আটের দশক থেকে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নির্দেশিত পথে চলেছে বিশ্বের অর্থনীতি। এই পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণনীতির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ‘নরমপন্থা’ নিয়েই চলা হয়। কোষাগার ঘাটতির পালটা হিসাবেই কাজ করে শিথিল ঋণনীতি। আইএমএফ যখন বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রেই কোনও উজ্জ্বল ছবি দেখতে পাচ্ছে না, তখন রিজার্ভ ব্যাংকই বা কীভাবে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির কোনও উজ্জ্বল ছবি আঁকতে সফল হবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
রিজার্ভ ব্যাংক অর্থনীতির ফের একটি অন্ধকার ছবি সামনে আনল। বার্ষিক রিপোর্টে তারা সাফ জানাল, কোভিডের ধাক্কা কাটাতে অর্থনীতির আরও অন্তত ১২ বছর সময় লাগবে। একযুগ ধরে এই মন্দাভাব চলবে জেনে স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী হতাশ। রিজার্ভ ব্যাংক যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তার সঙ্গে আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর বক্তব্যের মিল রয়েছে। আইএমএফ-ও বিশ্বের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা উজ্জ্বল ছবি দিতে পারছে না।
আইএমএফ বলছে, ২০০৮ থেকে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে যে মন্দা শুরু হয়েছে, তার ধাক্কা উন্নত দেশগুলি কাটিয়ে ওঠার আগেই পরপর কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের (Ukraine war) ধাক্কা। ২০০৮-এ ‘সাবপ্রাইম লোন’ দিয়ে এই সংকটের সূত্রপাত। সেই সময় আমেরিকাতে একটার পর একটা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার ধাক্কা খুব দ্রুত এসে পৌঁছেছিল ইউরোপে। আইএমএফের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ২০০৮-এর সেই অর্থনৈতিক সংকট থেকে আধা-মুক্তি ঘটেছিল অর্থনীতির। ২০০৬ বা ২০০৭ সালে উন্নত দেশগুলির যে আর্থিক বৃদ্ধি ছিল, তা ২০১৯ পর্যন্ত অর্জন করা যায়নি। ফলে, উন্নত দেশগুলির সংকট কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধে তিনগুণ হয়েছে। বিশেষত, কোভিডের একটার পর একটা ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়েছে, তাতে অর্থনীতি ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার ফুরসতই পাচ্ছে না। কোভিড সংকট কাটাতে প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারই খরচ বাড়িয়েছে। এই খরচ বৃদ্ধি সংকটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
সরকার যখনই খরচ বাড়ায়, তখনই তাকে বাজার থেকে ঋণ করতে হয়। অন্যদিকে, সরকারি খরচ-বৃদ্ধি মূল্যবৃদ্ধির বাতাবরণ তৈরি করে। কোভিডের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশই মূল্যবৃদ্ধির সংকটে জর্জরিত। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আমাদের চিরাচরিত হাতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণনীতি। আটের দশক থেকে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নির্দেশিত পথেই চলেছে বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতি। এই পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণনীতির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ‘নরমপন্থা’ নিয়েই চলা হয়। কারণ আইএমএফ সবসময় সরকারগুলিকে খরচ কমানোর জন্য চাপ দেয়। কোষাগার ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে বলে। কোষাগার ঘাটতির পালটা হিসাবেই কাজ করে শিথিল ঋণনীতি। আমেরিকা-সহ উন্নত দেশগুলিতে ব্যাংকের সুদ কার্যত শূন্যের দিকে চলেছিল। ফলে লগ্নিকারীদের হাতে প্রচুর অর্থের জোগান, যা নিবেশ করা হচ্ছিল ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে।
অর্থনীতির বাস্তব অগ্রগতি ঘটুক না-ঘটুক, বিদেশি লগ্নি আমাদের শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। শেয়ার বাজারের এই চাঙ্গাভাব অর্থনীতিতে এমন একটা ধারণার জন্ম দেয়, যাতে দেশের সাধারণ লগ্নিকারীরা উৎসাহিত বোধ করে। কোভিড হঠাৎ করেই এই পরিস্থিতির কিছুটা বদল এনে দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে উন্নত দেশগুলি সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। সুদের হার বাড়া মানেই বাজারে লগ্নিযোগ্য মূলধনের দাম বৃদ্ধি। বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির শেয়ার বাজার থেকে লগ্নি তুলতে শুরু করে। শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি কিছুটা সরে যাওয়ায় রিজার্ভ ব্যাংকের উপর চাপ বাড়ে। সেই কারণেই রিজার্ভ ব্যাংক এখন মূল্যবৃদ্ধির চাপ সত্ত্বেও সুদ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না।
