তিতাস রায় বর্মন: Answers must have facts, অনেক তো হল ভুলিয়ে-ভালিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, নতুন নতুন খেলনাবাটি দিয়ে, আজকে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, কাল পঞ্চায়েতের সামনে ভিড়িয়ে দিয়েছিলেন, পরশু আপনাদের কথামতো কর্পোরেশনের সামনে ছিলাম৷ তবে, সত্যি কথা কি জানেন? এত দাঁড়িয়ে, ভিড় জমিয়ে, গলা উঁচিয়ে লাভের লাভ কিছুই হল না৷ শুধু মর্গের সামনে ভিড় জমল, শ্মশানে লাইন বেড়ে গেল৷
আমরা, মানে সাধারণ মানুষ, আমাদের সঙ্গে যে আসলে কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কিছুতেই ছাই বুঝতে পারি না৷ কোনটা কালো, কোনটা সাদা জানি না, কোনটা সংবিধানে লেখা, কোনটা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কে জানে বাবা! শুধু আপনারা যেমন-যেমন বলেন, তেমন-তেমন করে যাই৷ কারণ আপনারা বলেছেন, আপনারা সাধারণ মানুষের পাশে, দেশবাসীর পাশে, আমাদের দুঃখ, আপনাদের বেদনা৷ হাততালি! হাততালি! ব্রিগেড-জুড়ে হাততালি৷
এভাবে আমরা একটু একটু করে ডুবে যাব পাঁকে, ধরা দেব রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী থাবায়৷ কিন্তু কখন ও কীভাবে, তা বুঝতে পারব না৷ রাষ্ট্রের এই তুমুল কূটনৈতিক চাল–আমাদের কি ক্ষমতা আছে তাকে প্রতিরোধ করার? এই সর্বগ্রাসী থাবা তো আসলে মায়াজাল৷ সমাজের প্রতিটি স্তরেই তার বিস্তার৷ অরুণ রায়ের সিনেমা ‘চোলাই’ রাষ্ট্রের এই কূটনৈতিক ছলচাতুরিকে একেবারে স্পটলাইটে নিয়ে এসেছে৷
কীভাবে ধীরে ধীরে পচন ধরে শরীরে-মনে! ভাইরাসের মতো এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রামিত হতে থাকে এই পচন৷ স্ক্রিন-জুড়ে সারি সারি মৃতদেহ, মৃতমুখ৷ কয়েক বছর আগে চোলাই খেয়ে মৃত্যু হয় প্রায় দেড়শো-দু’শো মানুষের৷ সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘চোলাই’ সিনেমাটি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য তৈরি করে৷ চোলাই খেয়ে মৃত্যুর পর রাজ্য-জুড়ে শুরু হয় একেবারে নতুন রাজনৈতিক যাত্রা৷ হিট শো৷ হাউজফুল৷ প্রতিদিন কাগজে লিড স্টোরি৷ সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা– মৃতের পরিবারকে দুই লক্ষ টাকা দেওয়া হবে৷ এই ঘোষণার পরমুহূর্ত থেকে খেলা গেল ঘুরে৷ বিষ মদের অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে গেল, পঞ্চায়েতের সামনে বিশাল লাইন–‘কবে পাব দুই লক্ষ টাকা?’ আদৌ কি কখনও সেই টাকাটা দেখা গিয়েছে? মৃতের পরিবার কি টাকাটা পেয়েছে নাকি সরকারের উপরমহল থেকে টাকা হাত বদল হতে-হতে ফুরিয়ে গিয়েছে মাঝপথেই? মৃতের পরিবারে আর এসে পৌঁছায়নি৷ উপরমহল ও নিচমহলের মাঝে একের পর এক স্তর৷ প্রতিটি স্তরে আলাদা আলাদা দুর্নীতি, শোষণ৷ ‘চোলাই’ সিনেমাটা ফোকাস করেছে এই ঘুরে যাওয়া খেলাগুলোতে৷ বিষ মদ কাণ্ড কীভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে সরকারের, মানুষের বিষ দাঁতনখ৷
এই সিনেমাটির বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট ও জোরালো হলেও সিনেমাটি শৈলীতে নজর কাড়তে পারল না৷ সিনেমা মাধ্যমটি তো শুধু বক্তব্য পেশ করা নয়, সিনেমা তো প্রকৃতপক্ষেই একটি আর্ট ফর্ম৷ সেই জায়গায় ‘চোলাই’ সিনেম্যাটিক নয়৷ বরং সিনেমাটির মধ্যে তথ্যচিত্রের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়৷ তবে অবশ্যই বলতে হয় ক্যামেরার কথা– গোপী ভগতের ক্যামেরা দুর্দান্ত৷ অসম্ভব পরিমিত৷ এমনকী এডিটিং-ও গল্পের চলনটা, পেসটা ধরে রাখে৷ তবে, এর মধ্যে বিশেষ করে বলতে হয় অভিনয়ের কথা৷ প্রায় ছ’টি আলাদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়৷ এবং প্রত্যেকটি চরিত্র পর্দায় সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন৷ কোনও চরিত্র, কোনও চরিত্রের ওপর প্রভাব ফেলছে না৷ শাশ্বতর পরই বলতে হয় পার্থর কথা৷ পার্থর টাইমিং যথাযথ৷ তবে আশ্চর্যের কথা এই যে, সিনেমার প্রত্যেকটি চরিত্র ভাল অভিনয় করেছে৷ ছোট ছোট চরিত্রেও অভিনেতারা অনবদ্য, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই পেশাদার অভিনেতা নন৷
শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্যই ‘চোলাই’-এর এক্স ফ্যাক্টর৷ চোলাইয়ের ঘটনাটি কিছুকাল দূরে হলেও এর কাহিনি বুনন এবং বক্তব্যের জোরালো ভাবনা সমাজের প্রতিটি স্তরে ‘চোলাই’-এর ঘটনাটি সত্যি করে তোলে৷ আমাদের সঙ্গে কখন-কী-কেন ঘটছে, তা সত্যিই আমাদের জানার উপায় নেই৷ মন ভোলানো, প্রাণ জুড়ানো গল্পগাথা শুনে চলি আমরা৷ কিন্তু যদি প্রশ্ন করি চোখ চোখ রেখে, স্পষ্টভাবে– উত্তর চাই৷ আর, answers must have facts।
ছবি: চোলাই
পরিচালক: অরুণ রায়
প্রযোজনা: কে আর মুভিজ অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট, যশপ্রীত কৌর
অভিনয়: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পার্থ সারথি, গৌতম হালদার প্রমুখ
৩/৫
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.