বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে উদ্বিগ্ন দুনিয়া। এবারও সেখানকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বয়কট করছে। সিদ্ধান্তে শরিক হয়েছে জামাত। সঙ্গে মাথাব্যথা বাড়াচ্ছে মার্কিন সরকারের ভিসা নীতি। হাসিনাও বিলক্ষণ জানেন, আমেরিকাকে ছাড়া বাংলাদেশের গতি নেই। কিন্তু আমেরিকা কী চায়? জয়ন্ত ঘোষাল
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি। জাতীয় ভোটার দিবসে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৯ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ জন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। তার মানে ভোটার সংখ্যা তার ৭০ শতাংশ।
তবে এবার বাংলাদেশের নির্বাচনে কী হবে তা নিয়ে সারা দুনিয়া উদ্বিগ্ন। নানা কারণে শুধু ভারতই নয়, চিন-আমেরিকা-রাশিয়া, এমনকী ইউরোপের দেশগুলিও তাকিয়ে। কারণ কী? আসলে কারণ আছে অনেকগুলি। গতবারের মতো এবারও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বাংলাদেশের ভোট বয়কট করছে। বিএনপির এই সিদ্ধান্তে শরিক হয়েছে জামাত। এই যৌথশক্তি ভোট বয়কট করলেও মানুষ নিশ্চিন্ত নয়। কারণ ভোটে যোগ না দিলেও বিএনপি ও জামাত চেষ্টা করছে ভোটের দু’দিন আগে থাকতেই দেশে এক ব্যাপক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আক্রমণাত্মক রাজনীতি শুরু করা। যাকে বলে হিংসার রাজনীতি। হিংসা ও সন্ত্রাসের জেরে বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রর আবহ নষ্ট করে দেওয়া। কারণ তা সম্ভব হলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলবে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। গণতন্ত্রর আবহ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। অতএব এই ভোট বাতিল হোক। তার বদলে তৈরি হোক এক তত্ত্বাবধায়ক বা ‘কেয়ারটেকার সরকার’। সেই সরকারের দেশের দায়িত্ব দেওয়া হোক, তার ছ’-মাস পর হোক নির্বাচন। এই পথে বিএনপি কোনওমতে হঁাটতে পারলে– সেই নির্বাচনে তারাও যোগ দিতে পারে।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ। গৃহবন্দি। তঁার পুত্র এখন বিদেশে। নানা অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। তাই তিনিও কোনওভাবেই ঢাকায় আসতে পারছেন না। তবে বিএনপি দলের দ্বিতীয় স্তরের বহু নেতা সক্রিয়। তঁারা আশা করছেন, আমেরিকার প্রশাসনের একটা অংশ থেকে সমর্থন মিলতে পারে, মার্কিন প্রশাসনের যে-অংশ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। তঁারা মনে করছেন, হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতা চরমে পৌঁছেছে।
এই হাসিনা-বিরোধী শক্তি প্রথম থেকেই চায় নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসকে কেয়ারটেকার সরকারের ‘প্রধান’ করতে। কিন্তু এখনও বিএনপি এবং বিরোধীদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সফল কেন হয়নি তার জন্য সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার। এবং তার নেপথ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থন ভারতের। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকার ও শেখ হাসিনাকে অচলাবস্থায় ঠেলে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তঁার প্রশাসনকে বুঝিয়েছেন যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আগুন লাগলে তার অঁাচ এসে ভারতে লাগবে। বাংলাদেশ হোয়াইট হাউসের কাছে অগ্রাধিকার না-ই পেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে জামাতের মতো ইসলামিক মৌলবাদী দলের যদি শক্তিবৃদ্ধি হয়– তবে তাতে লাভ হবে চিন ও পাকিস্তানের। বাংলাদেশে চিন অনেক দিন ধরেই প্রবেশ করতে চাইছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি-জামাত নির্ধারক শক্তি হলে চিন সহজেই বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাতে শুধুমাত্র ভারতের সার্বভৌম স্বার্থেই নয়, আমেরিকারও স্বার্থেও ঘা পড়বে।
আমেরিকা যখন ভোটের আগে ঘন-ঘন ঢাকায় গিয়ে নাক গলানো শুরু করে, তখন হাসিনা নিজে ছোট একটি দেশের নেত্রী হয়েও সার্বভৌম স্বার্থ নিয়ে আপস করেননি। তবে ‘জি২০’ সম্মেলনে দিল্লি এসে হাসিনার সঙ্গে বাইডেন সেলফি তুলতে রাজি হন। কারণ, হাসিনা বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি জানেন, আমেরিকাকে ছাড়া বাংলাদেশের গতি নেই। বাংলাদেশের উপর যদি আমেরিকা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়, তাহলে মস্ত বড় বিপদে পড়বে ঢাকা। কারণ আমেরিকা ও ইউরোপে ভারতের চেয়েও ঢাকার রফতানির হার অনেক বেশি।
আবার অন্যদিকে অবসরপ্রাপ্ত বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটন, মহম্মদ ইউনূসকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন– হাসিনা প্রশাসনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে। আমেরিকাও ভিসা নীতি নিয়ে মৌখিক হুমকি দেওয়া ছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় কোনও বাদ সাধেনি। সম্প্রতি হাসিনা সরকার ভোটের মুখে মহম্মদ ইউনূসকে গ্রেফতারও করল। আমেরিকার সরকার কিন্তু প্রকাশে্য এ ব্যাপারে কোনও বিরোধিতা করেনি।
