২০২২ সালের অর্থনীতির নোবেল পেলেন তিন মার্কিন অর্থনীতিবিদ- বেন বার্নাঙ্কে, ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ। নোবেল কমিটি জানাচ্ছে, এই পুরস্কার ‘ব্যাঙ্ক এবং অর্থনৈতিক সংকট’ নিয়ে গবেষণার জন্য। কমিটির আক্ষরিক অনুবাদে ‘তাঁদের গবেষণায় বিশেষ অবদান: কেন ব্যাংকের পতন এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।’ কলমে শুভময় মৈত্র
শিক্ষিত বাঙালির সংবাদ এবং সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক জগতের বেশিরভাগটাই অধিকার করে থাকে বঙ্গ-রাজনীতি। সেই কারণেই অনুষ্ঠান প্রচার-সংক্রান্ত ব্যাপ্তির সূচকে অনেক সময়েই উচ্চগ্রামে রাজনৈতিক বিতর্কের কাছে পাঁচ গোল খায় মেলোড্রামায় ভরপুর টিভি সিরিয়াল। তবে বাঙালি শিক্ষিত। সেই প্রমাণে মাঝে মাঝে পড়াশোনার কথা আলোচনা করতেই হয়। এমনিতে জনপ্রিয় জগতে পড়াশোনার জায়গা কম।
সেখানে নেতা-নেত্রী থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কদর বেশি। তবে তেরো পার্বণের সঙ্গে এক যোগ করে শরৎ-শেষে বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ে, কারণ এই সময় নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়। নোবেল আলোচনায় আমাদের কাছে অর্থনীতির দর বেশি, দখলও। এর কারণ বিশদ করার প্রয়োজন নেই। শুধু প্রেসিডেন্সি কলেজের যোগাযোগেই দু’জন বাঙালির নোবেলপ্রাপ্তি। তবে আমরা আত্ম-সমালোচনা করতে জানি। তাই অর্থনীতির নোবেল নিয়ে কথা বলার সময় বারবার মনে করিয়ে দিই যে, এটা নোবেল, তবে ঠিক ততটা ‘নোবেল’ নয়।
১৮৯৫ সালে যখন এই নোবেল পুরস্কার চালু হয়, তখন অর্থনীতি সেই তালিকায় ছিল না। ১৯৬৮ সালে সুইডেনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঘোষিত হয়েছিল নোবেল স্মারক পুরস্কার। তার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৯-এ শুরু। নাম: সভেরিগেস রিকজব্যাংক পুরস্কার। সুইডিশদের মতো সম্পদ খুব বাড়াতে না-পারলেও, টাকার হিসাব আমরা নিক্তিতে কষি। এই পুরস্কারের মূল্য ৯০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনার, অর্থাৎ সাত কোটি ভারতীয় মুদ্রার থেকে কিছুটা কম। এ বছর তা ভাগ করে নিলেন তিন মার্কিন অর্থনীতিবিদ- বেন বার্নাঙ্কে, ডগলাস ডায়মন্ড আর ফিলিপ ডিবভিগ। মানুষের জীবনকথা সবসময়েই ঔৎসুক্য বাড়ায়। তবে প্রথম বিশ্বের গবেষকদের মধ্য থেকে যে নোবেল বা অন্যান্য বড় সম্মান পাওয়ার সুযোগ এবং সম্ভাবনা বেশি, তা নিয়ে তো আর বিতর্ক নেই। তাই এঁদের জীবন নিয়ে আলোচনার তুলনায় কাজ নিয়ে চর্চার চেষ্টা করা যাক। একটাই মজার পর্যবেক্ষণ যে, এই তিন গবেষকের বয়স খুব কাছাকাছি, প্রথম দু’জনের জন্ম ১৯৫৩-তে আর তৃতীয় জনের দু’বছর পরে।
নোবেল কমিটির আকাশপাতা জানাচ্ছে, এবারের অর্থনীতির নোবেল ‘ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক সংকট’ নিয়ে গবেষণার জন্য। কীভাবে আর্থিক সংকট বাড়ানো যায়, অথবা বন্ধুত্বপূর্ণ ধনতন্ত্রে কীভাবে সরকারি ব্যাংকের টাকা বেসরকারি মুনাফাভোগীর হাতে তুলে দেওয়া যায়- তার জন্য রাজনৈতিক নেতা থেকে শাসক হয়ে ওঠাই গুরুত্বপূর্ণ। অধিকতর জনমুখী ভাবনায় কৃষক থেকে শ্রমিক, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মানুষ, এদের নিয়ম করে মাসোহারা দেওয়াতেও সরকারি অর্থভাণ্ডারে টান পড়তে পারে। তেমন উদাহরণ তুলনায় শুনতে ভাল। কারণ সেক্ষেত্রে দেশের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৭০ শতাংশ সম্পদ গুছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি দায় থাকে না। অর্থাৎ, রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা দেশনেতা খুব সহজেই ব্যাঙ্কে সংকট সৃষ্টি করে নোবেল পেতে পারেন। ঠিক যেমন যুদ্ধ শুরু করে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া তেমন কঠিন নয়। তবে বাঁকা কথা ছেড়ে আবার নোবেল কমিটির বক্তব্যে ফেরা যাক। তাঁরা বলছেন, আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকের ভূমিকাগুলি বোঝার বিষয়ে বার্নাঙ্কে, ডায়মন্ড আর ডিবভিগ-এর কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে একেবারে আক্ষরিক বাংলা করছি একটি বাক্যের। ‘তাঁদের গবেষণায় বিশেষ অবদান হল কেন ব্যাংকের পতন এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।’ সামান্য অবাক লাগল এই কথায়। নিশ্চয়ই এই তিন গবেষক খুব ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু ব্যাংকের পতন এড়ানো যে জরুরি, এবং তা যে খুব স্বাভাবিক ভাবনাতেই বুঝতে পারা যায়, সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধি সম্পর্কে সেটুকু বিশ্বাস রাখতেই পারত নোবেল কমিটি। অর্থাৎ, একটু অন্যভাবে এবং আর একটু শক্ত করে বোঝালেও চলত।
যেমনটা নোবেল-পাতায় বলা হয়েছে, আধুনিক ব্যাঙ্ক বিষয়ক গবেষণা ব্যাখ্যা করে যে, কীভাবে এই ধরনের ‘টাকার উপর টাকার ব্যবসা’কে কম ঝুঁকিপূর্ণ করা যায়। অবশ্যই এখানে আঙ্কিক ভিত্তি লাগে, এবং সেই বিশেষ অঙ্কের একটি নিয়মানুবর্তী পথ সৃষ্টি করেছিলেন এই তিন গবেষক, গত শতকের আটের দশকের শুরুতে। অবশ্যই বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এই ধরনের বিশ্লেষণ অনেক সময়েই বাস্তবিক গুরুত্ব বহন করে। ব্যাংকের একটি মূল কাজ সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ। অর্থাৎ, যাঁরা জমা রাখছেন তাঁদের টাকা ধার দিতে হবে আর একজনকে। এমন অনেকেই আছি, যারা একই ব্যাংকে টাকা রাখি, আবার সেখান থেকেই টাকা ধার নিই। এইখানেই আসে অঙ্ক। ধরুন, আপনার ব্যাংকে স্থায়ী আমানত আছে ৫০ লক্ষ টাকা। এবার আপনি একটি বাড়ি কিনছেন ৪০ লক্ষ দিয়ে। তার জন্য নিজের আমানত থেকে ভাঙাচ্ছেন ২০, আর ঋণ নিচ্ছেন ২০। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন কর এবং কর ছাড়ের অঙ্ক। ফলে এই বিষয়টাই যখন লক্ষ-কোটি টাকা ধার নেওয়া বেসরকারি কোম্পানি কিংবা তার থেকেও বেশি ঋণের বোঝা চাপা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়, তখন অঙ্ক যে কঠিন- তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। তবে টাকা জমা দেওয়া আর ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেটুকু বোঝা সহজ। আর এই দ্বান্দ্বিক অবস্থানে কেউ কী করে নিজের আখের গোছাবেন- তার সর্বোত্তম সমাধানের পথ খোঁজার নিয়মাবলি নিয়ে অত্যন্ত গভীর গবেষণার কাজ করেছেন ডায়মন্ড এবং ডিবভিগ। সেই কাজে ব্যাংক হচ্ছে মধ্যস্থতাকারী ঋণগ্রহীতা আর সঞ্চয় যাঁরা করছেন তাঁদের পরোক্ষ যোগাযোগের মাধ্যম। এই প্রসঙ্গে একটা ভাল উদাহরণ নোবেল কমিটি দিয়েছে। আপনি টাকা রাখেন ব্যাংকে, এবং যখন খুশি তা তুলে নিতে পারেন। এদিকে যিনি ঋণ নিচ্ছেন বাড়ি করার জন্য, তিনি তো টাকা শোধ করবেন ২০ বছর ধরে, প্রতি মাসে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনই মধ্যস্থতাকারীর কাজ।
