দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পরিচয় ছিল উত্তমকুমারের সঙ্গে৷ শুধু সহকর্মী নন, পারিবারিক বন্ধুও ছিলেন৷ উত্তমকুমারের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রেই তাঁর ৩৭তম প্রয়াণ দিবসে মুম্বইয়ে বসে স্মৃতির সরণিতে হাঁটলেন বিশ্বজিত্ চট্টোপাধ্যায়।
সেটা পাঁচের দশকের মাঝামাঝি৷ ১৯৫৫-৫৬ সালে বরানগরের মোড়ে এমপি স্টুডিওতে প্রথম দেখা হয়েছিল উত্তমদার সঙ্গে৷ ততদিনে উত্তমদা নায়ক হিসেবে পঞ্চাশটা ছবি করে ফেলেছেন৷ বিশাল জনপ্রিয়তা৷ আমার মনে আছে, ওই স্টুডিওতে তিনি ‘পথে হল দেরি’-র শুটিং করছিলেন৷ প্রযোজক বিমল ঘোষ আমাকে উত্তমদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন৷ সেদিন খুব বেশি একটা কথা হল না৷ বিমলবাবু আমাকে দেখিয়ে ওঁকে বলেছিলেন, ‘ইনি নতুন এসেছেন৷ আমাদের পরের ছবি ‘ডাক হরকরা’-তে পার্ট করবেন৷’ উত্তমদা শট দিয়ে বেরোচ্ছিলেন৷ আমাকে দেখে শেকহ্যান্ড করে বললেন, ‘খুব ভাল৷ ভাল করে মন দিয়ে কাজ করো৷ ভাল লাগল আলাপ করে৷’
ব্যস৷ এইটুকুই৷ এরপর উত্তমদার বাড়িতে যাতায়াত শুরু হল আমার৷ উত্তমদার ভাই তরুণকুমার মানে ‘বুড়ো’-র সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল খুব৷ সেই সময় থেকেই উত্তমদা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালবাসতেন৷ উত্তমদাদের ভবানীপুরের বাড়ির সব অনুষ্ঠানেই হাজির থাকতাম৷ ওই পাড়াতেই উত্তমদারা ক্লাব চালাতেন৷ নাম ছিল ‘মরশুমি ক্লাব’৷ ওই ক্লাবে জড়ো হতেন শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়রা৷ ওখানেও যেতাম আমি৷ একসময় ‘রঙমহল’ থিয়েটারে ‘সাহেব বিবি আর গোলাম’-এ ‘ভূতনাথ’ চরিত্রটায় অভিনয় করার কথা ঠিক হল৷ আমি উত্তমদাকে বললাম, ”দাদা আমাকে এই চরিত্রটা ভাল করে করার জন্য অভিনয়টা একটু দেখিয়ে দিন৷” উনি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন৷ হোলিতেও উত্তমদাদের বাড়িতে গিয়ে রং খেলেছি৷
ছয়ের দশকের মাঝামাঝি উত্তমদা তাঁর কিছু বিশেষ বন্ধুদের পরিচালনায় হিন্দি ছবির নায়ক হওয়ার জন্য মুম্বই এসেছিলেন৷ আমি তার আগে হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের জন্য মুম্বই চলে এসেছি৷ ১৯৬২-তে আমার ‘বিশ সাল বাদ’ রিলিজ করে গিয়েছে৷ ওই সময়ের পরেই রাজ কাপুর উত্তমদাকে ওঁর পরিচালনায় ‘সঙ্গম’ ছবিতে রাজেন্দ্র কুমারের চরিত্রে প্রথমেই নির্বাচন করলেন৷ ‘বন্ধু’-দের বুদ্ধিতে উত্তমদা ‘সঙ্গম’ ছবির কাজ নিলেন না৷ আমার মতে, ওইটাই সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেল উত্তমদার হিন্দি ছবির কেরিয়ারে৷ রাজ কাপুরের ‘সঙ্গম’ ব্লকবাস্টার হয়েছিল৷ ‘সঙ্গম’-এ রাজেন্দ্র কুমারের যে চরিত্রটা উত্তমদার করার কথা ছিল, সেই চরিত্রটা ছবিতে রাজ কাপুরের নিজের অভিনীত চরিত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ উত্তমদার উপর শ্রদ্ধায় রাজ কাপুর ওই চরিত্রটা উত্তমদাকে অফার করেছিলেন৷ হয়তো ‘ঘনিষ্ঠ’ কেউ উত্তমদাকে তখন বুঝিয়েছিলেন যে, উনি ওই চরিত্রটা করলে রাজ কাপুরের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাবেন৷ আমার মতে, ওটা সম্পূর্ণ ভুল একটা ডিসিশন ছিল উত্তমদার জীবনে৷ যার খেসারত তাঁকে দিতে হয়েছিল পরে৷ ‘ছোটিসি মুলাকাত’-এর সময়৷
নিজের ‘তথাকথিত বন্ধু’-দের পরামর্শে উত্তমদা নিজের প্রযোজনায় ছবি করবেন বলে ঠিক করলেন৷ একক নায়ক হিসাবে সেই ছবিতে বৈজয়ন্তীমালা ছিলেন উত্তমদার নায়িকা৷ মজার ব্যাপার হল, ‘সঙ্গম’-এও বৈজয়ন্তীমালা ছিলেন নায়িকার ভূমিকায়৷ কিন্তু ‘ছোটিসি মুলাকাত’ বিশ্রীভাবে ফ্লপ করল৷ উত্তমদা আর্থিক ক্ষতির শিকার হলেন৷ সেই ক্ষতির ঝাপটায় শরীরের অবনতি হল৷ উত্তমদার হার্ট অ্যাটাক হল৷ সারা পশ্চিমবঙ্গে রটে গেল রাজ কাপুরের রাজনীতিতে উত্তমদা মুম্বইয়ে (তখন ‘বম্বে’) টিকতে পারলেন না৷ রাজ কাপুরের জন্যই উত্তমদা মুম্বইয়ে জায়গা করতে পারলেন না৷
