অনির্বাণ চৌধুরী: পিংক! লিপস্ না স্লিপ? স্ট্রেইট না গে? মেয়ের কুর্তা না ছেলের জামা? সবার উপরে কারেন্সি সত্য, তাহার উপরে নাই! ৫০০, ১০০০ নিয়ে এখন আর কেউ নয় চিল, সবার মুখে এক বুলি- অ্যায় নোট হ্যায় মুশকিল! তার সঙ্গেই ২০০০-এর নয়া নোট নিয়ে মহা জোট! শুধুই অ্যাকাউন্টে নয়- ছেলের হাতের আলতো ভাঁজে, মেয়ের পাউট সেলফিতে পিংক নোটের রমরমা! সবাই এখন হন্যে, কবে হাতে ধরা দেবে নয়া নোট, কবে মুখে হাসি ফুটবে টাকা পাওয়ার জন্যে! কী সমস্যা, না?
জীবনে সমস্যা তো লেগেই থাকে! বাসে কনুইয়ের গুঁতোয় সমস্যা, বেবি ফুড নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে সমস্যা, আপিস-কাছারির কথা তোলা মানে বিড়ম্বনার একশেষ! অতএব, নতুন নোট হাতে না আসা পর্যন্ত বিড়ম্বনা চলুক, কী যায় আসে! সবাই এখন দুঃখ ভুলে পিংক নোট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসে! গান্ধীজির অন্য গাল, কালোবাজারি রুখতে মোদির চাল- হাসছি মোরা আহ্লাদী!
পাশাপাশি, থাকে কিছু হিসেব-নিকেশ। এই নয়া পিংক কারেন্সি কোথাও একটা হলেও ভারতের উন্নত শির লজ্জায় প্রথমে নত এবং পরে স্থির করে দেবে না তো? জানতে চাইতেই সটান পাল্টা প্রশ্নবাণ! বুমেরাং ফিরিয়ে দিয়ে ঋতাভরী চক্রবর্তীর প্রশ্নের চক্র- “কেন, সুইজারল্যান্ড-ব্রিটেনের নোট কি পিংক নয়?”
ধাতস্থ হতে না হতেই বলে চললেন ঋতাভরী, “হঠাৎ করে বাজারে একটা নতুন নোট এসে পড়ায় সবাই একটু হইচই করছে বইকি! ঠাট্টা-ইয়ার্কিও করছে! তবে, এতটাও আঁতকে ওঠার মতো কিছু হয়নি। পিংক নোটে ক্ষতি কী? আমি অনেকগুলো দেশ ঘুরেছি, নানা জায়গায় গিয়েছি, নোটের অনেক রংই দেখেছি! অসুবিধাটা কোথায়? হ্যাঁ, প্রথম প্রথম একটু চোখে লাগবে বটে, তবে পরে তা সয়েও যাবে। আমার কিন্তু খারাপ কিছু লাগেনি!”
কিন্তু, এই নোটটা একটু বেশিই লম্বা নয়? “হ্যাঁ, অনেকটা রেলগাড়ির মতো, একটু বেশিই লম্বাটে!” স্বীকার করে নিলেন চিত্রশিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ও। তার সঙ্গেই তাঁর মত, এই নোটে কোথায় যেন একটা গাম্ভীর্যের অভাব রয়েছে। “আগের নোটগুলোতে একটা গাম্ভীর্য ছিল, এটায় সেটার অভাব পেলাম। তার উপরে আবার দেখা যাচ্ছে গান্ধীজির গালের উল্টো দিক। এরকমটা তো আমরা দেখে অভ্যস্ত নই! তাই রসিকতাও শুরু হয়েছে। ওই যে গান্ধীজি বলেছিলেন, কেউ তোমার একটা গালে চড় মারলে আরেকটা গাল এগিয়ে দাও- ঠিক সেইরকম!”
২০০০-এর এই নয়া নোট নিয়ে আরও একটু খুঁতখুঁতুনি ধরা দিল শিল্পীর কণ্ঠে। “ডিজাইন কিন্তু অনেক রকমই করা যেত! রঙের ব্যাপারেও তাই! নতুন এই নোটের রং সিপিয়া হতে পারত বা অন্য পাকা রং! রেডিশ ব্রাউন, গ্রে ম্যাজেন্টা, ব্রাউনিশ ইয়েলো- এরকম কত প্যাস্টেল শেডই তো রয়েছে! তাতে রঙেরও ওজন থাকত, টাকারও ওজন থাকত।“
রঙের ব্যাপারে এই গাম্ভীর্য কমে যাওয়ার ব্যাপারটা আরও একটু স্পষ্ট করলেন তিনি। বললেন, “চ্যাপলিনের ছবির কথাই ধরুন না! সেই ছবি তো সাদা-কালো, সেটাকে এখন কালার করে দিলে কোথাও একটা গিয়ে কি মায়া কমে যাবে না? আমাদেরও তাই হচ্ছে! এরকম নোট দেখতে অভ্যস্ত নই বলেই এত চোখে লাগছে। তবে আমার মনে হয, মানুষের কোনও আকার হয় না। সে আদতে জলের মতো। যে দিকে গড়িয়ে দাও, গড়িয়ে যাবে। সেই নিয়মেই এই নোটেও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে মানুষ, আর অসুবিধা হবে না!”
