং। কিছু সিনেমায় তৃতীয় জন ভিলেন হয়। আমি যেহেতু প্রেমের গল্প বলছি, এই ‘তৃতীয়’ আরেকজন প্রেমিক। যেখানে ভালোবাসার চূড়ান্ত আকাল, বিশ্বাসভঙ্গটাই বড় জায়গা নিচ্ছে, সেখানে আমি চেষ্টা করেছি তৃতীয় জনকে রেখে কী করে একটা আস্থার পৃথিবী তৈরি করা যায়। কেউ খারাপ নয় কিন্তু। কেউ ভালোবেসে যদি বিচিত্র অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়, সে কী করবে? ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। এবার সেটা কীভাবে সৌজন্যমূলক ভাবে সামাল দেওয়া যায় সেটা দেখাই। এইটা আমার ভালোই লাগে। দেখো, আমি তো কোনও জীবনী করছি না, বা অন্য ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, একটা ছবিকে ভেঙে অন্য স্ট্রাকচার দিয়ে করলাম, সেরকমও কিন্তু করছি না। সেটা আমার কাছে সহজ পথ মনে হয়। আরেকটা জিনিস, আমার তো নিজের গল্প বলতে হবে। এটা আমার ৩২তম ছবি। ’৮৭-’৮৮ সাল থেকে আমি যা যা টিভির জন্য বানিয়েছি, সব নিজের লেখা গল্প। সেই কাহিনি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া পাবে। কিন্তু আমার আনন্দ, ওটা আমার সন্তান। যা সময়ের একটা ছাপ রেখে যাবে। একজন ফিল্মমেকারের এই দায়িত্ব থাকা দরকার। যে সময়ে আমি বাঁচছি, সেলফি তুলছি, তাদের আমার চোখে এই সময়টুকু উপহার দিয়ে যাব না!
‘দৃষ্টিকোণ’ করার সময় কি পরিকল্পনা করেছিলেন ‘অযোগ্য’-র? ইতিহাস হবে ভেবে?
‘দৃষ্টিকোণ’ ৪৮তম ছিল। তার পর চুপ করে বসেছিলাম। ওদের নিয়ে কে আর ৪৯ করতে চায়! ওরা একটা ছবি করল ‘প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা’ ৪৯তম। সঙ্গে সঙ্গে আমার এটার কথা এগোয়। আর বুম্বাদাও চাইছিল। কিন্তু এই যে ‘প্রাক্তন’, ‘দৃষ্টিকোণ’, ‘অযোগ্য’ হচ্ছে সেখানে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ‘উইন্ডোজ’-এর কাছে, ওরা যদি ‘প্রাক্তন’ না বানাত, এসব কিচ্ছু হত না।
সোশাল মিডিয়াতে ‘অযোগ্য’ নিয়ে আপনাকে একটু বেশিই সক্রিয় লাগছে। কী বলবেন?
আমি বলব ‘সুরিন্দর ফিল্মস’ আরও সক্রিয় হয়েছে। আমাকে ‘কোলাব’ পাঠালে, আমি অ্যাকসেপ্ট করে নিই। শিখেও গেছি। (হাসি) আর যা যা পাঠায়, শেয়ার করতে থাকি। উজান দেখিয়ে দিয়েছে। এজন্যই করছি, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার যাঁরা দর্শক আছেন, তাঁরা আমার কিছু কিছু ছবি দেখেছেন, ‘খাদ’, ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ বা ‘দৃষ্টিকোণ’। আমার মনে হয়েছে তাঁদেরকে জানাই। ধরো, একটা শপিং মলে গেছি, একজন সেলফি তুলতে চাইল। তার পরেই প্রশ্ন, এবার কবে আপনার ছবি আসছে? আমার বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে যায়। এত কাণ্ড হচ্ছে, তাও এ জানে না! তাই ব্যস্ত মানুষের কান পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক লোককে জানানো যায় যে।
ছবি রিলিজের মুখেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে ইডি-র তরফে ডাকা হয়েছে। এটা কি ছবির ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে?
