সদ্য cannes film festival থেকে ফিরেছেন ঢাকায়। তাঁর ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ প্রশংসার ঝড় তুলেছিল ফ্রান্সের শহরে। আজকাল সেই স্বপ্নেই ডুবে রয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিরিজ ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র রহস্যময়ী অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন। (Azmeri Haque Badhon)যাঁকে নিয়ে জোর চর্চা এখন এপার বাংলাতেও। দেরি না করে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ফোনে ধরে ফেলল তাঁকে। কথা বললেন আকাশ মিশ্র।
১) Cannes সফর কেমন ছিল?
আজমেরি: অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার দেশের প্রথম একটা সিনেমা যা কান চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছে। সেই ছবির লিড কাস্ট হিসেবে আমি কানে যেতে পেরেছি। পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো। যখনই ছবিগুলো দেখছি, বিশ্বাসই হচ্ছে না! আমি ওখানে ছিলাম! একজন শিল্পী হিসেবে ওখানে যে সম্মান পেয়েছি সেটা সারাজীবন মনে রাখার মতো। প্রিমিয়ারে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (Rehana maryam noor) ছবিটা দেখার পর সবাই দাঁড়িয়ে প্রশংসায় করেছিল। সেটা সত্যিই না ভোলার মতো একটা ঘটনা।
2) কার কার সঙ্গে দেখা হল সেখানে?
আজমেরি: শ্যারন স্টোন (Sharon Stone), বিল মারি (Bill Murray)। প্রচুর বিখ্যাত সব মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এদের তো আমরা সিনেমার পর্দায় দেখেই অভ্যস্ত। তাঁরাই চোখের সামনে। এখানে একটা ঘটনার কথা বলতে চাই। বিল মারিকে দেখে আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওর সঙ্গে আলাপ করার। তারপর হঠাৎ বিল নিজে থেকে এসেই আমাদের সঙ্গে আলাপ করে। এত বড় একজন স্টার, অথচ এত মাটির মানুষ। বিল আমাকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। একসঙ্গে আমরা ছবিও তুলেছি। আমি কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারকদের সঙ্গেও দেখা করে কথা বলেছি। ‘রেহানা’ নিয়ে কথা হয়েছে। বিচারকরা বার বার বলছিলেন, আমার কাজ খুব ভাল লেগেছে তাঁদের। এটা অনেক বড় পাওয়া।
View this post on Instagram
৩) কানের রেড কার্পেটে তো আপনার জামদানি শাড়ি সুপারহিট। ওখানে যাওয়ার আগে থেকে পোশাক নিয়ে কোনও প্ল্যান ছিল?
আজমেরি: কোনও কিছু প্ল্যান ছিল না। কানে যাওয়াটাই একপ্রকার হুট করে। করোনা আবহে বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে প্রচুর বিধিনিষেধ ছিল। আমরা যেদিন ভিসা পেলাম। তার পরের দিন সকালেই ফ্লাইট ছিল। তাই প্ল্যান করার সময়ই ছিল না। জামদানি পরব কিনা, তা নিয়েও বিশেষ কোন প্ল্যান ছিল না। যেহেতু এই ছবি রেহানাকে নিয়েই। বলা যায়, এই ছবির ফেস আমি। তাই অতিরিক্ত চাপ তো কাঁধের উপর ছিলই। তার উপর বাংলাদেশের কোনও ছবি প্রথম কানে। প্রথম কোনও অভিনেত্রী কানের রেড কার্পেটে। সবার তো নজর থাকবেই, আমি কী পরব? কী পরব না? জামদানি ছাড়া আমার আর কিছুই মাথায় আসেনি। এটা তো আমার দেশের ফেব্রিক। ‘আরঙ’ ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওরা দ্রুত আমাকে তৈরি করে দিয়েছিল পোশাক। বিশেষ করে ব্লাউজ। তবে আমি মসলিনও পরেছি। সেটাও আমার দেশের ফেব্রিক। আমি সচেতনভাবেই দেশকে তুলতে ধরতে চেয়েছিলাম। বিশেষ করে মহিলা ডিজাইনারদের কাজকে।
View this post on Instagram
৪) কানে এমন কোনও মুহূর্ত যা সারাজীবন সঙ্গে রাখবেন..
আজমেরি: ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখে কানের দর্শকরা প্রশংসা করেন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। চোখের সামনে পুরো জীবনটা উঠে এসেছিল। আমার পরিশ্রমের দাম ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন। ছবি দেখে একজন বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই পাওনা সারা জীবনের।
৫) বাংলাদেশের মানুষ কী বলছে?
আজমেরি: দেখুন, যখন দেশের কোনও বিষয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যখন বিশাল সম্মান লাভ করে তখন ওই বিষয় একটা টিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাংলাদেশের মানুষেরা তো বাহবা দিয়েছেনই। তবে আমার দেশের পাশাপাশি ভারত থেকেও খুব প্রশংসা পেয়েছি। আসলে, ছবিটা দেশ, কাল, সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষার ছবির সাফল্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬) রেহানার অফার কীভাবে পেয়েছিলেন?
