সৃষ্টির মগ্নতায় স্রষ্টা
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাঙালির শৈশবে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন কল্পনার রং। উপহার দিয়েছিলেন এমন এক পৃথিবী, যার অস্তিত্ব যে শুধু আঁকায়-রেখায়, বাঙালি যেন তা বিশ্বাসই করতে চায় না।কে বলবে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল বা নন্টে-ফন্টে কেবল চরিত্র মাত্র! কোনও এক দারুণ ম্যাজিকে তারা কবেই যেন আমাদের আপনার জন হয়ে উঠেছে। আর সেই আত্মীয়তা গড়ে তোলার ম্যাজিশিয়ান একজনই। তিনি নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath)।
শুধুমাত্র এই নামের উচ্চারণেই বাঙালির স্মৃতির চিলেকোঠায় ভেসে ওঠে কত না সব সুখস্মৃতি! প্রজন্মের পর প্রজন্ম বুঁদ সেই স্মৃতিকথায়। জীবনের পথচলা তাঁর ফুরোলেও, অগণিত মানুষের মনে যার ঘর বাঁধা রয়েছে, অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ে যাঁর বসতি, তাঁর পথচলা আর শেষ হয় কী করে! বাঙালির মনের ঘরে আজ তাই চলছে নিরন্তর ছবি-আঁকা। সকলেরই যেন নিজের ছোটবেলার একটা অংশকেই জড়িয়ে ধরছেন আরও নিবিড় করে।
প্রখ্যাত শিল্পী দেবাশিস দেব স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন, “বলতে পারি আমার ছোটবেলার একটা অংশ যেন চলে গেল। গোড়ার দিকে আমি যাঁদের ইলাস্ট্রেশন দেখেছি, দেখে শিখেছি, নারায়ণ বাবু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এত ভার্সেটাইল তিনি। সিরিয়াস কাজ যেমন করছেন, সেই সঙ্গে মজার কাজও করছেন। সেই ইলাস্ট্রেশন আজও আমার চোখে লেগে আছে। এরপর উনি যখন কমিকসে এলেন তখন তো আর একটা পৃথিবীই যেন খুলে গেল। একদিকে হিউমার, অন্যদিকে বাঙালি জীবনের খুঁটিনাটির অমন নিখুঁত চিত্রায়ন-এই যুগলবন্দি অবিশ্বাস্য। বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদা তো আছেই, ওর সঙ্গে ওই যে হেড মাস্টার বা মেসবাড়ি কিংবা মাংসের চপ ভাজা হচ্ছে আর পিছন থেকে তুলে নেওয়া হল-এই বিষয়গুলো অসামান্য। আমাদের জীবনযাপন, যাপনের ধরনকে কতটা নিখুঁত, গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে দেখলে এই কাজ ফুটিয়ে তোলা যায়, তা ভাবলে অবাকই হতে হয়। ৫০ বছর ধরে নারায়ণবাবু কমিকস করে গিয়েছেন, আমি তো বলব এটা একটা রেকর্ড।”
এ যেমন এক রেকর্ড তেমন আর এক অদৃশ্য রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল। বলছেন, “আজও মনখারাপ হলে অন্য কিছু নয়, নন্টে-ফন্টে হাতে নিয়ে বসি। এখন তো আমি আর আমার ছেলে দু’জনেই একসঙ্গে পড়ি। আর অবাক হয়ে ভাবি, একজন মানুষের কী অসাধারণ ক্ষমতা থাকলে, তবে এইভাবে দুই প্রজন্মকে চুম্বকের মতো টেনে ধরে রাখতে পারেন। উনি চলে যাবেন, এ যেন আমরা জানতামই। তবু পরীক্ষায় বসা আর তার প্রস্তুতি তো এক নয়। আজ এত মনখারাপ লাগছে যে কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার শৈশবের একটা অংশই খসে গেল। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, নারায়ণ বাবু না থাকলে আমার শৈশবটা গোমড়া হত।”
শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath) এভাবেই মানুষের হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন অবিস্মরণীয় সম্রাট হয়ে। দেবাশিস দেব বলছিলেন তাঁর অনাড়ম্বর জীবনের কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন শিল্পীমন আজীবন মগ্ন থেকেছেন রং-তুলির বিস্ময়কর খেলায়। একই স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে বিনোদ ঘোষালেরও। কত সাধারণ জীবন যাপন করেছেন নারায়ণবাবু। একটা ছাপোষা ঘরে বসে কত না স্বল্প উপকরণেই শুধু কমিকসে বাঙালি জীবনের মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন তিনি। এ যেন এক অবিশ্বাস্য ম্যাজিক। দু’জনেই বলছেন, অন্য দেশে জন্মালে হয়তো শিল্পী আরও খ্যাতি কিংবা কদর পেতেন। কিন্তু সে কথা থাক। বাঙালি পাঠক তাঁকে যেভাবে ভালবেসেছেন, গত কয়েক দশক ধরে যেভাবে তিনি বাঙালির অন্তরমহলে আপনজন হয়ে উঠেছেন তাই-ই বোধহয় একজন শিল্পীর সবথেকে বড় প্রাপ্তি। বাঙালির কাছে তিনি জাদুকর, বাঙালি তাঁকে স্মৃতিতে বেঁধে রেখেছে ভালবাসার জাদুতেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.