Advertisement
Advertisement

আমি আর তুমিই কিন্তু ভারতবর্ষ নই

আমার আপনার আরবান ইন্ডিয়ার বাইরে যে একটা বড় মেঠো ভারতবর্ষ রয়েছে তাঁদের হাহাকারগুলো উত্তেজনা এবং জাকজমকের নিচে অজান্তেই চাপা পড়ে গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়৷

You and me, are not the only India!
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:November 10, 2016 7:08 pm
  • Updated:November 11, 2016 9:51 pm  

আমার আপনার আরবান ইন্ডিয়ার বাইরে যে একটা বড় মেঠো ভারতবর্ষ রয়েছে তাঁদের হাহাকারগুলো উত্তেজনা এবং জাকজমকের নিচে অজান্তেই চাপা পড়ে গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়৷ তাঁদের কথাই লিখলেন উর্মি খাসনবিশ৷

-নোটগুলা আর চলবে না বলসিল তো! চলবে না ক্যামনে?

Advertisement

– ঘরের মধ্যে হারুর মা টাকা রাখসিল তো! খুচরা রাখন যায় না, তাই সব খুচরা দাসদারে দিয়া পাঁচ খান ১০০০ টাকার নোট লইয়া আসল৷ ওই টাকা চলবে না কি?

-নোট বাতিল! ও আর চলবে না! কী সব কালোবাজারি, জাল টাকার কারবার নাকি হইতাসিল! তাই বন্ধ কইরা দিসে!

-টাকাগুলা তো কষ্টের! এমনি এমনি বাতিল?

-শোন, হরেন দা শুনতাসি নাকি ব্যাঙ্কে গেলে ওরা কিসু সাহায্য করব কইসে৷ কিসু টাকা নাকি তোমারে দিতেও পারে৷

-ব্যাঙ্ক তো সেই শহরে! ওখানে তো যাই নি কোনদিন৷ ওখানে কারুরে তো চিনি না কালু! ব্যাঙ্কে না যাইতে পারলে টাকাগুলা কী হইব? জলে যাব অতগুলা টাকা?

প্রশ্ন উঠতে পারে, টাকা তো বাতিল নয়, তবে বার বার বাতিল বলছেন কেন? আপনার প্রশ্ন জাগতে পারে, অচল ৫০০, ১০০০ টাকার নোটগুলি ব্যাঙ্কে জমা দিলেই তো তার বদলে পাওয়া যাবে চকচকে নতুন নোট৷ তাছাড়া আরবিআই-এর তরফ থেকে তো বলে দেওয়াই হয়েছে, এবার এটিএমে ৫০ টাকার নোটও পাওয়া যাবে৷ কটা দিনের মাত্র ক্রাইসিস৷ তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে!

সেটাই হয়তো স্বাভাবিক৷ আমার, আপনার মনে এমন প্রশ্ন জাগছে কারণ আমরা সমাজ সচেতন৷ লেখাপড়া করি, দেশে-বিদেশে প্রতিনিয়ত কী হচ্ছে তার খবর আমরা পাই৷ আমরা পর্যাপ্ত সরকারি পরিষেবা পাই৷ আর না পেলে আদায় করে নিতে পারি৷ আমাদের কাছে কমিউনিকেশনের জন্য প্রয়োজনীয় মিডিয়ামও রয়েছে৷ ইলেকট্রনিক এবং ডিজিটাল মিডিয়া মারফত এখন পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয়৷ আমরা তো জানি, মঙ্গলবার রাত থেকেই যে আধার, প্যান এবং ভোটার কার্ড ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক থেকে পাল্টে নেওয়া যাবে অচল হয়ে যাওয়া ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট৷ অকারণ প্যানিক করার কিছু নেই৷ কিন্তু যে মানুষটা পুরুলিয়া কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন, যে অঞ্চলে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, যেখানে মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে অবগত নন তাঁদের পক্ষে এক রাতের মধ্যে টাকা-তথা দেশ পরিবর্তনের গল্প জানা আদৌ সম্ভব কি? যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, যাঁরা এখনও ভোটার আইডি কার্ডের মুখ দেখেননি, যাঁরা এখনও টিপ সই দিয়ে ১০০ দিনের কাজের টাকা নেন, তাঁদের কাছে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, পর্যাপ্ত খবরাখবর থাকবে, এমন আশা আদৌ করা যায় কি?

