নির্মল ধর: ‘বহুরূপী’ নাট্যসংস্থার নবতম প্রযোজনা ‘রতন স্যর’ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘এই সময়ের আত্মকথন’। সন্তানদের উপযুক্ত ও সক্ষম করে তোলার অজুহাতে তাদের সুকুমার বৃত্তি, সজীব আনন্দ, সপ্রাণ অনুভূতি, নির্মল ভাললাগা-মন্দলাগাগুলোকে প্রায় আমল না দিয়েই নিজের চাওয়া এবং না-পাওয়াগুলোকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরোক্ষে এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থাটাও সেদিকে। ফলে অনেক সময়েই শিশু-কিশোরের দল সব অনুভূতি হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পেরে নিজেকেই ‘মিসফিট’ মনে করা শুরু। এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। সমস্যাটি অতীতেও ছিল। এখন বৈজ্ঞানিক-যান্ত্রিক উন্নয়নে তা আরও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। সত্যিই এই সময়ের কথন ‘রতন স্যর’, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্যের কাহিনি সূত্র থেকে নাট্যরূপ দিয়েছেন তীর্থঙ্কর চন্দ।
গোলযোগ ঘটেছে এই নাট্যরূপেই। দৃশ্যগুলোর বাঁধন বড়ই আলগা। শুরুর দৃশ্যের কথা ধরা যাক। ট্রেনের প্রতীক্ষায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একদল মানুষ। তাদের হই হট্টগোল, এলোমেলো চলাফেরা কোনও জরুরি প্রিলু্ড রচনা করল কি? করল না। সুতরাং এই দৃশ্যটির প্রয়োজনই নেই। আবার যেখানে বাড়তি দৃশ্যের দাবি সেখানে তাড়াহুড়ো করে শেষ করার প্রবণতা। রতন যে ছুটকির হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফির কাজটাকে পছন্দ করে তাকে উৎসাহিত করেছে সেটা স্পষ্ট হল কোথায়? মাত্র একটিবার(তাও প্রথম সাক্ষাতেই!) ছুটকির কাজ দেখেই রতন কীভাবে তাঁর ‘স্যর’ হয়ে উঠল! রতনের ইংরেজি বিদ্যা তো ফেরিওয়ালার মুখস্থ স্লোগান! সুতরাং ট্রেনের বই ফেরিওয়ালা ফেল করা রতন তো ভাল করেই জানে তার বিদ্যে কতটুকু! ট্রেনে-বাসে ফেরিওয়ালা মুখস্থ বুলি আউড়ে যায়, তাই রতনের কাছেই ইংরেজি শেখার মুখস্ত বিদ্যা রপ্ত করে ছুটকির পরীক্ষায় সফল হওয়ার ব্যাপারটা খুবই জোলো ঠেকে।
কাহিনির আসল স্যর তো স্বদেশ মাস্টার। আদর্শবাদী প্রকৃত শিক্ষককে সরিয়ে রতনকে ‘স্যর’ করে তোলা ‘নাটকীয়’ এলিমেন্ট হতে পারে, কিন্তু বাস্তব নয়। তার ওপর নাটকের চলনে এবং দৃশ্যের বিন্যাসেও ছুটকির করচ্ছায়ার কাজের প্রতি আন্তরিক আগ্রহের ব্যাপারটা শক্ত ভিতে গড়ে ওঠে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।
পরিচালক হিসেবে দেবেশ রায়চৌধুরি এমন দুর্বল রচনা নিয়ে বড় বিব্রত ও অসহায় বোধ করছেন দর্শকের আসনে বসেই বোঝা যাচ্ছিল। চলন্ত ট্রেনের দু’টি দৃশ্য এবং বাবা-পিসির সঙ্গে ছুটকির ঘরোয়া একটি দৃশ্য ছাড়া কোনও জায়গাতেই এই প্রযোজনা ‘বহুরূপী’-র মতো প্রবীণ ও ঐতিহ্যধারী সংস্থার তৈরি বুঝতে অসুবিধেই হচ্ছিল। বাদল দাসের আলো, করচ্ছায়ায় পর্বটি আরও একটু দীর্ঘ করা যেত! গৌতম ঘোষের আবহ কোনও নতুন ডায়মেনশনও যোগ করেনি প্রযোজনায়।
একমাত্র হিরণ মিত্র’র ছিমছাম মঞ্চ পরিকল্পনা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম, তাতেও দেখা গেল ঘরের দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা স্থির। অভিনয়ে অবশ্য প্রধান দু’টি চরিত্র বিকাশ মণ্ডল (রতন) এবং ঈশিতা ঘোষ (চুটকি) বেশ সাবলীল, স্বচ্ছন্দ। ‘স্যর’ হয়ে ওঠার লজ্জা এবং ভয় বিকাশের অভিনয়ে স্পষ্ট হয়েছে। পিসি ও বাবার চরিত্রে মহুয়া বসু এবং প্রবাল মুখোপাধ্যায়ও ভালই অভিনয় করেছেন। ‘বহুরূপী’র ধারা বজায় রেখে দেবেশ রায়চৌধুরি স্বদেশ মাস্টারের চরিত্রে ব্যক্তিত্বে ধীর-স্থির। অন্য অনেকের অভিনয়েই বহুরূপীর স্কুলিং অপসৃয়মান। অপ্রিয় হলেও সত্য কথাটি বলতেই হচ্ছে এই মুহূর্তের ‘বহুরূপী’র অবস্থা যেন সাইনবোর্ড হয়ে যাওয়া রাজ্যের এক দাপুটে রাজনৈতিক দলের মতোই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.