আজমেরি: অফারটা অদ্ভুত সময়ে আমার কাছে আসে। তখন আমি ব্যক্তিগত এক বড় সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার মেয়েকে নিয়ে আদালতে যাই। আমি একাই নিজের সন্তানকে বড় করতে চেয়েছিলাম। মা হিসেবে সন্তানের প্রতি আইনের অধিকার চেয়েছিলাম। কিন্তু ইসলামিক আইনে এটা একেবারেই নেই। তবে সিভিল আইনে সন্তানের ওয়েলবিয়িংয়ের জন্য শেষমেশ আমাকে গার্ডিয়ানশিপটা দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর থেকেই আমার দর্শন, জীবন বাঁচার নিয়মগুলো বদলে যায়। বিশেষ করে আমার কাজ করার স্টাইলেও পরিবর্তন আসে। আসলে, এদেশে সেভাবে নারীকেন্দ্রিক গল্প নিয়ে কাজ হয় না। তার উপর এদেশে বয়স ৩০ হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করার থাকে না। আমার ততদিনে ৩৪ হয়ে গিয়েছে। এখন তো আমার ৩৭। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি নতুন করে, অন্যরকম কাজ করতে চাই। সেটা অনেককে হতবাক করেছিল। আমি কাজটা তখন টাকার জন্যই করছিলাম। আর যাঁদের কাছে ভাল কাজ চেয়েছিলাম, তাঁরা কেউ-ই সিরিয়াসলি নেননি। তবে রেহানা মরিয়ম নূর-এর সময় আমি অডিশন দিই। এই ছবির পরিচালক আবদুল্লা মহম্মদ সাদ এবং গোটা টিমের মধ্যে একটা সততা দেখতে পেয়েছিলাম। যেটা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল।
৭) সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিরিজ ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র জন্য ইতিমধ্যেই কলকাতায় আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছে…
আজমেরি: এর পিছনে মজার একটা গল্প আছে। সৃজিতের সঙ্গে আমার আগে কোনওদিনই পরিচয় হয়নি। কখনও যোগাযোগই হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাকে যোগাযোগ করে। প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নাম করে কেউ ফেক প্রোফাইল থেকে এমনটা করছে। হঠাৎ করে কেনই বা সৃজিতের মতো একজন পরিচালক আমাকে চিনবেন, কেনই বা আমাকে তাঁর ওয়েব সিরিজে নেবেন? ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়। চটজলদি পিডিএফ ডাউনলোড করে বইটা পড়ে ফেলি। সৃজিতের মতো পরিচালক এই চরিত্রে আমাকে ভেবেছেন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছেন সৃজিত। এই চরিত্রটাকে ঠিক করে বোঝানোর ক্ষেত্রে। আসলে আমার কাছে ভাল অভিনেতা বলে কিছু নেই, ভাল পরিচালকে আমি বিশ্বাস করি। একজন ভাল পরিচালক, অভিনেতার থেকে সেরাটা বের করে নেন। আমি তাই পুরোটাই বিশ্বাস করেছি সৃজিতের উপর। সৃজিত অনলাইনে আমার সঙ্গে ছবি নিয়ে আলোচনা করতেন। ওখানেও যখন গিয়েছিলাম, তখন সারাদিন হাতে চিত্রনাট্য থাকত আমার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সৃজিত আমার সঙ্গে রিহার্সাল করেছেন। আসলে আমি নিজেকে ভাল অভিনেত্রী বলব না। বরং পরিশ্রমী অভিনেত্রী বলব।
View this post on Instagram
৮) তাহলে এই ছবির জন্য হ্যাঁ করার কারণ, শুধুই সৃজিত?
আজমেরি: অবশ্যই সৃজিত একটা প্রধান কারণ। দ্বিতীয়টা হল, গল্প। মুস্কান জুবেরির চরিত্রটা করার লোভ কোনও অভিনেত্রী সামলাতে পারবেন কিনা জানি না। তার উপর আমাদের এখানে নারী প্রধান গল্প নিয়ে একদম ছবি হয় না। হলেও, সেটা নয় তো খুব আদর্শবাদী নারী চরিত্র বা ডাইনি নেগেটিভ চরিত্র। এর মাঝে যে একটা গ্রে পার্ট থাকে, সেটা নিয়ে কোনও কাজই হয় না। লেখক মহম্মদ নাজিমুদ্দিন এরকম একটা গল্প লিখেছেন, এরকম একটা চরিত্রে জন্ম দিয়েছেন, সেটার জন্য আমি তাঁকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই।
৯) ট্রেলার দেখে যা বোঝা যাচ্ছে সৃজিতের সিরিজে আপনিই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। চরিত্রটা নিয়ে যদি একটু বলেন।
আজমেরি: হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এই সিরিজের গল্প একেবারেই আমাকে কেন্দ্র করে তাই বাড়তি একটা চাপ তো ছিলই। প্রচুর রিহার্সাল করেছি। এছাড়াও আমার মনে হয়, মুস্কান চরিত্রটাকে আমি অনেক বেশি বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে মুস্কানকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। এই কারণেই হয়তো মুস্কান চরিত্র আমার কাছে সহজ হয়ে গিয়েছিল।
১০) ভারতের বাংলা ও হিন্দি ছবিতে কাজ করতে চান? কার কার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে?
আজমেরি: শুধু বাংলা বা হিন্দি ছবি নয়। আমি চাই ভাল, সৎ, পরিশ্রমী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে চাই। ভাল চরিত্রে অভিনয় করতে চাই।
১১) নতুন কোনও প্রজেক্ট…
আজমেরি: একটা অডিশনের কথা হয়েছে। তবে তা খুব প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই, আমার যখন ৩৪ বছর বয়স ছিল, তখন থেকেই আমি নিজের মতো করে বাঁচব বলে ঠিক করেছিলাম। এখন তো আমার বয়স ৩৭। এই বয়সে, এক নারী কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের মতো করে বেঁচে আছে, সেটা যদি অন্যকে অনুপ্রাণিত করে। তাই একটু অন্যরকম কাজ করতে চাই। সেই কাজের মধ্যে দিয়েই লড়াইটা জিততে চাই। এখন আমার সাফল্য লোকে দেখছে। এর নেপথ্যে যে একটা না পাওয়ার সংগ্রাম আছে, সেটা যেন সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। আপাতত, এটাই আমার দর্শন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.