বিশ্বদীপ দে: অন্ধকার জেলকুঠুরির মধ্যে পড়ে রয়েছেন একজন মানুষ। অথচ এই সেলের দরজা খোলাই হয়নি কয়েক দশক! দরজার তালায় পড়েছে মরচে। রাতারাতি সেই ১৪৫ নম্বর সেলেই যেন ‘আবির্ভূত’ হয়েছেন ওই আগন্তুক। মাথাভরতি সাদা চুল ঘাড় ছাপিয়ে, কপাল ছাপিয়ে নেমে গিয়েছে। একই ভাবে মুখময় পাকা গোঁফদাড়ির জঙ্গল। গায়ের পোশাক দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এটা বন্দিদেরই পোশাক। কিন্তু এই জেলে তো কেউ এমন বস্তার পোশাক পরে না! তাহলে? কে এই লোকটা? কোথা থেকে এল? প্রশ্ন ছড়াতে থাকে জেলখানা জুড়ে। যাঁরা ইতিমধ্যেই ‘কারাগার’ (Karagar) নামের ওয়েব সিরিজটি (Web Series) দেখে ফেলেছেন, তাঁরা জানেন ওই বন্দির চরিত্রে এমন একজন মানুষ অভিনয় করেছেন, যিনি এই মুহূর্তে এপার-ওপার দুই পারের বাঙালির কাছেই এক ‘সেনসেশন’ হয়ে উঠেছেন। তিনি চঞ্চল চৌধুরী (Chanchal Chowdhury)। তিনি ও তাঁর অভিনীত ‘কারাগার’ নিয়ে এই মুহূর্তে তোলপাড় দুই বাংলা।
ওটিটি মঞ্চে এত ওয়েব সিরিজের ভিড়েও বাংলাদেশের এই সিরিজটি ইতিমধ্যেই এক পৃথক স্থান চিহ্নিত করে ফেলতে পেরেছে। প্রথম পর্ব শেষ হতেই শুরু হয়ে গিয়েছে অধীর প্রতীক্ষা। কবে আসবে পরের পর্ব? আসলে পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শওকি একেবারে শুরু থেকেই দর্শককে ধরে রাখতে সক্ষম। বিশেষ করে প্রথম এপিসোডেই যখন দেখা যায় ৩২৫ জন বন্দির সংখ্যা বেড়ে ৩২৬ হয়ে আচমকাই! আর তারপরই আবিষ্কৃত হয়, রহস্যময় জেলকুঠুরির মধ্যে এক আগন্তুক! সে কথা বলতে পারে না। কানে শোনে না। যেটুকু কথোপকথন, সবই ইশারায়। সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে। এই টান চোরাগোপ্তা বয়ে চলে গোটা সিরিজ জুড়েই। দর্শকও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ‘বিঞ্জ ওয়াচিং’ করে চলে।
আগন্তুক জানিয়ে দেন, ২৫০ বছর ধরেই তিনি জেলবন্দি! সেই পলাশীর যুদ্ধের সময় থেকেই! কেন? কী অপরাধ তাঁর? তিনি নাকি মীর জাফরের হত্যাকারী! স্বাভাবিক ভাবেই এমন আজগুবি কথা কারও বিশ্বাস হয় না। এদিকে জেলে রটে যেতে থাকে একদা এই জেলে থাকা গাজিবাবা আবার ফিরে এসেছেন! তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কয়েদিরা নিঃসন্দেহ। কিন্তু সত্য়িই কি ওই মানুষটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন? নাকি আসলে এর মধ্যে রয়েছে অন্য কোনও রহস্য? এপিসোড থেকে এপিসোডে গল্প নানা রং ছড়ায়। মাহার চরিত্রে তাসনিয়া ফারিন মুগ্ধ করেন। তাঁর মা হাসপাতালে কোমায় আচ্ছন্ন। চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রটি হঠাৎই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপন কথাও ইশারায় বলে ফেলে। জেলার মোস্তাক আহমেদের ছেলে জেলবন্দি। তাকে জেল থেকে বের করে আনতে মরিয়া জেলার সাহেব। এই সব সাবপ্লট সিরিজটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
তবে এই সিরিজটির কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি করে চঞ্চল চৌধুরীর কথাই যে বলতে ইচ্ছে করে। কোনও সংলাপ ছাড়া দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে কেবলই অভিব্যক্তি। উলটো দিকের সংলাপের প্রতিক্রিয়া। এইটুকুই সম্বল ছিল। মূলত চোখের ভাষাকে কাজে লাগিয়েই বাজিমাত করেছেন চঞ্চল। যা দেখে সৃজিত মুখোপাধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘চঞ্চল চৌধুরীর চোখ কোনও অভিনয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত।’ অভিভূত চঞ্চল পরিচালককে এহেন ‘মূল্যায়নে’র জন্য ধন্যবাদ জানালে সৃজিত জানিয়েছেন, ‘আপনার মতো শিল্পীর মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই।… আপনি আমাদের গোটা উপমহাদেশের গর্ব।’ এই উচ্ছ্বাস, এই প্রতিক্রিয়া কেবল যে সৃজিতের নয়, তা নেট ভুবনে উঁকি দিলেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
শুরুর দিকে চঞ্চলের চরিত্রটির মধ্যে এক আশ্চর্য উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। এরপর ধীরে ধীরে পরত খুলতে থাকে কাহিনির। সেই সঙ্গে পালটে যেতে থাকে চোখের ভাষাও। তারপর একেবারে শেষে যখন দর্শকের জন্য এক বড় চমক অপেক্ষা করে থাকে, সেই সময় তাঁর চোখের ভাষাতেও এক অন্য ম্যাজিক। অভিনয় সম্পর্কে মার্কিন অভিনেতা স্যানফোর্ড মেজনারের একটি স্মরণীয় উক্তি রয়েছে। ‘অভিনয় হল কাল্পনিক পরিস্থিতিতে সত্যপূর্ণ আচরণ করা।’ চঞ্চলের অভিনয় সেই কথাই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। ‘আয়নাবাজি’ থেকে সাম্প্রতিক ‘হাওয়া’, রুপোলি পর্দায় চঞ্চলের একের পর এক মাস্টারস্ট্রোকের সাক্ষী হয়েছে দর্শক। আবার ওয়েব সিরিজ ‘তকদির’-এও তিনি চমকে দিয়েছিলেন। ‘কারাগার’ সেই তালিকারই সাম্প্রতিক সংযোজন। যা দর্শকের প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তিনি সত্য়িই এই উপমহাদেশের গর্ব।
কেবল টিভির যুগ আসার আগে দূরদর্শন জমানায় বুস্টার লাগিয়ে এপার বাংলার অনেকেই বাংলাদেশের টিভি নাটক দেখতে চাইতেন। যুগ বদলেছে। এই ঘোর ওটিটি জমানায় সেদেশের ওয়েব সিরিজকে ঘিরে এই মুগ্ধতা সেই স্মৃতিকেই যেন ফিরিয়ে দিল। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের একের পর এক কাজ সত্যিই অবাক করে চলেছে। ‘কারাগার’ সেই প্রত্যাশাকে যেন আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিল। আর চঞ্চল চৌধুরী? তাঁর নতুন কাজ দেখার প্রতীক্ষা এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে। জয়তু চঞ্চল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.