অবশ্য, শুধুই তো আর রং নয়। নয়া ২০০০-এর নোটে থাকছে নয়া চমক- মাইক্রো চিপ! মাটির তলায় রাখলেও ঠিক হদিশ পাবে সরকার- কোথায় লুকানো রইল কত কালো আমানত! “এটা নিয়ে কিছু বলার নেই! কিছু কিছু ব্যাপারে সরকারি নীতিই শেষ কথা। তাছাড়া এটা ভাল ব্যাপার। গোপন অর্থ বলে কিছু আর থাকবে না কারও। দেশের সুরক্ষা মজবুত হবে”, জানালেন সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়।
সে না-হয় হল! তা বলে মানুষ অর্থ সঞ্চয় করবে না? দফায় দফায় যদি এভাবে কারেন্সি বদলাতে থাকে, তবে মানুষ কোথায় যায়? “আমি ৫ টাকা, ১০ টাকার কয়েন জমাতাম। কী সুন্দর চকচকে, ঠিক যেন সোনার! এখন তো দেখছি সেগুলোতেও মুশকিল! জানি না ওগুলোর কী হবে”, কিছুটা আক্ষেপেরই সুর ধরা দিল নায়িকা অপরাজিতা আঢ্যর গলায়। তবে, নতুন ২০০০ নোট নিয়ে তিনি বেশ নিরপেক্ষ। “আরে বাবা, কিছু না কিছু রং তো রাখতেই হত! একটা কোনও ডিজাইনেও এসে থামতেই হত! ওসব ভেবে লাভ কী! তাছাড়া সরকার যখন করেছে, কিছু একটা ভেবেই তো করেছে! আমি নিজে খুব ভাল করে এখনও নোটটা দেখিনি, কাজেই খুঁটিয়ে কিছু বলতে পারব না”, ঝেড়ে কাশলেন তিনি!
নতুন ২০০০-এর নোট এখনও হাতে নিয়ে দেখেননি উপল সেনগুপ্তও! “ব্যাঙ্কে যা লাইন, এখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি”, বলেন তিনি! তাও যতটুকু দেখেছেন ছবিতে, চন্দ্রবিন্দুর বিখ্যাত গায়কের নোটটা খুব একটা মনে ধরেনি। “যদি আমার কথা বলেন, তবে বলব, আমার ডিজাইনটা খুব একটা মনঃপূত হয়নি। তবে হ্যাঁ, এই নতুন নোট তো অনেক কিছু ভেবে তৈরি করা হয়েছে। মাঝে একটা সাদা স্পেস গিয়েছে, তার পর মাইক্রো চিপ বসাতে হয়েছে। এ সব ইনকর্পোরেট করতে গিয়ে কোথাও একটা হয়তো ডিজাইনটা মার খেয়েছে!”
তা বলে নোটের পিক রং নিয়ে আদপেই ভাবিত নন উপল। “আমার কাছে সব রং সুন্দর! আসলে কী হয়, আমরা একেকটা রংকে নিজেদের ম্তো করে ব্যখ্যা করে নিই। নীল রং মানেই পুরুষ, আবার পার্পল হল গিয়ে রয়্যাল! কী যায় আসে! একসময় সবাই এই পিংকেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তখন আর চোখে লাগবে না। আমার তো রংটা অন্তত ভালই দেখতে লাগছে”, অকপট জবানবন্দি তাঁর!
