রমেন দাস: বাংলার নামে ভিত্তিহীন কুৎসা ছড়ানোর অভিযোগ ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’(The Diary Of West Bengal) সিনেমার বিরুদ্ধে। তা নিয়ে টলিউডের ‘ক্ষমতাশালী’ তারকারা চুপ কেন? এই প্রশ্ন তোলেন কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। তাতে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তারকারাও। কেউ পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, কেউ আবার অমত জানিয়েছেন। এই মন্তব্যের পালটা জবাবও দিয়েছেন তৃণমূল নেতা।
২০২৩ সালের মে মাসে মুক্তি পেয়েছিল পরিচালক সানোজ মিশ্রর ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ছবির ট্রেলার। ঝলক মুক্তি পেতেই গোটা বাংলায় বিতর্ক ছড়িয়েছিল। এমনকী, সেই সময় রাজ্যের পুলিশ পরিচালককে বাংলার সম্মানকে ক্ষুন্ন করার অভিযোগে আইনি নোটিসও পাঠিয়েছিল। তবে শুক্রবার সিনেমা হলে মুক্তি পায় ছবিটি। এদিন সোশাল মিডিয়ায় কুণাল ঘোষ লেখেন, “আফসোস লাগে। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বহু পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা এমন কিছু রাজনৈতিক ছবি করেন যা সমাজে বিজেপির পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করে। এবার তো বাংলা নিয়েও কুৎসার ঝুলি আসছে। অথচ টলিগঞ্জের বাবু/বিবিরা, যাঁরা মমতাদির পাশে, দলে, মঞ্চে, ছবির ফ্রেমে থাকেন, তাঁরা নিজেদের ইমেজ গড়তে, পেশার সৌজন্য নিয়ে ব্যস্ত। দিদির পাশে ছবি দিয়ে গুরুত্ব বাড়ান, কিন্তু মমতাদির বায়োপিক বা তৃণমূলের পক্ষে বার্তা যেতে পারে, এমন কোনও সিনেমার কথা তাঁরা ভাবেন না। বরং টেকনিশিয়ানরা অনেক বেশি দরদি। এঁরা অনেক বড় নাম হতে পারেন, কিন্তু এঁদের অনেকেই দলের বোঝা। দলের সুসময়ে এঁরা হাত নেড়ে সামনে থাকেন। একটু বিতর্কিত ইস্যুতে দল পড়লেই এঁরা মুখ খোলা বন্ধ করেন। সামনে থেকে মানুষকে বোঝানোর কাজে এঁদের পাওয়া যায় না। দল না বললে কর্মসূচি, টুইটেও পাওয়া যায় না। এই যে এবার বাংলাকে কুৎসিত আক্রমণ করে ছবি আসছে, সারা দেশে/বিদেশে বাংলার ইমেজ খারাপ করার চক্রান্ত, এঁরা জানেন না? অথচ এঁরা তার পালটা কিছু করবেন না, করতে চাইবেন না। এঁদের কেউ কেউ আন্তরিক। বাকি ক্ষমতাশালী তারকাদের নিয়ে দল ভাবুক।”
এবিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে ঋদ্ধি সেন বলেন, “এই বক্তব্যটা অবাস্তব মনে হল। এখন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে এবং সেটার আজকে ২০ দিন ক্রস করে গিয়েছে। সেখানে আজকে এখনও সুবিচার তো হয়নি সেটার সঙ্গে সঙ্গে মানে, ঘটনার ভয়াবহতা ছাড়াও প্রশাসনিক যে ব্যর্থতা প্রথম দিন থেকে দেখা গেছে এই রাজ্য সরকারের সেই প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়েও কোনও আলোচনা বা কোনও উত্তর রাজ্য সরকারের পক্ষ আমাদের কাছে মানে নাগরিকরা যে প্রশ্ন তুলেছে তার কোনও উত্তর আসেনি। সুতরাং সেই দুটো জিনিস সবথেকে জরুরি। এখন এক হচ্ছে সুবিচার। যেটা সিবিআইয়ের কাছে মামলা গেছে। সেটা ছাড়া যে প্রথম দুটো-তিনটে দিনে রাজ্য সরকার যা যা করেছে সেটা