হাসিনা প্রশাসনের অভিযোগ– মহম্মদ ইউনূস তঁার সঞ্চয়ের স্বেচ্ছাসেবী স্বায়ত্ত্বশাসনের মডেলের মাধ্যমে দেশে এক সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরি করেছেন। এই মাইক্রো সংস্থায় বিদেশি বিনিয়োগও ঢুকেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গোলমাল সৃষ্টি করেছে। ইউনূস গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে ঢাকায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে ভোট নিয়ে আস্থা বেড়েছে। মানুষ আশ্বস্ত হয়েছে– শেখ হাসিনা দুর্বল নন। এই প্রেক্ষাপটে তাই ৭ জানুয়ারির ভোট হয়ে উঠেছে বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তাহলে আমেরিকা কী চাইছে? একটা ধারণা জনপ্রিয় হয়েছে যে, আমেরিকা শেখ হাসিনা সরকারের একনায়কতন্ত্রী মানসিকতায় ক্ষুব্ধ। তারা ভোটের বদলে ‘তদারকি সরকার’ গঠনে আগ্রহী। এজন্য আমেরিকার বক্তব্য বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট না-হলে তারা বাংলাদেশের ভিসা বাতিল করবে। কিন্তু হঁাড়ির খবর আসলে কী? সত্যি-সত্যিই কি আমেরিকা হাসিনার বদলে বিএনপির শাসন চাইছে? বাংলাদেশে ও ভারতের বহু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পর আমার যা ধারণা হল, সেগুলি সূত্রাকারে জানাই।
এক, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সর্বক্ষণ বাংলাদেশে কী হচ্ছে, তা জানতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশের ভোট বিএনপির অগ্রাধিকার, হোয়াইট হাউসের জন্য নয়।
দুই, প্রাক্তন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের এই ডেমোক্র্যাটিক শাসনে প্রভাব-প্রতিপত্তি যা আছে– ট্রাম্পের রিপাবলিক জমানায় ছিল না। হিলারি ব্যক্তিগতভাবে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসের বিশেষ সমর্থক। এজন্য বাংলাদেশে ইউনূসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কিছু নোবেলজয়ী সেই দুর্নীতির তদন্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি জারি করেন। আর সেই যৌথবিবৃতিকে সমর্থন করে টুইট পর্যন্ত করেন হিলারি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ‘হিলারি ফাউন্ডেশন’ ও ইউনূসের ‘গ্রামীণ ব্যাঙ্ক’ সংস্থার মধে্য। এখনকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান অতীতে হিলারির অধস্তন ছিলেন। হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগন না থাকলেও তাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশ হাসিনা-বিরোধী অবস্থান নেয়।
‘টাইম’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধে হাসিনার স্বৈরাচারের কথা লেখা অথবা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিক্রিয়া এই কৌশলের অঙ্গ। এমনকী, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করা হলেও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও অবাধ নির্বাচনের শর্ত আরোপ করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশ্নে।
তিন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশের এই বিরোধিতা কিন্তু হঠাৎ নয়। অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ, ২০১৪ সালের ভোটের সময়, পোস্টেড ছিলেন পাকিস্তানে। ছিলেন ঢাকার ‘ডেপুটি চিফ অফ দ্য মিশন’। তিনি এখন খুবই সক্রিয় এই হাসিনা-বিরোধী প্রচারে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমে তিনি নিয়মিত বিএনপি ও জামাতের পক্ষে লিখে চলেছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে চিনের বন্ধুত্ব বেশি গভীর – এমন একটি ধারণা পোষণ করে আমেরিকা। বাংলাদেশের অনেকে এ প্রশ্ন করছেন, ভারত যদি এত ‘বন্ধু’-ই হয় তবে আমেরিকাকে কেন বোঝাচ্ছে না, কেন চাপ সৃষ্টি করছে না! ভারত একবার নয় বারবার আমেরিকাকে বোঝাতে চাইছে– বাংলাদেশের বিদেশনীতি (‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবুর রহমান যার স্থপতি) যেভাবে বিন্যস্ত তাতে বাংলাদেশের ‘শত্রু রাষ্ট্র’ নেই। দুই দেশের মধ্যে ঝগড়া থাকলে বাংলাদেশ একপক্ষর হয়ে অন্যপক্ষর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না। এবার দিল্লিতে জি২০-র সময়ও আমেরিকাকে বুঝিয়েছে ভারত, কেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের ভোটে আমেরিকার নাক গলানো ভারত পছন্দ করছে না।
সেদিন ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এক বড়কর্তা বলছিলেন, প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ঝগড়া করা আমাদের লক্ষ্য নয়। কূটনীতির সাফল্য আসে গোপনে কার্যসিদ্ধির মাধ্যমে। আমেরিকার ইগোয় আঘাত না-করে ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের সঙ্গে বোঝাপড়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে আমেরিকার এই রণকৌশলের মোকাবিলা করেছেন। সবদিক সামলে চলার চেষ্টা করছেন শক্ত হাতে। বাংলাদেশের সংসদেও তিনি মার্কিন দাদাগিরির কঠোর সমালোচনা করার সাহস দেখান।
শেখ হাসিনার বাবা ‘বঙ্গবন্ধু’-র তৈরি করা বাংলাদেশি জাতীয় পতাকার চারটি লাল তারা– ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের প্রতীক। প্রতিবেশী এই
বন্ধু-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক চিরস্থায়ী হোক, নতুন বছরে এটাই প্রত্যাশা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.