বহু মাস ধরে এই ঘটনাগুলো দেখছি। নিশির ডাকের মতো। একজন যায়, আবার চলে আসে। ঋতু খুব ইমপর্ট্যান্ট সেলিব্রিটি। প্রসেনজিৎ-দেব-জিৎ-যেই হোক না কেন– গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে বড় বড় ব্যবসায়ীরা আসবেই। এঁরা বড় ব্র্যান্ড। যাঁরা ডাকছেন তাঁরা কতটা টের পান ওঁরা কীরকম মানুষ, তাঁরা কী করেন, ওঁদের পক্ষে বোঝাও মুশকিল। কোনটা ঠিক বা ভুল আমি জানি না। আমার কাছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত একজন নিষ্ঠাবান অভিনেত্রী। যে সিনেমা নিয়ে পাগল। ঠিক যেমন কিশোর কুমার ক’জনকে বিয়ে করেছেন, ইমমেটেরিয়াল। আমি তাঁর গানের ভক্ত। কাজেই আমি হ্যাসেলড নই। আমার বিশ্বাস হয় মানুষও তাই। শিল্পী ঋতুপর্ণাকেই দেখবেন। বাকিটা যে প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান করছে তারা দেখবে। দরকার হলে দশবার ডাকবে।
ইদানীংকালে আপনি প্রচুর অভিনয় করছেন। সে কমার্শিয়াল বলুন, কি সিরিজ। একটু বেশি?
কারণ, আমি কম পরিচালনা করছি বলে। আমার সংসারটা চলবে কী করে। আমার কোনও হোটেল নেই, বিউটি পার্লার নেই। কাজেই ভদ্র, সুস্থভাবে আমার স্কিল দিয়ে রোজগার করতে গেলে এটা করতে হবে। অভিনয়ের জন্য এত লোক আমাকে চাইছে এটাও তো বড় কথা। আজ পর্যন্ত আমার পরিচালিত অজস্র ছবিতে আমি অভিনয় করেছি, কোনওটাতে এক টাকাও পারিশ্রমিক নিইনি। কাজেই মানুষ যখন আমাকে ইমপর্ট্যান্ট চরিত্রের জন্য ডাকছে, সিরিজ ভাবছে আমাকে নিয়ে, তখন আমাকে অভিনেতা সত্তাকে সিরিয়াসলি নিতেই হত। এই বছরের জুন মাস পর্যন্ত একটাও ছবি করিনি। হয়তো এই বছরের শেষে বানাব। কোনও বছর হয়তো দুটো ছবি বানাব। অভিনয়ের অফার এলে, আমি কিছু করার আছে কি না দেখে নিই। কেউ বদনাম করেনি যে, আমি খারাপ অভিনয় করেছি, এইটুকুই প্রাপ্তি।
হিন্দিতে ‘মনোহর পাণ্ডে’ তো আটকে?
না, আটকে নেই। একদিনের শুটিং বাকি।
শুনেছিলাম ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ হিন্দিতে করার প্ল্যান চলছিল?
তার চিত্রনাট্যও রেডি এবং অ্যাপ্রুভড। যিনি লিখেছেন অসম্ভব ভালো লিখেছেন। হিন্দি ছবি করতে বছর তিনেক লেগে যায়। বেশিও হতে পারে। এবার আর্টিস্টকে অন বোর্ড আনতে একটু সময় লাগে। সেগুলো বম্বের লোকেরা করছেন। যেদিন হবে জানাব। তবে বম্বেতে হিন্দি ছবি হওয়া নিয়ে বিহ্বলতা আমার একদম নেই। সেই চেষ্টাও করিনি। ওরা যখন ডেকেছে করেছি। যেরকম ভাবে ‘লন্তরানি’ (অ্যান্থোলজি) করলাম জনি-লিভার আর যিশুকে নিয়ে, যেটা Zee5-এ রয়েছে। সুনাম হয়েছে। ‘মনোহর পাণ্ডে’-ও OTT-তে আসবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.