সন্দীপ ঘোষকে আবার নতুন করে ট্রান্সফার করা থেকে শুরু করে বা পুলিশের প্রথম দু-তিন দিনের যে ব্যর্থতা তো সেই প্রশ্নগুলো। তার উত্তর এখনও সরকারের কাছ থেকে আসেনি। সুতরাং সেইরকম একটা সময়ে এত রকম জলঘোলা করছে। তার মধ্যে যদি রাজ্য সরকার এই সমস্ত ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেন, এই সমস্ত কথা বলেন বা এতে লিপ্ত থাকেন তাহলে সেটা কিন্তু কোনওভাবে সমর্থনযোগ্য তো নয়ই আরও ক্ষতিকারক হচ্ছে। আসল ঘটনা থেকে যত রকমের চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এখন হবে, চেষ্টার বিরুদ্ধে নাগরিকরা প্রতিবাদ করে উঠবে।”
পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর কথায়, “হিন্দি ছবি যে আসছে তা আমার জানা ছিল না। জানলাম সকালে। ছবি দেখিওনি, কী জিনিস সেটাও জানি না। আমি যখন মমতাদি রেলমন্ত্রী ছিল সেই সময় তাঁকে নিয়ে ‘প্রতিবাদ’ ছবি করেছি। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর নিয়ে ‘তুলকালাম’ করেছি। আমি আজও করতে পারি। কোনও প্রযোজককে সাপোর্ট করতে হবে। বরং আজকের প্রচারে লোক দেখতে যাবে… টলিগঞ্জের সবাই দিদির পাশে আছে। আমরা সবসময় আছি।
রুদ্রনীল ঘোষের বক্তব্য, “দলের কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে। এবার কুণাল ঘোষের কথায় বেরিয়ে পড়ল এই জনবিক্ষোভ যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে তৃণমূল সরকারের পজিশন টলমল, গদি টলমল এবং যে যে শিল্পীদের তাঁদের রাজ্য সরকার বিভিন্ন পদ, সুযোগ, সম্মান দিয়েছিল তাঁরাও তৃণমূলের পক্ষে নেই কারণ তাঁরা মানবিকতার পক্ষে সরে এসেছেন। কুণালবাবুর যে বিষয়ে অভিমান হয়েছে খুব স্বাভাবিক তিনি এতদিন ধরে যে যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাঁর দলের হয়ে মঞ্চ ভরাতে দেখছেন, নির্বাচনী প্রচারে যেতে দেখছেন, রাজ্য সরকারের নানা দুর্বলতায় যেভাবে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, বিরক্ত হয়েছিল সেই ক্ষততে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বা তৃণমূলের মঞ্চে সেই শিল্পী, লেখক, কবি, পরিচালক তাঁদেরকে দেখিয়ে অদ্ভুত একটা মলম দেওয়ার চেষ্টা করে মানুষের ভোট তৃণমূল পেত। এটাকেও অস্বীকার করতে পারবে না যে আমাদের রাজ্য শিল্পী, লেখক, কবিদের ভালোবাসে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কুণালবাবু বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে এরা নাকি সবাই আলোকিত হত। আমার মনে হয় কুণালবাবু নিজের সঙ্গে বাকি সেলফ আইডেনটিটি থাকা পাওয়ারফুল পরিচালক, শিল্পী, লেখক, কবিদের গুলিয়ে ফেলেছেন। কুণালবাবু তৃণমূলের তকমা কেটে গেলে তিনি আর হয়তো স্বমহিমায় উজ্জ্বল হতে পারবেন না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে সৌজন্য দেখাতে যে শিল্পীরা বসতেন, যাঁদের মধ্যে তৃণমূলের বিধায়ক, সাংসদ আছেন এবং অনেকেই আছেন। তাঁরা কিন্তু যেখানেই বসুন না কেন তাঁরা নিজেদের আলোয় আলোকিত। কুণালবাবুর এই কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে তৃণমূলের অবস্থা খুব খারাপ এবং এতটাই পরিকল্পিত অপরাধ এই সরকার করেছে তাতে কেউ আর তৃণমূলের পাশে গিয়ে মানুষের ঘৃণার পাত্র হতে চাইছে না। পুরো শিল্পীকুলকে অপমান করেছেন। অরিজিৎ সিংকেও অসম্মান করেছেন। মানুষ এদের সঙ্গে নেই।