আমি ছয়ের দশকের শুরুতেই ‘বম্বে’ চলে এসেছিলাম৷ তখন থেকে টানা মুম্বইয়েরই বাসিন্দা৷ অনেক হিন্দি ছবিতেই কাজ করেছি৷ রাজ কাপুরের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর এবং কাপুর পরিবারের সদস্য রাজ কাপুর, শাম্মি কাপুরদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরেই বলতে পারি রাজ কাপুর কিংবা কাপুররা কখনওই উত্তমকুমারকে মুম্বই থেকে চলে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেননি৷ বরং ঘটনাটা উল্টো৷ ’৬৪-তে ‘সঙ্গম’-এ উত্তমদা ওই অফারটা নিলে হিন্দি ছবিতে উত্তমদার অন্য ইতিহাস লেখা হত৷ কিন্তু যেটা বাস্তবে ঘটল, সেটা উত্তমদাকে সেই ইতিহাসটা তৈরিই করতে দিল না৷
আমরা সবাই জানি, কাপুর পরিবার মুম্বই আসার আগে কলকাতাতেই থাকত৷ ‘পাপাজি’ মানে পৃথ্বীরাজ কাপুরের মুখে আমি কলকাতার ‘নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও’-র বিএন সরকারকে ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতে শুনেছি৷ উনি নিউ থিয়েটার্সের বিএন সরকারকে গুরু বলে মানতেন৷ বাঙালিদের রাজ কাপুর বিশেষ ভালবাসতেন৷ শ্রদ্ধা করতেন৷ সেই শ্রদ্ধা আর ভালবাসা থেকেই ‘সঙ্গম’-এর অফার তিনি উত্তমদাকে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ‘তথাকথিত বন্ধু’-দের কথায় উত্তমদা ভুল বুঝলেন৷ বলা ভাল, ওঁকে ভুলটাই বোঝানো হল৷ সেই ক্ষত আর সারেনি৷ আমার মনে হয় উত্তমদার শারীরিক, মানসিক ক্ষতির সেই সময় থেকেই শুরু৷
আরও একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল৷ সাতের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় নকশাল আন্দোলনের সময় উত্তমদাকে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতেই তাঁর নিজস্ব মেকআপ রুমে সশস্ত্র হানা দিয়েছিল কয়েকজন যুবক৷ উত্তমদার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে প্রাণে মারার হুমকিও দিয়েছিল তারা৷
সমস্ত ঘটনায় উত্তমদা এতটাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং ঝাঁকুনি খেয়েছিলেন যে সেইদিনই মাথার চুল ছোট করে ছেঁটে বম্বে মেল ধরে মুম্বই চলে এসেছিলেন৷ মুম্বই এসে প্রথমে উঠেছিলেন অভি ভট্টাচার্যর বাড়ি৷ এভাবে মাস খানেক সময় টানা মুম্বইয়ে কাটিয়েছিলেন৷ অভিদার বাড়ি থেকে দ্বিতীয় দিন আমার সান্তাক্রুজের সাত নম্বর রোডের ফ্ল্যাটে উত্তমদা এসেছিলেন বেণুদিকে সঙ্গে নিয়ে৷ আমি বেণুদিকে চিনতে পেরেছি৷ কিন্তু উত্তমদাকে চিনতে পারিনি৷
যে চুল উত্তমদার সৌন্দর্যের একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল, সেই চুল তিনি একরাতের মধ্যে ক্রু কাট করে একেবারে ছোট করে ফেলেছিলেন৷ যাতে ট্রেনে সফর করার পথে তাঁকে কেউ চিনতে না পারেন৷ এতটাই ভয় পেয়েছিলেন তিনি যে, প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলেন আর কলকাতায় ফিরতে পারবেন না৷ আমাকে বলেছিলেন, ‘বিশু (আমাকে এই নামেই ডাকতেন) চল, তুই আর আমি মিলে এখান থেকেই বাংলা ছবি বানাব৷ আর এখানে বসেই বাংলা ছবির শুটিং করব৷’ সেই ঘটনা এতটাই নাড়া দিয়ে গিয়েছিল ওঁকে যে উনি ধরেই নিয়েছিলেন কলকাতায় হয়তো তাঁর আর ফেরত যাওয়া হবে না৷ বেণুদির মুখ থেকেই শুনেছিলাম এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সেদিন উত্তমদা যে ওঁর পুরো শরীর হলুদ হয়ে গিয়েছিল৷ তার আগেই উত্তমদা হার্ট অ্যাটাকের ঝাপটা সামলে উঠেছিলেন কোনওভাবে৷ আর তারপরেই ওই ঘটনা৷
এর কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য কলকাতায় অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল৷ উত্তমদাও ফিরে গিয়েছিলেন কলকাতায়৷ ২০১৬-র ২৪ জুলাই আবার ফিরে এল৷ উত্তমদাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে৷ ছয় আর সাত দশকের ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনার কথা আমার মনেও ফিরে এল৷ আর সেটাই শেয়ার করলাম এখানে৷
(অনুলিখন: তপন বকসি)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.