প্রয়াত হলেন উইলিয়াম রাদিচে। কবি, অনুবাদক, সর্বোপরি বাংলাপ্রেমী। ফিরে দেখা তাঁর বিবিধ আলো। তাঁকে নিয়ে লিখলেন পবিত্র সরকার।
ঔপনিবেশিকতা থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিকতায় কিছু কিছু কাজ অব্যাহত থাকে। উপনিবেশ তার নিজের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই বিজিত বা পরাভূত জাতির সমস্ত কিছুকে জানতে চায়, ‘জ্ঞানই শক্তি’– এই কথাটার একটা নিজস্ব অর্থ তৈরি করে। এজন্য তৈরি হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র মতো প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিপুল গবেষণার পরিসর তৈরি হয়। আবার ব্রিটেনের মতো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপনিবেশের পাঠ্যক্রমও তৈরি হয়। প্রাচ্যবাদীদের মুখে প্রাচ্যের একটি মহিমাও প্রচারিত হয়।
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘এরিয়া স্টাডিজ’ বলে একটা ব্যাপার আছে। কথাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। হয়তো তারও প্রতিষ্ঠার মূলে সে-দেশের একটা বিশ্বব্যাপী প্রভাববিস্তারের স্বপ্ন ছিল, যেখানে দেশ-বিদেশের নানা ভাষা ও সংস্কৃতিবস্তু শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু উপনিবেশ অপসারিত হওয়ার পর আস্তে আস্তে হয়তো দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। সাম্রাজ্যের স্বার্থে বা আগ্রহে নয়, ব্যক্তিগত অনুরাগ ও শ্রদ্ধা থেকে কেউ কেউ দূর দেশের ভাষা ও সাহিত্য পড়তে এগিয়ে আসে।
এরকম এক মানুষ ছিল উইলিয়াম রাদিচে। ৭৩ বছরে উত্তর ইংল্যান্ডের নিউ কাসলের বাড়িতে জীবন নির্বাপিত করে চলে গেল সেই ছ’-ফুটের বেশি দীর্ঘ, শান্ত, ভদ্র, গলার কণ্ঠা একটু উঁচু হয়ে বেরিয়ে থাকা ইংরেজ যুবকটি (আমাদের স্মৃতিতে তাকে বৃদ্ধ হিসাবে পাইনি আমরা), যে বাংলা ভাষা, বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালবেসে জীবন কাটিয়েছে। জীবনের শেষদিকের কয়েকটা বছর সে প্রায় শয্যাশায়ী ছিল, একটি ট্রাকের ধাক্কায় তার মস্তিষ্কে যে আঘাত লেগেছিল, তার থেকে সে আর পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি। তাকে আমেরিকান ধরনে ‘বিল’ না বলে আমরা ‘উইলিয়াম’ বলেই ডাকতাম। সম্ভবত ১৯৮০-র গোড়ার কোনও এক বছর সে এসেছিল যাদবপুরে শঙ্খদা আর আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে। তারপরই আমি তার ‘পবিত্রদা’ হয়ে যাই। তার পদবি ইংরেজি ধরনের ‘রেডিস’ না ‘রাদিচে’– এই নিয়ে একটু পিছনে লাগার মতো প্রশ্ন করলে সে বলে, ‘আপনারা রাদিচেই বলবেন, কারণ বাঙালিদের মুখে ওটাই চমৎকার শোনায়। আসলে আমার পূর্বপুরুষ ছিল ইতালীয়, আমার পদবির ওটাই মূল উচ্চারণ।’
সে চলে যাওয়ায় পশ্চিমে বাংলা সংস্কৃতির মহাদেশীয় প্রতিনিধির সংখ্যা কমে গেল। কয়েকজন রয়ে গেলেন– যেমন, মার্কিন দেশে ক্লিন্টন সিলি, ব্রায়ান হ্যাচার, ইংল্যান্ডে জো উইন্টার, ফ্রান্সে ফ্রান্স ভট্টাচার্য, জার্মানিতে মার্টিন কেম্পশেন, অস্ট্রেলিয়ায় ম্যারিয়ান ম্যাডার্ন। নিশ্চয়ই আমার জানার বাইরে আরও অনেকে আছেন, বা নিজেকে ক্রমপ্রস্তুত করছেন ওই ভূমিকার জন্য।
তবে এঁদের মধ্যে উইলিয়ামের ভূমিকা একটু আলাদা। আলাদা এই কারণে যে, তার বই, মূলত রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর ছোটগল্পের অনুবাদ, ‘পেঙ্গুইন’ প্রকাশনার সূত্রে বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছেছে, আর যথার্থই পশ্চিম দেশে, বিশেষত ইংরেজিভাষী বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের রচনার পুনরুজ্জীবনে অনেকটা সাহায্য করেছে। আরও অনেক অনুবাদ তার রয়েছে, তার উল্লেখ আমরা পরে করছি। তার ‘গীতাঞ্জলি’-র একটি নতুন অনুবাদ করার ইচ্ছা ছিল, আর আমরা পেলাম না। অন্যদের বই এত বেশি বাইরের লোকের কাছে পৌঁছয়নি।
তবে, ইংরেজিভাষী বিশ্বে, ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম সম্পূর্ণ ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল, এমন ভাবা উচিত হবে না। আমরা অন্যত্র তার কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছি। তার একটি, এক প্রোটেস্ট্যান্ট সুইস-আমেরিকান ডাক্তার, আসলে মনোবিশেষজ্ঞ, ডা. এলিজাবেথ কুবলার রস্ ১৯৬৯ সালে আসন্নমৃত্যু রোগীদের মৃত্যুচিন্তা নিয়ে গবেষণা করে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, তাতে ১৩টি জায়গায় তিনি জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন। স্প্যানিশভাষী বিশ্বে, পূর্বতন সোভিয়েতের নানা দেশে (লাতভিয়ার ভিক্তর ইভ্বুলিসের কথাও আমরা জানি), মধ্যপ্রাচ্যে ও মিশরে, জাপানে,
চিনে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে খুঁজলে এরকম দৃষ্টান্ত আরও পাওয়া যাবে। তাছাড়া, ওসব দেশের যে-যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বা ভারতীয় সাহিত্যপাঠ্য আছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ নানাভাবেই পাঠ্য। তা, কখনও-বা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র, কখনও-বা বাউল সংস্কৃতি অনেক সময় বিদেশিদের বাঙালির সাহিত্য ও জীবনচর্যা সম্বন্ধে জানতে উৎসুক করে। তার আয়োজন শুরু হয় ভাষাশিক্ষা দিয়ে।
বিলেতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোয়াস’ (SOAS) বা ‘School of African and Asian Studies’ এরকম একটি অতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। উইলিয়াম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়া ছেড়ে দিয়ে এখানে আসে এবং প্রয়াত অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নেয়। পরে সে এই স্কুলেরই সিনিয়র লেকচারার হয়েছিল, বাংলারই অধ্যাপক। তারও আগে সে ভারতে ছিল, ভারতের নানা জায়গায় স্কুলে পড়িয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু সে সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তবে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে সঙ্গে নব-উদ্ভাসিত বাংলাদেশও তার প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছিল কালক্রমে, এবং সেখানেও সে যথেষ্ট বন্ধুত্ব ও সমাদর পেয়েছে। ঢাকার বাংলা একাডেমিতে সে চারটি বক্তৃতাও দিয়েছিল, তা প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের বহু মানুষ শোকার্ত হবে।
মূলত রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর ছোটগল্প অনুবাদক হিসাবেই সে আমাদের কাছে প্রিয় ও সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি ভাষার কবি হিসাবেও যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছিল। তার একাধিক কবিতার বই আছে: ‘Eight Sections’, ‘Strivings’, ‘Gifts: Poems 1992-1999’, ‘This Theatre Royal’ ইত্যাদি। সাহিত্য তার পারিবারিক উত্তরাধিকার, কারণ তার মা বেটি রাদিচে ছিলেন কোনও একটি সাময়িকপত্রের সম্পাদিকা। বাংলা ও ভারত ছিল তঁার প্রাণকেন্দ্রে। শুধু রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ নয়, সে উপেন্দ্রকিশোরের ‘টুনটুনির বই’ অনুবাদ করেছিল ‘The Stupid Tiger and Other Tales’ নামে। মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ছিল তার গবেষণা, আর সে তার অনুবাদও করেছিল ‘The Poem of Killing Meghnad’ নাম দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’-এর অনুবাদ (Snatched by the Gods) ছাড়াও ‘কণিকা’, ‘লেখন’ আর ‘স্ফুলিঙ্গ’-র
কবিতা অনুবাদ করেছিল ‘Particles, Jottings, Sparks’ নামে।
‘The Post Office’, ‘The Card Country’ আর অন্যদের সঙ্গে তার কাজের আরও তফাত এই যে, সে ইংরেজিতে বিখ্যাত ‘Teach Yourself’ সিরিজে ‘Teach Yourself Bengali’ (১৯৯৫) নামে একটি বইও প্রকাশ করে। ব্যক্তিগত মন্তব্য হিসাবে যোগ করি যে, তারই অনুরোধে তখন ইংরেজি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকা আমাকে ওই বইটি রিভিউ করতে দেয়। আমি এক রবিবারে পুরো পাতার রিভিউ করি, সে পড়ে খুশি হয়। আমি কয়েকটি অতিশয় সহজ বিষয়ে তার কিছু ভুল দেখিয়েছিলাম। পরে যখন কলকাতায় দেখা হল, তাকে জিজ্ঞেস করি অত সহজ বিষয়ে ওই ভুলগুলো সে করল কী করে? সে আমাকে বলে, বইটা লিখতে লিখতে তার একসময় মনে হয়েছিল, আর সে পারবে না, তার আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা নেই ওই বই নিয়ে। তারই ফঁাকে ওই ভুলগুলো ঢুকে গিয়েছে। পরের সংস্করণে সে নিশ্চয়ই শুধরে নেবে। আমার সে উত্তর সংগত মনে হয়নি, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য সে এত কিছু করেছে যে, তা গ্রহণ করেছি।
সংগীতে তার আকর্ষণ ও দক্ষতা ছিল গভীর, এটা বোধ হয় তার ইতালীয় রক্তের প্রভাব। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান নিয়ে সে অপেরা ধরনের কত কাজ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দেবাশিস রায়চৌধুরীর কাছে তার কিছু খবর পেলাম। উইলিয়াম কলকাতায় এসে দেবাশিসের নির্দেশিত ‘রাজা’ নাটকের ইংরেজি পরিবেশনায় রাজার অভিনয় করেছে, দেবাশিসকে পরামর্শ দিয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের ইংরেজি রূপান্তরে গাওয়ার দরকার নেই, বাংলাতেই গাওয়া হোক। দেবাশিসও পিটার ব্রুকের ‘মহাভারত’ দেখে উৎসাহিত হয়েছিল বলে জানাল। বিলেতেও নানা অপেরা প্রযোজনা করেছে উইলিয়াম, ‘দেবতার গ্রাস’-এর কথা তো আগেই বলেছি, যাতে সুর দিয়েছিলেন ভারতীয় সুরকার পরম বীর। এই বিচিত্রকর্মা, সুভদ্র মানুষটির মৃত্যুতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় বন্ধুকে হারাল যদি বলি, আশা করি, তা অন্যদের উপর অবিচার হবে না।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ভূতপূর্ব উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.