শম্পালী মৌলিক: মধ্যবিত্ত মনের জড়তা ভেঙে বাংলা ছবির আড় ভাঙছে কি? আগের চেয়েও কি সাহসী হয়ে উঠল টলিউড ইন্ডাস্ট্রি? সাম্প্রতিক কালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো যেমন– ‘ক্ষত’, ‘ঈগলের চোখ’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ কিন্তু সেই প্রশ্নটাই উসকে দিয়েছে৷ কী ভাবছে দর্শক? কী বলছে ইন্ডাস্ট্রি? ‘ঈগলের চোখ’ ছবিটি বিস্তার করেছে একটি প্রাপ্তমনস্ক বিষয় নিয়ে৷ চাইল্ড অ্যাবিউজ, সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ, বহুনারী এবং হত্যারহস্য যে ছবির কেন্দ্রে৷ আর ‘ক্ষত’ এক লেখকের বিবাহ বহির্ভূত প্রেম এবং বহু নারীসঙ্গে আলো ফেলেছে৷ ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ছকভাঙা গল্পের কেন্দ্রে এক গৃহবধূ, যে স্বেচ্ছায় নিজের কামনার মুক্তি ঘটাতে দেহব্যবসায় যোগ দিচ্ছে৷ বাংলা সিনেমা কি ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে?
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “সাহস বাড়ছে কি না বলতে পারি না৷ নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে৷ ২০০৫-এ আমি ‘শূন্য এ বুকে’ করেছি৷ আমার সাহসের মাপকাঠিটা ওইখানে বাঁধা৷ মনে হয় বাংলা সিনেমা চিরকালই সাহসী ছিল৷ ‘সাহেব বিবি গোলাম’ চমৎকার বিষয় নিয়ে৷ বন্ধুবান্ধবরা আমরা আড়ালে আলোচনা করেছি কিন্তু কিছু মানুষের সম্ভ্রমের কথা ভেবে প্রকাশ্যে আলোচনা করা হয়নি৷ বিতর্কিত স্কুল, ছেলেমেয়েদের মায়েদের দুপুরযাপন কাছাকাছি কোনও এক আবাসনে৷ এ কিন্তু একেবারে মেট্রো সিটির সত্যি৷ স্ত্রীরা এইটুকু লিবার্টি নিচ্ছে৷ পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতেই পারে৷ বর যদি অফিস ট্যুরে বান্ধবীর সঙ্গে বিশেষ সময় কাটিয়ে আসতে পারে, স্ত্রীরও সতী সেজে বসে থাকার মানে হয় না৷ আমি মনে করি বাঙালি দর্শক এই ধরনের ছবি দেখতে তৈরি৷ এই শহর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসুর শহর৷ আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমে পড়েছেন৷’ বোঝা যায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় খোলামনে বিষয়টি দেখছেন৷ আর ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক প্রসেনজিৎ জানাচ্ছেন, ‘হ্যাঁ, এ যুগের সিনেমার ভাষা পাল্টাচ্ছে৷ ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ গ্রো করছে৷ সাহসী বিষয় নিয়েও কাজ হচ্ছে বলতেই হবে৷’ ইন্ডাস্ট্রির আর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘আমি একমত যে, হ্যাঁ বাংলা ছবির সাহস বাড়ছে৷ থিমের দিক থেকে তো সাহসী হচ্ছে বটেই৷’
যদিও পরিচালক অরিন্দম শীল বলছেন ‘সাহস কাকে বলব সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ৷ অনস্ক্রিন চুমু খাওয়া আর জামা খোলাটা কি সাহস? না কি একটা জবরদস্ত স্ক্রিপ্ট, যেটা একটা অ্যাডাল্ট থিমকে ডিল করছে, সেটা? নিজের ঢাক পেটাচ্ছি না৷ কিন্তু কিছু একটা দেখিয়ে দিলাম খোলামেলা দৃশ্য বলে অথচ অ্যাডাল্ট থিমটা বেরিয়ে এল না, সেটা তো সাহসী নয়৷’ কিন্তু গৃহবধূ অসুখী দাম্পত্যের কারণে, নিজের যৌন তৃপ্তি চরিতার্থ করতে যখন হাউসওয়াইভস ক্লাবে নাম লেখাচ্ছে সেটা তো ছকভাঙা৷ বা লেখক-স্বামী স্ত্রীর কাছে স্বীকার করে নিচ্ছে অন্য সম্পর্কের