এবার বুঝতেই পারছেন যে, সবসময় অঙ্ক কাজ করে না। বিশেষ করে যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁরা প্রত্যেকে যে ধোয়া তুলসীপাতা কিংবা বুদ্ধির বৃহস্পতি- এমনটা নন। সেই জায়গাতেই এই তিন গবেষকের বিশ্লেষণ খারাপ দিকগুলোর কথাও তুলে এনেছে অত্যন্ত গভীরতার সঙ্গে।
দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলির ওঠানামা, বিভিন্ন গুজব, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, বেসরকারি পুঁজি- এইসব মিলেমিশেই তৈরি হয় নানারকমের ঝুঁকি। সবাই যদি ব্যাংক থেকে একসঙ্গে টাকা তুলতে ছুটে যান, তাহলে ব্যাংক যে লালবাতি জ্বালবে, এটা বোঝার জন্য নোবেল পেতে হয় না, তবে সহজ উদাহরণ হিসাবে কাজ চলতে পারে। অর্থাৎ ব্যবসার গতিশীলতা, তার সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন বিমা, দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে সমন্বয়সাধন- এই ধরনের বিভিন্ন যুক্তিপূর্ণ ভাবনার মধ্য দিয়ে ব্যাংককে সুষ্ঠুভাবে চালু রাখার বিষয়ে এই তিন গবেষকের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে অবশ্যই উন্নয়নমুখী অর্থনীতির কথাও আসবে।
ডায়মন্ড দেখিয়েছেন যে, ব্যাংকগুলি একইসঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে থাকে। সঞ্চয়কারী এবং ঋণগ্রহীতার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যাংকগুলি ঋণগ্রহীতার ঋণযোগ্যতা মূল্যায়ন করতে পারে। ঋণগুলির সঠিক বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বার্নাঙ্কে ১৯৩০ সালের আশপাশে যে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’, তার গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। আবার এটাও বলার যে, ২০০৮ সালে যখন মার্কিন দেশে ব্যাংকগুলি বিপুল আর্থিক সমস্যায় পড়ে, সেই সময় মার্কিন দেশের ব্যাংকগুলির বড় দায়িত্বে ছিলেন বার্নাঙ্কে। অর্থাৎ আধুনিক ইতিহাসে গত শতকের যে গোলমাল, তার বিশ্লেষণ করে যে বাস্তবে এই শতকের সমস্যা সামলানো যায় না, তা কিন্তু আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। এটা তো মানতেই হবে যে, পরমাণু সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান শিখে একটা বোমা বানানো তুলনায় সহজ, তাকে প্রত্যন্ত প্রদেশে আলো দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা অনেক শক্ত। ব্যাংক লালবাতি জ্বাললে ধনীদের অসুবিধা কম, তাঁরা সময় বুঝে নিজেদের টাকা সরিয়ে নেন। হয়তো দু’-একজন সম্পদশালী ব্যক্তি বিপদে পড়েন। কিন্তু আসল ক্ষতি হয় অনেক বেশি সংখ্যক সাধারণ আমানতকারীর। আসলে বহু মানুষের সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে চালিত করার ক্ষেত্রে অঙ্কের সঙ্গে লাগে শাসক কিংবা ক্ষমতাশালীর শুভবুদ্ধি। অঙ্কটা হয়তো ভাল করে দেখিয়েছেন এই তিন গবেষক। কিন্তু ক্ষমতাশালীরা তা শুনবেন কি? সামনের দিনে কোনও এক ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ কি রুখে দিতে পারবে এবারের নোবেল নামাঙ্কিত গবেষণা?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.