আপনি উলটে আমায় প্রশ্ন করবেন, যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে খানিক দুর্বল, তাঁদের কাছে আবার ৫০০, ১০০০ টাকা থাকে নাকি? এতো বড়লোকদের জিনিস! আপনি প্রশ্নটা এমন ভঙ্গিতেই করবেন যেন টাকা এবং সঞ্চয় কেবল বিত্তবানদেরই কুক্ষিগত৷ কোনও দরিদ্র মানুষ টাকা জমানোর বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও করতে পারবেন না৷

কিন্তু খুব আশ্চর্যভাবে যে কোনও মানুষ সঞ্চয় করেন৷ সে যতটুকুই অর্থ হোক না কেন৷ ভবিষ্যতের চিন্তায় দু’ পাঁচ হাজার টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা প্রায় সিংহভাগ মানুষই করে থাকেন৷ আর এটা কোনও অপরাধ নয়৷ সেই মানুষগুলোর অর্থই এখন সংকটে৷ তাঁদের অনেকেই জানেন না বহু কষ্টে সঞ্চিত এই টাকা এক ঝটকায় বাতিল হয়ে গিয়েছে কিনা! তাঁদের অনেকেই জানেন না, এই টাকাগুলোর ভবিষ্যৎ কী? আর এই সুযোগেই তাঁদেরই ঠকাবেন কিছু মানুষ৷ বোকা বানানো হবে তাঁদের! ১০০০ টাকার নোট নিয়ে ধরিয়ে দিতে চাইবেন ৭০০ টাকা৷ বোঝাতে চাইবেন, সেই টাকা আসলে বাতিল৷ উপকার হিসাবে ৭০০ দিচ্ছেন৷

এমন ঘটনা ঘটছে! এমন ঘটনা আগামী কয়েক দিনে আরও ঘটবে৷ আর এই পরিস্থিতির জন্য কিন্তু এই মানুষগুলোর কোনও দোষ নেই৷ তাঁরা কেবল পরিস্থিতির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন৷ আর নিজেদের ভাগ্যকে ছাড়া কাউকে দোষ দেওয়ার নেই তাঁদের৷

ছোটবেলা থেকে নিজের জেঠিমাকে দেখেছি, বাড়িতে জমিয়ে রাখতেন কিছু টাকা৷ পুরনো দিনের মানুষ তিনি৷ ব্যাঙ্কের ধার ধারেন না এই শহরে থেকেও৷ এটিএম কার্ড সম্পর্কেও কোনও জ্ঞান নেই৷ অথচ খবরে শুনলেন বুধবার সকালে তাঁর জমানো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট সব বাতিল৷  এক্সচেঞ্জ করতে গেলে ব্যাঙ্কে যেতে হবে৷ জেঠিমার চোখে খবরটা শোনার পর যে অসহায়তা দেখেছি সেটাই কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষ৷

মুষ্টিমেয় মানুষের লেখাপড়া, ফেসবুক, খবরের কাগজ, সামাজিকতার এবং বিচক্ষণতার বাইরে গিয়ে আমাদের দেশটা এখনও যে তৃতীয় বিশ্ব, এখানে যে বহু মানুষ এখনও নিরক্ষর, সেই কথাই আমরা ভুলে যাই৷ ডিজিটাল ইন্ডিয়ার জাকজমকে কখন যে এই মানুষগুলো বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে তার খবর আজ কেউ রাখি না আমরা৷

আর রেখেই বা কী হবে? পিছিয়ে পড়া মানুষরা তো ইতিহাস তৈরি করতে পারেন না৷ তাঁরা তো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না৷ তাই তাঁরা আজ দেশে থেকেও ব্রাত্য৷ তাঁদের প্রয়োজনগুলোও তাই৷

আমার আপনার আরবান ইন্ডিয়ার বাইরে যে একটা বড় মেঠো ভারতবর্ষ রয়েছে তাঁদের হাহাকারগুলো উত্তেজনা এবং জাকজমকের নিচে অজান্তেই চাপা পড়ে গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়৷ সেগুলো বোধহয় আর শোনা গেল না!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement