Advertisement
Advertisement
Animal

‘এত রক্ত কেন!’, বিষাক্ত পৌরুষত্বের উদযাপন করে কী বার্তা দিতে চায় ‘অ্যানিম্যাল’?

শত্রুকে নৃশংস ভাবে খুন করেও কেন নির্লিপ্ত 'আলফা মেল' রণবীর?

A discussion on Hindi movie 'Animal'। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:December 6, 2023 3:38 pm
  • Updated:December 6, 2023 3:48 pm  

বিশ্বদীপ দে: টক্সিক পৌরুষ। আলফা মেল। এই মুহূর্তে রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিম্যাল’ (Animal) ছবি ঘিরে যে শব্দবন্ধগুলি পাক খাচ্ছে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। রক্তস্নাত রণবীর কাপুর (Ranbir Kapoor), ছবিতে যিনি রণবিজয়, একাই অতিকায় বন্দুক হাতে হত্যাযজ্ঞে শশব্যস্ত। এমনকী, স্কটল্যান্ডে গিয়েও শত্রুকে নৃশংস ভাবে খুন করে তিনি লেডি ম্যাকবেথের মতো রক্তদাগের হ্যালুসিনেশনে ভোগেন না। হাজার হোক তিনি যে আলফা মেল।

মনে রাখতে হবে ‘নায়ক’ ছবিতে শংকরদার বলা কথাটা। একজন অভিনেতা আসলে পুতুল। পরিচালক, সম্পাদক ও অন্যরা তাঁকে যে ছাঁচে গড়ে তোলেন তিনি কেবল সেটাই ফুটিয়ে তুলতে থাকেন। কাজেই পর্দায় আমরা রণবীরকে যা যা করতে দেখি, সেই মুখটা তাঁর হলেও আড়ালে সুতো হাতে ছিলেন পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা। নিঃসন্দেহে রণবীর একাই এই ছবিকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়েছেন। সমস্ত অবিশ্বাস্য দৃশ্যকে নিজের দক্ষতায় বিশ্বাস্য করে তুলেছেন। কিন্তু সেই কর্মকাণ্ড,সংলাপ, আচরণ সবই আসলে পরিচালকের মস্তিষ্কপ্রসূত। ফলে প্রশ্নের তির তাঁর দিকেই যাচ্ছে। যে প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে এক বালিকা করেছিল, ‘‘এত রক্ত কেন’’ যে প্রশ্ন রাজার মনেও ক্রমাগত অনুরণন তুলেছিল। কিন্তু সন্দীপ এমন কোনও প্রশ্ন তুলতে চাননি। তাই ছবিজুড়ে রক্তস্রোত অবলীলায় বয়েই চলে। কেউ কোনও প্রশ্ন তোলে না।

Advertisement

Animal-Inside

[আরও পড়ুন: দর্শনা-সৌরভের বিয়ের প্রস্তুতি তুঙ্গে, কী কী হচ্ছে?]

ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবে ব্লকবাস্টার হয়ে উঠেছে মুক্তির মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই। চরিত্রগত ভাবে ‘Massy’ এই ছবিটি ‘A’ সার্টিফায়েড। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়। ১৮ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রাপ্তমনস্ক হতে সময় লাগে। ছবির দর্শকের একটা বড় অংশই কিন্তু ইয়ং অ্যাডাল্টরা। এমন বিবেকহীন, নির্লিপ্ত হত্যাকাণ্ড তাঁদের প্রভাবিত করতে পারে কিনা প্রশ্ন উঠছে। শিল্পীর স্বাধীনতার পাশাপাশি সৌকর্যবোধও যে একটা ফ্যাক্টর, সেকথাও উঠে আসছে।

অবশ্যই উলটো দিকও রয়েছে। অনেকেই ছবিটির মধ্যে কোনও ‘টক্সিসিটি’ খুঁজে পাননি। তাঁদের দাবি, ছবির প্রোটাগনিস্ট বিপন্ন শৈশবের শিকার। বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবেসেও প্রতিদানে স্নেহস্পর্শের পরিবর্তে উদাসীনতা তাঁর হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছে চিরকালের মতো। সেই হতাশা এবং বাবাকে একাই রক্ষা করার প্রবল জেদ তাঁর পৌরুষকে লৌহকঠিন নির্লিপ্তির দিকে নিয়ে গিয়েছে। সেই চরিত্র তো এমন করবেই। পাশাপাশি এও বলা হচ্ছে, রণবীর কিন্তু আকস্মিক আবির্ভূত কোনও ‘অবতার’ নন। হিন্দি ছবিতে এই ধারা তো নতুন নয়। রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, রাজেশ খান্নার গড়ে তোলা রোম্যান্টিক নায়কের যুগকে এক ঝটকায় শেষ করে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ যুগ শুরু করে দিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। কাকতালীয় ভাবে ‘বিগ বি’ পর্দায় যে নামে সবচেয়ে বেশি বিখ্য়াত, সেই ‘বিজয়’ নামটাই ‘অ্যানিম্যাল’ ছবির নায়কেরও ডাকনাম! ‘ডন’ অমিতাভের দুটো বিখ্যাত সংলাপ, ‘মুঝে জংলি বিল্লিয়া পসন্দ হ্যায়’ এবং ‘যো মর্দ হোতে হ্যায় উনহে দর্দ নেহি হোতা’। এই সংলাপও যেন আজকের পরিভাষায় ‘টক্সিসিটি’রই প্রতিফলন। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

[আরও পড়ুন: রশ্মিকা, আলিয়ার পর এবার ডিপফেকের শিকার প্রিয়াঙ্কা চোপড়া!]

তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতে ভায়োলেন্স কোনও নতুন কিছু নয়। অমিতাভ, মিঠুনের জমানা হয়ে খান যুগ। মনে করুন ‘ডর’ ছবিতে বুক কেটে ‘কিরণ’ লেখার সেই করুণ বীভৎসতা। কিংবা ‘বাজিগর’-এ স্রেফ নায়িকা শিল্পা শেঠির বাবার প্রতি প্রতিশোধস্পৃহা থেকে তাঁকে বহুতলের ছাদ থেকে ফেলে খুন করা। নায়ক শাহরুখের এই দুই কাণ্ডের মধ্যেও কি নেই নির্লিপ্ত নৃশংসতা? দুই ক্ষেত্রেই নায়ক ‘ডিসটার্বড চাইল্ড’। কাজেই ‘অ্যানিম্যাল’কে একা দোষ দিয়ে লাভ হবে না হয়তো। তার পূর্বসূরিরা এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

কিন্তু এর পরও মানতে হবে, জল বাড়তে বাড়তে এখন নাকের উপরে উঠে গিয়েছে। সন্দীপের নায়ক তাই নির্মমতায় সকলকেই ছাপিয়ে গিয়েছেন। হ্যাঁ, এই আচরণের পিছনে মূলত বাবার প্রতি প্রবল ভালোবাসা (তারুণ্যে দিদির প্রতিও) এক ক্যাটালিস্ট হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা না পেয়ে নিজেকে একটা ধারালো অস্ত্র বানিয়ে জীবনের উপরে ছুড়ে ফেলে চরিত্রটি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, রণবিজয় যা করেছে তা আসলে ‘মশা মারতে কামান দাগা’। বাবার হত্যার চক্রান্তকারীদের শায়েস্তা করতে চাইবেই সন্তান। কিন্তু সেজন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করছে সে, তা আশ্চর্য ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নৃশংসতা। খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এই নিষ্ঠুরতার কারণ হিসেবে বাবার প্রতি ভালোবাসাকে দেখানো হলেও আসলে তা আত্মরতি। বাবার কাছে প্রমাণ করা, দেখো তোমাকে খুনের চক্রান্ত করেছে বলেই এমন ভাবে শাস্তি দিচ্ছি! কেবল আত্মরতিও নয়। ভেবে দেখলে, রণবিজয় আত্মধ্বংসীও। আত্মবিষ তাকে অস্থির করে তুলেছে। 

এবং আলফা মেল। রণবিজয় একটি দৃশ্যে পছন্দের মেয়েটিকে আদিম পৃথিবীর কথা বলে। মনে করিয়ে দেয়, সেই যুগে পেশিবহুল পুরুষরাই শিকার করত। তারাই পেত পছন্দের নারীর সঙ্গে যৌনতার অধিকার। যে পুরুষরা ‘আলফা’ নয়, তারা কবিতা-টবিতা লেখে। প্রেমিকাকে চাঁদ এনে দিতে চায়। আজকের এই পৃথিবীতে হিংসা যখন তার সব মাত্রা ছাপিয়ে গিয়েছে, তখন স্রেফ পেশিশক্তিকেই সব কিছু বলে দাবি করছে নায়ক! যাকে ‘আইডল’ বলে মনে করবে বহু তরুণ। হয়তো চিরকালের জন্য তার মনে প্রভাব রেখে যেতে পারে এমন সংলাপ। আবার এও সত্যি, শেষপর্যন্ত এটা তো একটা চরিত্রই বলছে। কিন্তু ‘ভিড়ের হৃদয়’ সব সময় কি আর এত তলিয়ে ভাবে?

এই ছবি দেখতে দেখতে কেমন যেন মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থর কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির একেবারে শেষে সে বলেছিল, ”আমি ওদের সবশুদ্ধু ধ্বংস করে দেব, ওই বাড়িটা পর্যন্ত ধুলোয় গুঁড়ো করে ফেলব, বাদল আর তার দুই সঙ্গী, ওরা আমার সারা মুখ রক্তে মাখামাখি করে দিয়েছিল। আমি যদি ওদের মুখ মাটিতে ঘষে না দিই… সব্বাইকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে… দেখে নিও আমি ঠিক ফিরে আসব।” এই রাগ, এই প্রতিশোধ নিতে চাওয়ার ইচ্ছে তারুণ্যের একচেটিয়া। তবুও সত্যি সত্যিই যে সিদ্ধার্থ এমন কিছু করবে না বুঝে নিতে পাঠকের সমস্যা হয় না। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেবে সে, এই বিশ্বাস আমাদের ছিল। সিদ্ধার্থ পেরেছিল। রণবিজয় পারেনি। সে কি সত্যিই নায়ক?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement