‘আমার বস’ মুক্তির প্রাক্কালে একান্ত সাক্ষাৎকারে নন্দিতা রায়। কথোপকথনে শম্পালী মৌলিক।
‘ইচ্ছে’র বারো বছর পর আপনি এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এমন একটা গল্প নিয়ে কাজ করলেন, যার অনেকটা জুড়ে আছে মা-ছেলের সম্পর্ক। ‘আমার বস’-এর ভাবনার নেপথ্যে কী?
– এই ভাবনাটা আসে শিবু আর শিবুর মাকে অবজার্ভ করে। ওরা আমার প্রেরণা এই গল্পের জন্য। ওদের সম্পর্ক এত মধুর এবং এতটা দরদ আছে মন স্পর্শ করে। আমি নিজে এই সম্পর্কটা দেখিনি। আমার মা-বাবাকে সেভাবে পাইনি, তাঁরা ছোটবেলায় মারা গিয়েছেন। আমি, আমার বোন অনাথ ছিলাম বলতে পারো। বোন আমার কাছেই বড় হয়েছে। আট মাসের মধ্যে মা-বাবা চলে গিয়েছিলেন। তখন বোনের দশ বছর। মায়ের এই স্নেহ আমি সত্যিই দেখিনি। কারণ, মা যখন ছিলেন, আমি খুবই ছোট। স্নেহের মর্ম বুঝতে পারিনি। বড় হওয়া তো কঠিন সময়, তখন কতবার বকেছে, সেটাই মনে থাকে। এই বয়সে এসে পৌঁছে, শিবু আর ওর মায়ের যে সম্পর্ক দেখেছি, সেই মাধুর্য আমাকে এতটাই স্পর্শ করেছিল, যে মনে হয়েছিল, আমি যদি এটা গল্পের মাধ্যমে ধরতে পারি। যদি একটা ছবি বানাতে পারি। বলছি না, এই ছবিটা পুরোপুরি শিবু আর ওর মায়ের গল্প। কয়েকটা ঘটনা মায়ের কাছ থেকে নেওয়া। আমিও ওঁকে মা ডাকি। মা আর শিবুর মধ্যে খুনসুটি, ভালোবাসা দেখেছি বলে, ওইগুলো ইনকর্পোরেট করার চেষ্টা করেছি।
এই ছবির আরেকটা দিক কর্পোরেট চাকরির চাপের প্রসঙ্গ। আজকে কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি নিয়ে এত কথা হয়, অথচ কজন মালিক কর্মচারীর মন বোঝে সেই জায়গাটা কি ধরা হয়েছে?
– একদম ধরা হয়েছে।
চাকরির বাজারে আজকে এত অনিশ্চয়তা, সেই সব ভেবেই কি এই ইস্যুটা অ্যাড্রেস করা?
– আমার আসলে মনে হয়েছে, কর্পোরেট জীবনটা খুব রুক্ষ। ভীষণ ব্যবসার মতো। আমার মনে হয়েছে, কেউ কারও জন্য ভাবে না। যে কোনও দিন তুমি পিঙ্ক স্লিপ পেয়ে যেতে পারো। তোমার ঘর-সংসার সম্পর্কে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই, জানতেও চাইবে না। যে কর্মী তোমার অফিসে এসে, এতদিন ধরে এত কিছু দিয়েছে, তারও তো একটা ফিলিংস আছে যে, সে কিছু পাবে। দশ-বারো ঘণ্টা হয়তো এখানে দিচ্ছে। বিশ্বাস করি না, আজকালকার দিনে কেউ কোনও কর্পোরেট অফিসে গিয়ে চেষ্টাটা কম করে। প্রত্যেকে তার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে, কারণ এত নির্মম প্রতিযোগিতা। সেরা না দিলে বাতিল হয়ে যাবে বা তার পিছনে আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটা নেওয়ার জন্য। আমি সবসময় মনে করি, যারা চাকরি করেছে তারা জানপ্রাণ দিয়ে করছে। কর্পোরেট মালিক যারা, তারা কি কর্মচারীদের সেইভাবে দেখে? আমার সন্দেহ আছে। প্লাস একটা কর্পোরেট সেক্টরের যতটা সোশাল রেসপনসিবিলিটি থাকা দরকার, কতটা তারা করে জানি না। আমি কর্পোরেট সেক্টরে কাজ না করলেও, সেরকম লোক দেখেছি। তাদের পাল্টাতে দেখেছি। রোবোটিক হয়ে যেতে দেখেছি।
গল্পে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র কর্পোরেট সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত। এক সময় তার মা ওই জগৎটায় ঢুকছে। তখনই কি বদল আসে?
– মায়ের চোখ দিয়ে সে তখন জগৎটা দেখতে শুরু করে। মা তো প্রত্যেকটা মানুষকে মানুষ মনে করে, মেশিন মনে করে না।
বাবা-মা একটা বয়সের পর আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে বোঝা। বয়স্কদের অসম্ভব একাকিত্বের জায়গা তৈরি হয়েছে। এই ছবিতে বাবা-মায়ের জন্য ডে কেয়ার খোলার ভাবনা জায়গা নিচ্ছে। কীভাবে এল এই ভাবনা?
