প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কী আশ্চর্য, যাকে নিয়ে আমি বোধহয় আস্ত একটা বই লিখে ফেলতে পারি, তাকে নিয়ে সামান্য কিছু বলতেও কেমন মুখ আটকে আটকে যাচ্ছে। যেন ভেতরটাই অসাড় হয়ে গেছে।
আজকে সকালে সব কিছু ফেলে না-ফেরার দেশে চলে গেল আমার বহুদিনের বন্ধু তাপস। তাপস পাল। চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। অসম্ভব ভাল বন্ধু।
সকালে এক সাংবাদিকের ফোনেই প্রথম মর্মান্তিক খবরটা পাই। আমি এই মুহূর্তে চালসায়। শুটিং করছি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাবেরী অন্তর্ধান’ ছবির। খবরটা পাওয়ার পরে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। ধীরে ধীরে ঘরের পর্দাগুলো টাঙিয়ে, আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। অবিরত ফোন বেজে চলেছে আর সেই কলগুলোকে সাইলেন্ট করছি। তখন আর কিছু ভাল লাগছিল না। অন্য দিন মেক-আপ ভ্যানে কস্টিউম পরি। আজকে কস্টিউমটাও ঘরে চেয়ে পাঠিয়েছি।
শুয়ে শুয়ে সিনেমার মতো সব পুরনো দিনগুলো তখন আমার চোখের সামনে চলছে। আটের দশক, লোডশেডিংয়ের সেই কলকাতা, উত্তমজেঠু চলে যাওয়ার পর ইন্ডাস্ট্রির হাহাকার- এই সময় তাপস পাল-প্রসেনজিৎ নামদুটো সব সময়ই পাশাপাশি উচ্চারিত হত।
অসম্ভব বড় মাপের অভিনেতা তো তাপস প্রথম দিন থেকেই। এটা আমি আগেও বলেছি, আশির দশকের ওই সময়টা তাপস আমার থেকে অনেক বড় স্টার ছিল। তারপর ধীরে ধীরে আমিও কিছুটা কেরিয়ারে এগোলাম। তখনই একই সঙ্গে তাপসের ‘গুরুদক্ষিণা’ আর আমার ‘অমর সঙ্গী’ সুপারহিট। ইন্ডাস্ট্রিতে তখন তাপস-প্রসেনজিৎকে চাইছে সবাই। এমনও সময় গেছে, এক বছরে আমার ১৩টা ছবি, তাপসের ১২টা। এত ব্যস্ত তখন আমরা। আজকে মনে হয়, কী দিন দেখেছি আমরা!
কতবার হয়েছে, কোনও ছবি আমি বা ও হয়তো সময়ের অভাবে করতে পারছি না। গোটা ইউনিট বসে যাবে এমন অবস্থা। এমন অবস্থায় আমি ওকে বা ও আমাকে বলেছে, “শোন এই ছবিটা তুই করে দিবি?” দু’জনেই হাসতে হাসতে করে দিয়েছি একে অন্যের ছবি।
তখন বাংলা সিনেমায় তাপস-প্রসেনজিৎ-দেবশ্রী-শতাব্দী ছিল একটা টিম। কত ছবি করেছি আমরা একসঙ্গে। তবে এত বন্ধুত্বের পাশাপাশি তাপস ছিল আমার আর আমি ছিলাম ওর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমার তখন রাফ অ্যান্ড টাফ ইমেজ। আর তাপস বাঙালি ভাল ছেলেটা। আমি যেতাম জিম আর দেখতাম তাপসের জন্য সেটে চাররকম খাবার আসছে। বড্ড খেতে ভালবাসত তাপস।
এরপর থেকেই সময়টা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করল। আজকে এগুলো বলার কোনও মানে হয় না। কিন্তু আফসোস হয় এটা ভেবে যে, তাপস যদি আর একটু নিজের খেয়াল রাখত তাহলে হয়তো ও নিজেরই ভাল করত।
তারপর তো ধীরে ধীরে অভিনয় থেকে রাজনীতিকে ও বোধহয় বেশি ভালবেসে ফেলেছিল। কীরকম যেন ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলল ছবির ব্যাপারে তাপস। একটা সময় আমি আর ও বছরের পর বছর জন্মদিনের কেক একসঙ্গে কেটেছি। ওর জন্মদিন ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর, আমার পরের দিন। তারপরে রাতের পর রাত আমার আর ওর সিনেমা, ব্যক্তিগত জীবন, কেরিয়ার নিয়ে কত কথা হত। ধীরে ধীরে অবশ্য সেই ফোনগুলো আসা বন্ধ হয়ে গেল। তাপস তখন খুব সিরিয়াসলি রাজনীতি করছে।
তারপরের সময়টার ব্যাপারে আমি সত্যি আজকে আর কিছু বলতে চাই না। তবে আমার মনে হয়, শেষ মূল্যায়নে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি নায়ক ও শিল্পী তাপস পালকে মনে রাখবে এক অসম্ভব দক্ষ এবং সফল অভিনেতা হিসেবে। বাকি সব মানুষ ভুলে যাবে।
বন্ধু, তুই শিল্পী ছিলিস। আর দেখিস, তোকে মানুষ শিল্পী হিসেবেই মনে রাখবে। আর মনে রাখবে তোর ওই হাসিটা। ভাল থাকিস বন্ধু।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.