মলয় কুণ্ডু: এলাটিং বেলাটিং। ইকিড় মিকিড়। মানেহীন, তবু মনগহীন। বেলাশুরুর ছন্দ মেলানো দিনে কে-ই বা ব্যাকরণ খুঁজতে চেয়েছিল। কোভিড লকডাউনের বেলাশেষে দুলছে শরীর। ফের পায়ে পা মেলানো। কোমরে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকার মুদ্রায় বাঙালি এখন বিভোর। সামাজিক মাধ্যমের যত ধরনের ধারা এখন হাতের সামনে, সেখানে চোখ রাখলেই কানে ঢুকছে ইনি বিনি টাপা টিনি। ফি বছর ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত শরীর, মনে শুধুই টাপা টিনি (Tapa Tini) ভাইরাস!
ইউটিউবে হিট লক্ষ লক্ষ। ফেসবুকে শেয়ারের সংখ্যা বাড়ছে নিত্যদিন লাফিয়ে লাফিয়ে। রিলস, শর্টস থেকে ইনস্টা, সর্বত্রই ইনি বিনি টাপা টিনি, টানা টুনি টাসা…। একে অন্যকে ‘টাপা টিনি চ্যালেঞ্জ’, তাও আছে। আমজনতা থেকে সেলিব্রিটি, বুড়ো থেকে ছুঁড়ো, কেউ বাদ নেই এমন ছন্দে নেচে উঠতে। সেই ভিডিওতে উপচে পড়ছে নেট তরঙ্গের দেওয়াল। এতসব না বলে এক কথায় যাকে বলে, ‘ভাইরাল’।
বাঙালির শব্দকল্পদ্রুমে নয়া সংযোজন নিঃসন্দেহে টাপা টিনি (Tapa Tini)। সেই বাক্যবন্ধনীর সঙ্গে যদি হালকা করে মেশে মহুয়ার গন্ধ তো নেশা লাগতে আর বাকি থাকার কথা নয়। সেটাই হয়েছে। ভাইরালের শেষতম সংযোজন ছিল কাঁচা বাদাম। হলিউড, বলিউড, টলিউড এক রাউন্ড নেচে না নিলে যে ঠাকুর পাপ দেবে টাইপের অবস্থা।
তারও আগে সেই দয়াল বাবা কলা খাবা কিংবা টুনির মা, টুম্পা সোনাও বঙ্গ চত্বর ছেড়ে এদিক-ওদিক পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু সে সব সিনেমার গান ছিল না। সিনেমার গান ভাইরাল হয়ে ওঠেনি রঙ্গবতীর আগে। কিন্তু টাপা টিনি পাওয়ার প্লে’র শুরু থেকেই মারকাটারি। টাপা টিনির মতো ডুপারের মানে জানা না থাকলেও বলতে বাধা নেই, এ একেবারে সুপার-ডুপার হিট, থুড়ি ভাইরাল।
এখন আমেরিকা সফররত এ গানের জন্মদাতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে হোয়াটসঅ্যাপ কলে ধরতেই বললেন, “গান হিট হয় জানতাম। ভাইরালও হয়! আগে ক্যাসেটের দোকানে দোকানে গান বাজলেই বুঝতাম হিট। শখ ছিল নিজের গানও হাতিবাগান মোড়ের কোনও দোকানে বাজবে।” সে তো বোঝা গেল। কিন্তু প্রাথমিক আবেগ কাটলে লোকে তো জানতে চাইবে এ কি সব লিখলেন? ইনি বিনি টাপা টিনি, উলোকুটি ধুলোকুটি, শব্দ নিয়ে এ কেমন কাটাকুটি খেলা?
রহস্য ফাঁস করলেন অনিন্দ্য, “বছর চারেক আগে গানটা শুরু করেছিলাম। সিনেমার জন্য গান। শান্তিনিকেতনে লোকেশন। সাঁওতালি গান হতে পারে। কিন্তু এই ধরনের গান এত ব্যবহার হয়েছে, যে অন্য কিছু করার প্ল্যান করেছিলাম। প্রথমে মুখড়াটা, আশ্বিন ফাগুন মাসে পরানঘাসে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে… লিখে ফেলি। সেটা সবার পছন্দ হয়। সুরটাও সাঁওতালি ধরনের। কিন্তু কি শব্দ বসাবো এর আগে, সেটা ভাবছিলাম।” তারপর? “তখনই কল্যাণী দত্তর ‘প্রবাদমালা’ বইটা ওলটাচ্ছিলাম। অদ্ভুত সব শব্দ রয়েছে। যার হয়তো কোনও মানে নেই, কিন্তু যার উচ্চারণ, ধ্বনি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। লোকায়ত শব্দ, যার একটা সাংস্কৃতিক ভার রয়েছে আমাদের জীবনে। যেমন উলো কুটি, ধুলো কুটি শব্দের সঙ্গে বিয়ের অনুষঙ্গ রয়েছে।”
‘বেলাশুরু’ (Belasuru) সিনেমার এই গানে শোনা যাচ্ছে ইমন চক্রবর্তী, উপালি চট্টোপাধ্যায় ও অনন্যা (খ্যাঁদা) ভট্টাচার্যর গলা। ইমনের কথায়, “গানটার মধ্যে একটা ইনোসেন্স রয়েছে। সবাই নিজেদের কানেক্ট করতে পারছে। নাহলে একটা বাচ্চাও নাচছে, নব্বই বছরের মানুষও নাচছে। এটা হয় না!” ভাইরাল হওয়ার জন্য কোনও রেসিপি? সুরকার ও লেখক অনিন্দ্যর মনে হয়েছে, “একটা ডিপ্রেসিং টাইম পার করে এসেছে সবাই। সেখানে এই গানটা নির্মল আনন্দ দিচ্ছে। কোথাও হয়তো বেঁচে থাকার কথা বলছে।”
ভাইরাল নিয়ে দু’কথা বলেছেন শিলাজিৎও, “ভাইরাল এখনকার শব্দ। তখন সুপার-ডুপার হিট বলত। তার আগে বলত, হেব্বি চলেছে। ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা, এখনকার হিসাবে তো ভাইরালই। শুধু শব্দটা বদলে গিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত লক্ষ লোক দেখেছে। তখন কত বিক্রি হত, সেই হিসাবে হত। যে সমস্ত গান ভাইরাল হচ্ছে, দোষে-গুণে মিলে তার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু ইন্টারেস্টিং আছে। যার জন্য সেটা মানুষ গাইছে। এতো আর ঘাড় ধরে গান শোনানো হচ্ছে না।”
কলার টিউনে সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের এখনও বাজে এক সময়ের ভাইরাল রঙ্গবতী। আচ্ছা, ভাইরাল কেন হয়? “ভাইরাল আসলে হিটেরই একটা নতুন শব্দ। সুপারহিট কথাটার নতুন কয়েনেজ ভাইরাল হওয়া। বারান্দায় রোদ্দুর ভাইরাল হয়নি, সুপারহিট হয়েছে। কাঁচা বাদাম কোনও প্রমোশন ছাড়াই লোকের ভাল লেগেছে। রঙ্গবতী বা টাপা টিনির ক্ষেত্রে প্রমোশনাল ব্যাকআপও আছে। চার-পাঁচ লাখের পর গিয়ে বোঝা যাবে সেটা স্ট্যাগন্যান্ট হয়ে গেল, না লোকের তখনও ভাল লাগছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.