নোটের রং নিয়ে যদিও কিঞ্চিৎ খুঁতখুঁতুনি রয়েছে দেশের পয়লা সারির ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পালের। “গোলাপি তো খুব হালকা রং, তাই একটু হাত ঘুরলেই ময়লা হয়ে যাবে”, কারণটা স্পষ্ট করলেন তিনি। এ ছাড়া গোলাপি নোট নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই তাঁর! থাকার কথাও নয়। “দেখুন, এইরকম গোলাপি, লম্বাটে নোট কিন্তু স্বাধীনতার আগে এদেশে ছিল। সেই নোট আমি দেখিনি। যখন থেকে টাকা-পয়সা ব্যাপারটা বুঝছি, তখন থেকে আর এই রং দেখিনি। তবে হ্যাঁ, ৫০০-র নতুন নোট গ্রে, সেখানে এই চট করে নোংরা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই”, জানালেন অগ্নিমিত্রা।
অবশ্য ডিজাইন নিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনারের কিছু বক্তব্য রয়েছেই। “নতুন নোটে অনেক কিছুই উনিশ-বিশ হয়েছে। গান্ধীজির মুখটা অনেকটা সরে এসেছে। সেটা দেখতে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই! তবে ৫০০-র নোটের পিছন দিকে রেড ফোর্টের যে স্কেচটা রয়েছে, ইটস ভেরি নাইস!” তা বলে এই কারেন্সি বদল যে তাঁকে ধাক্কা দেয়নি, এমনটা কিন্তু নয়। “আমার হাতে একটা টাকা নেই! ব্যাগে বড়জোর একশো টাকা পড়ে রয়েছে। কারিগরদের পেমেন্ট দিতে হবে, খুবই অসুবিধা হচ্ছে। মানছি, আমি নিজে ব্যাঙ্কে যাব না, কেউ একটা গিয়ে টাকা তুলে এনে দেবে! তাও অসুবিধা তো একটা হচ্ছেই”, স্বীকার করে নিলেন তিনি।
কিন্তু, সব ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর গলায় ধরা দিল গর্বের সুর। “আমি একটা ব্যাপারেই গর্বিত। এই যে এত বড় একটা সদর্থক পরিবর্তন হল, আমি তার অংশীদার। আমি এই সময়েই রয়েছি। এই ঘটনাটা কিন্তু সামান্য নয়। দেখবেন, একশো বছর পরেও মানুষ এটা মনে রাখবে। অসুবিধা সবারই হচ্ছে, কী আর করা যাবে! ভাল কাজের জন্য একটু স্যাক্রিফাইস তো সবাইকেই করতে হয়, তাই না?” পাল্টা প্রশ্ন অগ্নিমিত্রার!
অপরাজিতা আঢ্য, উপল, অগ্নিমিত্রার মতো নতুন নোট এখনও হাতে নিয়ে দেখেননি এসওএস আইডিয়াজ-এর কর্ণধার সৌভিক মিশ্রও। তবে সংক্ষিপ্তভাবে যেটুকু দেখেছেন, তাতে তাঁর নোটটা ভালই লেগেছে! ভাল লেগেছে রংটাও! “রংটা খুবই স্টার্ক! পুরো পিংক তো নয়! একটু পার্পল পিংক, সহজেই চোখে পড়ে”, জানালেন তিনি। তবে, ডিজাইন নিয়ে মধ্যপন্থায় চলছেন সৌভিক। “সেটা খুব খারাপও নয়, খুব ভালও নয়! তবে ধীরে ধীরে আরও উন্নত হবে, চিন্তা কী”, হাসলেন সৌভিক!
রং নিয়ে অবশ্য আরও একটা ব্যাপারের খেই ধরিয়ে দিতে ভুললেন না তিনি। সাফ বললেন, “গোলাপি রং নিয়ে হাসাহাসির কিছু নেই। দেখুন, দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক তো মহিলা! তাঁদের পছন্দের রং পিংক। তাহলে হাসাহাসির কী আছে?” আর জানাতে ভুললেন না, নতুন এই নোটের জাতীয়তাবাদী বার্তাও তাঁর মনে ধরেছে। “নোটে মঙ্গলে স্পেসশিপ পাঠাোর যে ছবিটা আছে, ওটা আমার খুব ভাল লেগেছে”, বললেন সৌভিক!
এর পরেও সমস্যা থাকেই! সে কী আর সহজে যেতে চায়! এই নতুন নোট যে বড়ই ফিনফিনে! এর মধ্যেই বাজার সরগরম খবরে- তা নাকি একটু বেকায়দায় ধরলেই ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাহলে পকেটের ভাঁজে, মানিব্যাগের খাঁজে তার ভবিষ্যৎ নিরাপদ তো?
আহা, কী-ই বা বয়স হল তার! সে তো এখনও শিশু! বাচ্চাকে যেরকম যত্নআত্তি করি, এই নোটকেও না-হয় তাই করব! জীবনের অনেকগুলো দিকের পাশাপাশি এই দিকেও একটু সাবধানী হলে ক্ষতি কী!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.