উন্নত দেশের বাজারে সস্তা নগদ অর্থের জোগান সীমিত হওয়ায় চারটি উন্নয়নশীল দেশের অন্তত একটি গভীর ঋণ সংকটে পড়েছে। বিদেশি লগ্নি উঠে যাওয়ায় এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। যার জেরে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধি মুদ্রাসংকটকে আরও গভীর করে ঋণের জালে ডুবিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এই সংকট থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে আইএমএফ-এর কাছে এই মুহূর্তে কোনও ওষুধই নেই। এর মধ্যে ইউক্রেন সংকট সমস্যাকে আরও গভীর করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চট করে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছিল, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এই যুদ্ধের একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। এখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই ধারণা, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হতে চলেছে। ফলে রাশিয়ার উপর যদি নিষেধাজ্ঞাগুলিও দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে, তাহলে বিশ্ববাজারে জোগানের সংকটগুলি দ্রুত মিটবে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্য জোগানের ক্ষেত্রে গভীর সংকট তৈরি করেছে। খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির সংকট উন্নত দেশগুলির উৎপাদন ও আর্থিক বৃদ্ধিতেও ধাক্কা দিয়েছে। কোভিড কিছুটা কমার পর যখন বহু দেশ ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই যুদ্ধের অভিঘাত চলে আসে। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ গোটা বিশ্বের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস এখনও কমিয়ে রেখেছে।
আইএমএফ যখন বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রেই কোনও উজ্জ্বল ছবি দেখতে পাচ্ছে না, তখন রিজার্ভ ব্যাংকই বা কীভাবে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির কোনও উজ্জ্বল ছবি আঁকতে সফল হবে? বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার ভাব মানেই আমাদের রপ্তানিতে ধাক্কা লাগা। ভারতের অর্থনীতির সামনে যে চাহিদার সংকট, তা একমাত্র কাটতে পারত রপ্তানি বাড়িয়ে। কিন্তু সেই সুযোগ থাকছে না। রপ্তানির ঘাটতির ফলে দেশের অর্থনীতিতে মন্দা চলছেই। ২০২০-তে কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার সময় লকডাউনের জেরে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি সম্পূর্ণ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বহু দেশে দীর্ঘ সময় ধরে কোনও অর্থনৈতিক কাজকর্মই ছিল না। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের যে অর্থনীতিগুলি ২০০৮-এর আর্থিক মন্দাকেই পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাদের পক্ষে লকডাউনে সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে যাওয়া একটি বড় ধাক্কা ছিল। ২০০৮-এ পৃথিবী জুড়ে যে আর্থিক মন্দা ছিল, তার ধাক্কা সেই সময় সরাসরি ভারতের উপর এসে পড়েনি। কিন্তু ওই সময় উন্নত দেশগুলির আর্থিক ক্ষতি পরে ভারতের বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কোভিড শুরুর আগেই, ২০১৯ থেকে ভারত অর্থনীতির চাহিদার অভাবে ধুঁকছিল। গত তিন বছরের আর্থিক মন্দা আমদানির চাহিদাকেও কমিয়েছে। ফলে রপ্তানি বাড়াতে না পারলে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় কোনও সংকট এখনও তৈরি হয়নি।
রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টটি, যেখানে বলা হয়েছে, কোভিডের ক্ষত মেরামতে আরও ১২ বছর প্রয়োজন, সেটি দেশবাসীর মনে যে হতাশার সৃষ্টি করেছে, তা বাজারে চাহিদাকে আরও প্রভাবিত করবে কি না, সেই সংশয় দেখা দিয়েছে। কোভিড সংক্রমণ কমতে থাকায় বহু মানুষ আশান্বিত ছিলেন যে, এবার দ্রুত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। রিজার্ভ ব্যাংকের রিপোর্ট তাদের সেই আশার জায়গাতেও একটি বড় ধাক্কা। রিজার্ভ ব্যাংক রিপোর্টে বলেছে, দেশের সরকারকে জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে। ঋণের পরিমাণ কমানো মানেই সরকারকে আরও কঠোর কোষাগার নীতি নিয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ, বিভিন্ন খাতে সরকারের দান-খয়রাতি কমাতে হবে। কোষাগার নীতি কঠোর করে কি সরকার নরম ঋণনীতি নিয়েই চলবে? প্রশ্ন এখন এইখানেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.