অভিনেতা-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় জানান, শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ও বিরোধী দুই পক্ষের অনেকেই তাঁর বন্ধুস্থানীয়। এর পরই তিনি বলেন, “আমার দু-তিনটি কথা বলার আছে। যাঁরা শাসকদলের পদাধিকারী তাঁরা কেউ নিশ্চয়ই ওঁর অঙ্গুলিহেলনে চলবে না। তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের ভাবনাচিন্তা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেন আমি ধরে নিচ্ছি। তিনি যদি তুলনা টানেন যে বম্বেতে বিজেপির হয়ে অনেকে প্রপাগান্ডা করেন তাহলে এখানে শাসক দলের মানে উনি যে দলের মুখপাত্র সেই দলের হয়ে কেউ কিছু করে না, সেখানে আমার যে প্রথম প্রশ্নটা উনি কি চান বম্বেতে অনেক শিল্পী-পরিচালকরা খুব নির্লজ্জ প্রপাগান্ডা করেন যেটা দেখে সিনেমামহলে রীতিমতো হাসাহাসি হয় এবং আমার মতো লোকেরা জিনিসটা অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখে সেটা এখানে হোক? সমালোচনা করি এই প্রপাগান্ডার। যদি প্রপাগান্ডাতেই সবকিছু হত তাহলে তো সত্যিই ‘আব কি বার চারশো পার’ হয়ে যেত। তা যে হয়নি সেটা নির্বাচনে ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং কুণালবাবু যদি মনে করেন সবাইকে শাসকদলের প্রপাগান্ডা করা উচিত। তাহলে তিনি তো সেই গড্ডালিকা প্রবাই ওনাদের গা ভাসাতে বলছেন। সেটা কি ঠিক হবে? এই সময়টা খুব স্পর্শকাতর তো! নিশ্চয়ই কোনও ভুল-ত্রুটি রয়েছে সিস্টেমের মধ্যে নাহলে এটা ঘটল কেন? সেই ভুল-ত্রুটির জবাব কিন্তু মানুষ চাইছেন সেই জন্যই তাঁরা রাস্তায় নামছেন। বিরোধীরা বিরোধীদের কাজ করছেন তাঁরা তো অবশ্যই করবেন। এটা রাজনীতি করার সময় তাঁদের। কিন্তু যাঁরা বিরোধী রাজনীতি করেন না সেই লক্ষ লক্ষ মানুষও কিন্তু রাস্তায় নামছেন। এমন সময় একজন দলের মুখপাত্র হিসেবে কী বলছেন এটা একটু ভেবে বললে ভালো হয় না? এতে লাভের থেকে ক্ষতিটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না! বিশেষ করে কুণালবাবুর এমনিতেই বিশ্বাসযোগ্যতা একটু টলমল, বিশেষ করে সাধারণ নির্বাচনের আগে উনি প্রায় দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন আবার ফিরেছেন… জন সমর্থন না হারনোর পথ প্রশস্ত না করলেই বোধ হয় ভালো করবেন। আরেকটা মজার ব্যপার বলি। উনি অনেককে দাগিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজে যে পক্ষে থাকি বলি বিশ্বাস, নিজেকে গর্বিতভাবে সুশীল সমাজের অংশ মনে করি। নন্দীগ্রামের সমর্থন করায় বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ বলা হয়েছিল। NRC, ‘অন্য কোথাও যাব না’ক প্রতিবাদ করা হয় ‘চটিচাটা’ তকমাও জুটেছিল। সেগুলোকে যেমন অন্যায় বলে মনে করেছিলাম তাই জন্য গান বেঁধেছিলাম, তাই জন্য রাস্তায় নেমেছিলাম আজকে আর জি করের ঘটনায় কিন্তু সেরকম ভাবেই সুশীল সমাজ কোনও রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া রাস্তায় নামছে, গান বাঁধছে। মজার ব্যাপার হল এই বিচার চাওয়ার ফলে আজকে আমার রাজ্যের শাসক দল কিন্তু ঠিক বিরোধী দলের মতোই সহজে রাম-বাম বলে দিচ্ছেন, এতে মেরুকরণটা বাড়ছে।
