অঞ্জন দত্তের প্রথম ছবি ‘বড়া দিন’-এ ছিলেন ইরফান খান, সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করলেন পরিচালক অঞ্জন দত্ত। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
আমি যখন ইরফান খানের সঙ্গে ‘বড়া দিন’ করি, তার আগে ও কয়েকটা ছবি করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গোবিন্দ নিহালনির ‘দৃষ্টি’ এবং তপন সিনহার ‘এক ডক্টর কী মৌত’। তখন থেকেই দেখেছি ইরফান খুব খাটত। মেথড অ্যাক্টর বলতে যা বোঝায়। ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিল। আমার ধারণা সেটা শেষ দিন পর্যন্ত তাই ছিল।
ওর কোনও খারাপ কাজ দেখিনি। মহেশ ভাটের ‘জোশ’ নামের একটা সাধারণ ছবিতেও কী অসাধারণ! ছবি ভাল না হলেও ইরফানের অভিনয় সব সময়ই প্রশংসনীয়। আমার কাছে ‘হি ওয়াজ এ ভেরি গুড ফার্স্ট টেক অ্যাক্টর’। প্রথম টেকেই সবটা দিয়ে দিত। সাধারনত সেকেন্ড টেক দিতে পছন্দ করত না। অন্য অভিনেতার ভুলে সেকেন্ড টেক দিতে হলে ঘ্যানঘ্যান করত। আমি বুঝতে পারতাম ও প্রথমেই নিজের সেরাটা দিচ্ছে। ইরফান এমন একজন অভিনেতা যে সবসময় তৈরি থাকত। অন্য অনেকে হয়ত দুটো, তিনটে টেকের পর ওয়ার্ম আপ করত। কিন্তু ইরফানের সেই সময়টা লাগত না।
‘বড়া দিন’- এও যেটুকু করেছিল তার জন্য খুব খেটেছিল। সেটা ছিল ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে কি ১৯৯৬-এর শুরু। কিন্তু প্রোডিউসারের সঙ্গে ঝামেলার কারণে ওর কিছু দৃশ্য আমাকে বাদ দিয়ে দিতে হয়। ওর খুবই খারাপ লেগেছিল। আমারও। আমার মনে আছে, একটা দৃশ্য ছিল যেখানে অভিনেত্রী তারা দেশপান্ডের সঙ্গে ওর ঝগড়া হবে। তারা আয়নার সামনে বসে সাজছে। ইরফান আয়নাতে গিয়ে একটা ঘুসি মারবে। সিনটা করার সময় সত্যি সত্যি ঘুসি মেরে বসল। কাঁচ ভেঙে চুরমার । হাত কেটে গিয়ে সে এক কাণ্ড! পরের সিন করতে পারবে কী না ঠিক নেই। ইরফান এমন একজন অভিনেতা যে খুব আনপ্রেডিক্টেবল। একজন বেপরোয়া, নির্লজ্জ অভিনেতা। দুঃখের বিষয় সেই দৃশ্য আমাকে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয় প্রযোজকের চাপে। গান , টান ঢোকাতে হয়। ছবিটা থেকে আমিও বেরিয়ে যাবো ভেবেছিলাম।
‘রঞ্জনা…’ দেখে ফোন করে এটা হিন্দিতে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল।
যাই হোক, তবে ইরফান খানের সঙ্গে এই ছবির আগে একটা সিরিজে কাজ করেছিলাম। দূরদর্শন-এর জন্য ১৯৯৫ সালে ‘অলিভার টুইস্ট’- এর একটা গল্প নিয়ে ‘রাজু’ নামের একটা মিউজিকাল করেছিলাম। তখন ও টিভির জন্য কাজ করছে। মারিয়া গোরেটি, গুফি পেন্টাল, অঞ্জন শ্রীবাস্তব আর ইরফান ছিল। কিন্তু এটা কখনও এয়ার হয়নি। এরপর ওর সঙ্গে (বোধহয় জি টিভির জন্য) ‘নকাব’ বলে একটা ৬ এপিসোডের সিরিজ করি। এক একজন পরিচালক এক একটা গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ট্রাভেলগ তৈরি করবেন। আমার গোয়েন্দা ছিল ইরফান খান। শুটিং হয়েছিল সাউথে। মহাবলিপুরাম, চেন্নাই বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়। আমার সব সময় মনে হয়েছে ওকে দিয়ে আইকনিক চরিত্রে অভিনয় করানো যেতে পারে। হিন্দিতে ফেলুদা হলে ইরফানকে মানাতো ভাল। হি হ্যাড এ স্ট্রং পারসোনা।
‘পান সিং তোমার’-এও পাওয়ারফুল, আবার ‘নেমসেক’-এ অশোক গাঙ্গুলির চরিত্রেও। কী অদ্ভুত পরিহাস, এই চরিত্রের জন্য মীরা নায়ার আমাকেও ভেবেছিলেন। অবশ্য আমার বয়েস একটু বেশি ছিল। আর ইরফান অবশ্যই তখন তরুণ এবং নামকরা অভিনেতা। কলকাতায় অনেকের স্ক্রিন টেস্ট হয়েছিল সেই সময়। তখন আমি ‘যুগান্ত’ করেছি। তবে ‘নেমসেক’ ছবিতে ইরফান ওয়াজ ব্রিলিয়ান্ট! আমি ওর মারা যাওয়ার দৃশ্যতে খুব মুভড হয়েছিলাম। এই ছবির জন্য নিজেকে একেবারে পালটে ফেলেছিল ও। যদিও ওর স্ত্রী সুতপা বাঙালি। সেই সূত্রে ইরফানের বাঙালি যোগাযোগটা আছে। তবু বলব, ওর জায়গায় আমিও এত ভাল করতে পারতাম না বোধহয়! আরও একবার এমন ঘটে।
মোস্তাফা সরওয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ ছবিতে আমার হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। ডেটের জন্য পারিনি। ইরফান এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। আমার সিরিজে ওর অভিনয় দেখতে পায়নি দর্শক, বা আমার ছবিতে ওর সিন বাদ চলে গেলেও অভিনেতা হিসেবে একটা যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। ‘রঞ্জনা..’ দেখে ফোন করে এটা হিন্দিতে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। ‘পান সিং তোমার ‘-এ ইরফান খান জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আমি ফোন করেছিলাম ওকে।
আমার যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছে সেটা হল, আমার দেশে নাসিরউদ্দিন শাহ বা ওম পুরির মতো ভাল অভিনেতা অনেকেই, কিন্তু ইরফানের মতো বিদেশে পরিচিতি সেভাবে কেউ পাননি। ঠিক যে সময়ে ইরফান আরও ভাল ভাল আন্তর্জাতিক সুযোগ পেতে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময়ে অসুস্থতার জন্য সব ছাড়তে শুরু করে। আমরা সবাই জানতাম ও থাকবে না। ইরফান নিজেই জানত ও থাকবে না। কিন্তু তবুও একটা আশা কোথাও তৈরি হয়েছিল যে হয়তো আরও কিছু কাজ করে যেতে পারবে। ৫৩ কী একটা বয়েস হল ওর মত জিনিয়াসের চলে যাওয়ার! আমার সব সময় মনে হয় কিছু বিরল মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়, যারা কী কাজ করবেন সেটা নির্দিষ্ট করা থাকে আগে থেকেই। সাম পিপল আর বর্ন টু বি সায়েন্টিস্ট, সাম পিপল আর বর্ন টু বি ডক্টরস, ইরফান খান ওয়াজ বর্ন টু বি অ্যান অ্যাক্টর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.