– সেটা সত্যি নিজেও জানি না। হঠাৎ করে মনে হল, আজকের দিনের ছেলেমেয়ে, যারা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে থাকে বিশেষ করে, তাদের যখন ছেলেমেয়ে হয়, তাদের বড় করার জন্য ক্রেশে দিয়ে দেয়। তারপর অফিসফেরত বাচ্চাটিকে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসে। মা-বাবাকে যখন দেখার সময় দিতে পারে না, তখন চেষ্টা করে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার। আমার কোথাও মনে হল, মা-বাবাদের ক্রেশ হোক না। বাচ্চাদের যদি রাখতে পারো, মা-বাবাকে নয় কেন! তাহলে তারা অন্যান্য লোকেদের সঙ্গ পাবে। একাকিত্ব কাটে, আর বৃদ্ধাশ্রমেও দিতে হয় না তাদের। ডে কেয়ার থেকে রাতে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে, তাহলে তোমরা একসঙ্গে খেতে পারছ, শুতে যেতে পারছ, গল্প করতে পারছ। তাহলে একটা পরিবার ভেঙে যায় না।
‘আমার বস’-এর বড় চমক প্রায় ২২ বছর বাদে রাখি গুলজার বাংলা ছবিতে। ওঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
– রাজি করিয়েছে শিবু। শিবু হল ম্যানেজ মাস্টার। এমনিতে উনি আমাদের ছবি দেখতে খুব ভালোবাসেন। ওঁর ফেভারিট ছবি ‘হামি’। উনি যদি অনেক বায়না করে থাকেন, সেটা শুধু শিবুর কাছে করেছেন। আমার কাছে উনি অত্যন্ত প্রফেশনাল ছিলেন। উনি যখন সেটে আসতেন, যতটুকু আমি চেয়েছি ঠিক ততটুকু করেছেন। এবং এত সাবলীল অ্যাক্টিং করেছেন, না দেখলে ভাবা যায় না।
প্রধান চরিত্রে যেহেতু শিবপ্রসাদ, আপনাকে তো সিংহভাগ দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে।
– (হাসি) শিবু যখন অভিনয় করে, ডিরেকশন আমি দিই। তাতে আমাদের অসুবিধা হয় না। আমাদের সাপোর্ট টিম খুব ভালো। অরিত্র আর পুরো টিম আছে। ৯ মে ছবি রিলিজ, খুব আশাবাদী ছবিটা নিয়ে (হাসি)।
আপনি ‘বহুরূপী’ বা ‘রক্তবীজ’-এর মতো স্ক্রিপ্ট লিখছেন, আবার একইসঙ্গে ‘হামি’ বা ‘বেলাশেষে’-র মতো ফ্যামিলি এন্টারটেনার লিখেছেন। পুরুষ অধ্যুষিত ইন্ডাস্ট্রিতে ধরেই নেওয়া হয়, মহিলা থ্রিলার লিখতে পারবে না। সেটা ভেঙেছেন কীভাবে?
– দেখো, যখন যেমন চাহিদা হয়েছে, আমাকে মোল্ড করতে হয়েছে। শিবু যখন বলেছে, দেখো দিদি, অনেক হয়েছে, এবার থ্রিলার লেখো। আমি একটা আইডিয়া দিচ্ছি, গল্প করে দাও। আমার মনে হয়েছে, কেন পারব না! ওই চ্যালেঞ্জটা নিলাম। অ্যাম আ রাইটার গল্প বলতে ভালোবাসি। কেন মেয়েরা পারবে না! আমার মনে হয়, আমার থ্রিলার লেখাটা অনেক বেশি সফল। ছেলেরা যখন থ্রিলার বানায়, প্রচুর খুনখারাপি, গাড়ি ওড়া, মারপিট থাকে। ওইগুলো দেখতে ক’জন দর্শক থাকে? আমি যখন লিখলাম, তার মধ্যে ইমোশন দিলাম, গান-কান্না-হাসি দিলাম। তার মধ্যে থ্রিল এল।
৫০ বছর বয়সে প্রথম ছবি করেছেন ‘ইচ্ছে’। আজকে আপনি সত্তর ছুঁয়েছেন। আমরা এখন দেখি, ২৫ বছরের একটি ছেলে বা মেয়ে সিনেমা বানাতে যাচ্ছে। ফিরে দেখলে কী মনে হয়? কুড়ি বছরের এই সাফল্য।
– সাফল্যটাকে সাফল্য বলে মনে করি না আসলে। মনে করি, আমি যে কাজগুলো করতে চেয়েছি বা চাই সেগুলো করতে পারছি। সাফল্য এলে আসবে। সেটা আমাকে প্রভাবিত করে না। যখন আমি জানি বহু লোকে ছবিটা দেখছে, ওটাই আনন্দ। অনেকের কাছে পৌঁছনোটাই সাফল্য। অর্থনৈতিক সাফল্যকে ঠিক সাফল্য মানি না। যেহেতু ৫০ বছর বয়সে ছবি করা আরম্ভ করেছি, আমার কাছে অভিজ্ঞতা আছে। যেটা আজকের ছেলেমেয়েদের নেই। সেই অভিজ্ঞতা গল্প বানাতে কাজে লাগাই। যেটা আমার এক্সট্রা পাওনা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.