কথা৷ না কি? অরিন্দম বলছেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বিষয়গুলো সাহসী হয়ে উঠেছে৷ সেন্সর আর কিছু কাটতে পারবে না৷ কেবল রেটিং দিতে পারবে– এটা আমাদের আরও রেসপন্সিবল করে তুলেছে৷ একটা সময় বাংলায় সুড়সুড়ি দেওয়া ছবি করেও কিছু লোক বিখ্যাত হয়েছেন৷ সেটা লং লাস্টিং নয় প্রমাণিত৷ আমার বক্তব্য, প্রয়োজনের বাইরে সেক্সুয়ালিটির অর্থ হয় না৷ কিন্তু বিষয়গত কারণে সেক্সুয়ালিটি দর্শক নেবে যদি সেটা এসথেটিকালি দেখানো হয়৷ বাঙালি ওভারডোজ নেয় না৷ বাঙালি কালচারে একটা উদারতা আছে, যেটা নান্দনিকভাবে সবকিছু নিতে পারে৷’ বোঝা গেল অরিন্দম জোর দিচ্ছেন বিষয়গত বোল্ডনেস-এর উপরে৷ সত্যিই তো, ছবির অন্তরে বারুদ থাকলে তবেই বহিরঙ্গের আগুন জ্বলবে৷ ঠিক যে আগুন জ্বলে উঠেছিল ‘দহন’ কিংবা ‘উৎসব’ ছবিতে৷ অলটাইম বোল্ড ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘বাংলা ছবি তো সাহসী ছিল আগেও৷ কনটেন্ট-এর দিক থেকে ‘পারমিতার একদিন’, ‘দহন’, তারও আগে ‘চোখ’ এর মতো ছবিও বাংলায় হয়েছে৷ পরের দিকে নায়িকা প্রধান বোল্ড ছবি যেমন আমার ‘তৃষ্ণা’ বা ‘চারুলতা ২০১১’-র কথাও বলতে পারি৷’’ সাহস দেখিয়েছেন মৈনাক ভৌমিকও৷ তাঁর ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ কিংবা ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ ছবিতে৷ ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ দুই নারীর ভালবাসায় আলো ফেলেছিল৷ আর ‘গার্লফ্রেন্ডস’ কিংবা ‘টেক ওয়ান’ নারীর নিজের মতো নির্ভীকভাবে বেঁচে থাকার ছবি দেখিয়েছিল৷
ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সিনিয়র পরিচালক অঞ্জন দত্ত বলছেন, ‘‘কিছু কিছু বাংলা সিনেমা সত্যিই আগের থেকে সাহসী হয়ে উঠছে৷ কিছু মানুষ নিয়ম ভাঙছে৷ ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি নিজেও সেই দলে৷ ‘বং কানেকশন’ থেকে আমি নিয়ম ভাঙছি৷ এবং প্রতিম জলজ্যান্ত উদাহরণ যে বাংলা সিনেমা নিয়ম ভেঙে সাহসী হতে পারে৷ যৌন চেতনা এবং হৃদয়ের চেতনার মধ্যে তফাত আছে৷ এটা গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা বুঝতে হবে৷ বাংলা সিনেমা তো ‘পরমা’র সময় থেকেই সাহসী৷ মেয়ে লিবারেটেড হতে চেয়ে স্বামীর হাত ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরবে কেন? সেই বন্ধনেও তো জবাবদিহি আছে৷ কেন ফোন করল না, কেন মেসেজ করল না, এই জবাবদিহি কেন দিতে হবে? সেই জন্যই লিভ টুগেদার৷ এটা মানুষ যতক্ষণ না বুঝতে পারবে ছবি নিতে পারবে না৷ শারীরিক চাহিদার মধ্যে অন্যায় নেই৷ বিষয়টাকে গ্লোরিফাই করার দরকার নেই, কিন্তু এটা ঘটনা৷ ‘দেয়া-নেয়া’-তে যেমন, গাড়ির ড্রাইভার আর মেয়ের প্রেম নিয়ে সিনেমা তো আগেও হয়েছে৷ ‘জন অরণ্য’-তে তো পপুলিস্ট গল্প, ভাই বোনকে বেচে দেয়৷ ঋতু (ঋতুপর্ণ ঘোষ) কী করেছিল? কেউ পেরেছিল? ঋতুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ ভারতের অন্যতম সাহসী ছবি৷ ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’ তার পরে হয়েছিল৷ আমি কিন্তু ‘বং কানেকশন’-এই সমকামিতা দেখিয়েছি৷’
বোঝা যায় পরিবর্তনের শুরুটা আগেই হয়েছিল, এবারে আরও স্পষ্ট সবটা৷ টলিউড ক্রমশ দুঃসাহসী!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.