সুমিত বিশ্বাস,পুরুলিয়া: ‘প্রলয়’ ছবির শুটিং করতে এসে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বলেছিলেন, পুরুলিয়ার এমনই ল্যান্ডস্কেপ, যেদিকে ক্যামেরা পাতা যায় সেদিকেই ফ্রেম হয়ে যায়। কার্যত এই কথার বাস্তবতা বুঝতে পেরেই সোমবার পুরুলিয়ায় (Purulia) প্রশাসনিক বৈঠক থেকে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা এই জেলায় ফিল্ম সিটি গড়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata banerjee)। রাজ্যের পর্যটন বিভাগ ও পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ফিল্ম সিটি গড়তে বেসরকারি বিনিয়োগে ১০ একর জমি দেবেন বলে ওই বৈঠক থেকেই জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই প্রশাসনিক পর্যালোচনা সভায় থাকা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গে কথা বলে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ওই বৈঠকেই পর্যটনে যুক্ত থাকা একটি সংস্থা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন তারা এই ফিল্ম সিটি গড়বেন। এই কাজে মুখ্যমন্ত্রী চেম্বার অফ কমার্সকে এগিয়ে আসার বার্তা দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ” রূপসী পুরুলিয়ার এত সৌন্দর্য। বিগত কয়েক বছরে এখানে বহু ছবির শুটিং হয়েছে। এখনও ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে। তাই ফিল্ম সিটি গড়ার জন্য ১০ একর জমি দেব।” শুধু ফিল্ম সিটি গড়াই নয় একে ঘিরে ফিল্ম ট্যুরিজমের প্রসার ঘটবে। যার ফলে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরও চাঙ্গা হবে।
ফিল্ম সিটি, পর্যটন শিল্পের প্রসারের পাশাপাশি এদিনের বৈঠকে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে শিল্পশহর রঘুনাথপুরে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরীর ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা। মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলের এই দূরের জেলার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও উন্নতিতে ব্রিটিশ আমলে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ছরড়ায় ছোট বিমানবন্দর চালু করতে চান। দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ” ছরড়ায় বিমানবন্দর হবে। পুরুলিয়ার কমিউনিকেশন বাড়ানোর প্রয়োজন।” সেই সঙ্গে তিনি পর্যটনের প্রসারে হোম স্টে আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন। এই জেলায় ‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্পে জেলা প্রশাসন পর্যটনকে জুড়ে দেওয়ায় প্রকল্পস্থলগুলি একটি করে ট্যুরিজমের সাইট সিয়িং হয়ে গিয়েছে। এখানেও হোম স্টে করা যাবে বলে এই বৈঠকে পর্যটন বিভাগ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। আসলে এই ফিল্ম সিটি, হোম স্টে-র মধ্য দিয়ে রূপসী পুরুলিয়াকে শুধু দেশে নয় বিদেশী পর্যটকদের কাছেও পর্যটনের গন্তব্য করে তুলতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে এই জেলায় যেমন পাহাড় রয়েছে। তেমনই রয়েছে জঙ্গল। আছে রুখা ভূমি। সেইসঙ্গে জলাধার। এক জেলায় এমন বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য বাংলায় আর কোথাও নেই। পুঞ্চায় জৈন স্থাপত্য পাকবিড়রার মন্দিরকে হেরিটেজ ঘোষণা করতে ওই ট্যুরিজম প্রকল্পে প্রশাসনিক বৈঠক থেকেই দু’কোটি টাকা বরাদ্দ করে দেন মুখ্যমন্ত্রী l পর্যটন বিভাগ থেকে এক কোটি এবং তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এক কোটি টাকা দেওয়া হবে বলে তিনি জানানl
এই জেলায় সর্বপ্রথম ফিল্ম ইউনিটের তাঁবু পড়ে ১৯৭৯ সালে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’-র ছবির শুটিং হয়েছিল। জয়চন্ডী পাহাড়ে। আড়শা এলাকার ল্যান্ডস্কেপকে কাজে লাগিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তারপর দীর্ঘ দিন বিরতির পর ১৯৯৯ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ‘উত্তরা’ ছবির শুটিং হয়। এরপর সিনেমার শুটিং যেন এই জেলায় নিয়মিত হয়ে যায়। তাপস পাল, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শ্রীলেখা মিত্রের ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত তাপস পালের ‘জানালা’, হিন্দি ছবি ‘ওহ’, মহাশ্বেতা দেবীর ১৩টি গল্প নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এছাড়া রবি ঠাকুরের ১৩টি গল্প নিয়ে ত্রয়োদশী ছবির শুটিং করেছিলেন ওই পরিচালকই। পাওলি দাম অভিনীত এই পরিচালকের অন্য স্বাদের ছবি ‘টোপ’ এই মাটিতেই শুটিং হয়। শুটিং হয় রণবীর সিং, সোনাক্ষী সিনহার হিন্দি ছবি ‘লুটেরা’।
রাজ্যে পালাবদলের পর সেই তালিকা আরও দীর্ঘ। রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রলয়’, জিৎ- দেবকে নিয়ে ‘দুই পৃথিবী’, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘লড়াই’, গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অংক’, তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘সময়ের প্রীতিমালা’, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘লক্ষ্মী ছেলে’ অপর্ণা সেনের ‘আরসিনগর’, ‘ঘরে বাইরে আজ’ এবং ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘বিশমিল্লা’ সুব্রত সেনের ‘প্রজাপতি’ ছবির শুটিং হয়েছে এই মাটিতেই। এছাড়া কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ঋত্বিক ঘটকের বায়োপিক ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ছবির শুটিং হয় এই জঙ্গলমহলেই। এমনকী, ইতালির পরিচালক ইতালো স্পিনেল্লির ‘গাঙ্গোর’ ছবিরও শুটিং হয় পুরুলিয়ায়। এই ছবি গুলিতে স্থানীয় শিল্পী হিসেবে অভিনয় করা সেই সঙ্গে স্থিরচিত্রে কাজ করা স্বরূপ দত্ত, সুদিন অধিকারী বলেন, ” আউটডোর শুটিং-র একটি বড় জায়গা পুরুলিয়া। এটা সমগ্র বিশ্বেই প্রতিষ্ঠিত। এখানে যদি ইনডোর শুটিংয়ের জায়গা হয় তাহলে দেশ-বিদেশের পরিচালকরা আরও বেশি করে পুরুলিয়ায় আসবেন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.