এদিকে অভিনেত্রী তথা বিধায়ক লাভলি মৈত্র মনে করেন কুণাল ঘোষ যা বলেছেন তা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। পরিচালক সুদেষ্ণা রায়ের বক্তব্য, তারকাদের আমন্ত্রণ করা হয় বলেই তাঁরা কোনও অনুষ্ঠানে যান। সাংসদ তথা অভিনেত্রী শতাব্দী রায় অবশ্য কুণাল ঘোষের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। সোহিনী সেনগুপ্ত মনে করেন এই সময় লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে আর কর কাণ্ডের বিচারের দাবিতেই লক্ষ্য স্থির হওয়া উচিত। সায়ন্তিকার বক্তব্য, যে পরিপ্রেক্ষিতে কুণাল ঘোষ মন্তব্যটি করেছেন সেটি ভুল নয়। এমন প্ররোচনামূলক সিনেমা রিলিজ করা উচিত নয়।
এদিকে কৌশিক সেনের বক্তব্য, “আমার কলিগদের সম্পর্কে কথা উঠেছে। তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করছে। সেটা কুণালবাবুর বোঝা উচিত বা জানা উচিত। এই আর জি করের ঘটনায় গোটা দেশের মানুষ রিয়্যাক্ট করেছে। তাঁরাও মানুষ, তাঁরাও রিয়্যাক্ট করেছেন। আমি নিজে তিনটে অরাজনৈতিক মিছিলে হেঁটেছি। বাকিরাও তা করেছে। মনে হয় না সঠিক কথা বলছেন।”
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে কুণাল ঘোষ বলেন, “আমি আগেও আসল ইস্যু থেকে সরিনি। কৌশিক সেনদের বলে দেবেন। যেদিনকে আর জি করের প্রথম ঘটনাটা জানা যায় বা জানা যায় সেই সময় সকলের থেকে বেশি এগিয়ে আমি নিজে টুইট করেছিলাম যে দোষীদের শাস্তি চাই এবং যদি কেউ আড়াল করে থাকে তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। এই কুণাল ঘোষ করেছিল কাজটা এবং গোটা বিষয়টা থেকে আমি এক ইঞ্চিও সরিনি। কিন্তু আজকে সারা ভারতে একটা ছবি রিলিজ হয়েছে সেখানে বাংলা সম্পর্কে কুৎসিততম প্রচার হয়েছে। ভিত্তিহীন, প্ররোচনামূলক এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচার হয়েছে। আমার বক্তব্য, ওইখানে এর সঙ্গে আর জি করের কোনও সম্পর্ক নেই। এবং এই ছবিটাও সম্ভবত আর জি করের আগে তৈরি হয়েছে। ফলে আর জি কর থেকে আমি নজর ঘোরাচ্ছি এই ধরনের ধারণা বা কথাবার্তাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। আমার বক্তব্য বাংলা নিয়ে এরকম একটা কুৎসিত প্রচারের ছবি করেছে, বাংলার টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির প্রতিবাদ জানানো উচিত পাশাপাশি আমার দলের যাঁরা এই টালিগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত বড় নাম প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, যাঁরা আমার দলের সঙ্গেও জড়িত তাঁদের তো আরও বেশি করে দায়িত্ব এই কুৎসার প্রতিবাদ করা এর সঙ্গে মূল ইস্যু থেকে নজর ঘোরানো, আর জি কর থেকে নজর ঘোরানো এগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। ছবিটা আজকে রিলিজ করছে বলে আজকে আমি প্রতিবাদ করেছি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.