সরকারি বয়ান অনুযায়ী, কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখন ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’। প্রধানমন্ত্রীর এখন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ও লোকসভা সীমানা পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে ভোট করিয়ে মুসলমান-প্রধান কাশ্মীরে প্রথম কোনও এক হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আসীন করা। পঞ্চায়েত সদস্যদের জড়ো করে প্রকাশ্যে সেই রাজনৈতিক মহড়াই হল পালিতে। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আবার স্বপ্ন দেখালেন। এবার জম্মু-কাশ্মীরের (Jammu and Kashmir) তরুণ প্রজন্মকে। বললেন, আগের প্রজন্মের মতো আপনাদের আর কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে না। চাকরি দেব। মুখে হাসি ফোটাব। সোনালি দিন উপহার দেব। স্বপ্ন ফেরিতে প্রধানমন্ত্রীর জুড়ি নেই। স্বপ্ন দেখিয়ে জনমন জয়ের প্রতিযোগিতায় তিনি অদ্বিতীয়। স্বপ্ন সাকার হল কি না, সেই বিচারে কেই-বা যেতে চায়, যখন ভোটে তার বিরূপ প্রতিফলন ঘটে না? এভাবেই তো বিজেপিকে তিনি অজেয় করেছেন। পৃথিবীর বৃহত্তম দলের মর্যাদা দিয়েছেন। এ কৃতিত্ব অনন্য।
বছর তিন আগে ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর (Narendra Modi) জম্মু-কাশ্মীর সফর। উপত্যকায় অবশ্য নয়, জম্মুর সাম্বা জেলার পালি গ্রামে। দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরে কোনটা সত্য কোনটা অসত্য, কোনটা রঞ্জিত কোনটা অতিরঞ্জিত বোঝার কোনও উপায় আর নেই। কারণ, নিরপেক্ষ গণমাধ্যমের চিহ্নই নেই। কাজেই, সরকার যখন দাবি করছে, পঞ্চায়েতি রাজ দিবস উদ্যাপনে ‘৩০ হাজার’ পঞ্চায়েত সদস্য পালিতে জড়ো হয়েছেন, বিনা তর্কে তা মানা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামান্তর। প্রধানমন্ত্রী সেখানে বলেছেন, গণতন্ত্র তৃণমূল স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। উন্নয়নের যে-ফিরিস্তি তিনি শুনিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হলে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠারও দেরি নেই। সুসময় স্রেফ দু’হাত দূরে অপেক্ষায়।
সরকারি বয়ানে কাশ্মীর এখন সেই বিজ্ঞাপনী ভাষার মতো ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’। উপত্যকা কতটা শান্ত দিঘির জলের মতো স্থির তার প্রমাণ পর্যটকের প্লাবন। দশ বছরের পরিসংখ্যান ভেঙে পর্যটনে কাশ্মীর এবার রেকর্ড করেছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যটকের সংখ্যা সাড়ে তিন লক্ষ। শুধু মার্চেই ভিড় জমিয়েছেন প্রায় দু’-লক্ষ!
‘কাশ্মীরিয়ৎ’-এর কফিনে শেষ পেরেকটি যাঁর পোঁতা, উপত্যকা তাঁর আগমনে উত্তাল হল না, কোনও সংগঠন বন্ধ বা হরতালের ডাক দিল না, কেউ কালো পতাকা দেখাল না, প্রশাসনের গর্ব সেটাই। তাদের কাছে এটাই ‘স্বাভাবিকতা’-র সেরা বিজ্ঞাপন। ঘটা করে তা প্রচারও হচ্ছে। দেশ-বিদেশকে জানানো হচ্ছে কীভাবে বিশ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প একদা উপদ্রুত অধুনা স্বাভাবিক এই ভূখণ্ডে রূপায়ণের অপেক্ষায়।
যিনি দাবি করেন, সত্তর বছরে দেশ উচ্ছন্নে গিয়েছে, যা কিছু উন্নয়ন গত সাত বছরে এবং তিনিই তার রূপকার, সেই প্রধানমন্ত্রীর এখন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ও লোকসভা সীমানা পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে ভোট করিয়ে মুসলমান-প্রধান কাশ্মীরে প্রথম কোনও এক হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আসীন করা। পঞ্চায়েত সদস্যদের জড়ো করে প্রকাশ্যে সেই রাজনৈতিক মহড়াই হল পালিতে।
প্রকাশ্য এই উদ্যোগের পাশে রয়েছে এক পরোক্ষ প্রচেষ্টাও। সরকারের নির্দেশ মেনে লক্ষ্যে পৌঁছতে পরোক্ষে সেই কাজ করে চলেছে ‘ডিলিমিটেশন কমিশন’। কারও কোনও ওজর-আপত্তি ধোপে টিকছে না। কাশ্মীরের সব কর্তাই ‘ঠুলি আঁটা ঘোড়া’। ভূস্বর্গকে ‘আবদুল্লা-মুফতি-গান্ধীমুক্ত’ করাই তাঁদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা।
কাশ্মীরের ‘ভারতীয়করণ’-এর এই উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর হক। তাতে কাশ্মীরিদের ভাল হবে না মন্দ, উপত্যকা উদ্বেগহীন হবে না কি শান্তি-অশান্তির মাঝে পেন্ডুলামের মতো দুলবে, সংবিধানের অ্যায়সি-ত্যায়সি হল কি না- তা গৌণ। মুখ্য হল, রাজনৈতিক আদর্শের জয়। সেই জয় যা হিন্দুত্ববাদের প্লাবন ঘটিয়ে ক্রমে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে উপনীত করবে। কিন্তু এভাবে কাশ্মীরিদের দেশের মূল স্রোতে ফেরানো যাবে কি?
প্রশ্ন উঠছে নানা কারণে। একটা কারণ, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে কাশ্মীরিদের প্রতি উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের আচরণ। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর থেকে বিভিন্ন শহরে নানা কারণে কাশ্মীরিদের উপর আক্রমণ ঘটে চলেছে। লখনউয়ে কাশ্মীরি ড্রাই ফ্রুট বিক্রেতাদের বেদম মারের ঘটনা যেমন ঘটেছে- তেমনই উত্তরাখণ্ড, আগ্রা, মিরাট, ভোপাল, বেঙ্গালুরু, মহীশূরের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যের শহরে হিন্দুবাহিনীর হাতে হেনস্তা হতে হয়েছে কাশ্মীরি পড়ুয়াদের। ২০২১ সালের অক্টোবরে টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোয় হোয়াটসঅ্যাপে পাকিস্তানিদের অভিনন্দন জানানোর অপরাধে আগ্রায় তিন কাশ্মীরি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদে জেলে পচতে হচ্ছে। একের পর এক জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছে। রাষ্ট্রের চোখে তাদের অপরাধ ‘ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’-র সমতুল্য। কোথাও কাশ্মীরি শাল-বিক্রেতারা লুণ্ঠিত হচ্ছেন, কোথাও ‘ভারতমাতা’ ও রামের নামে জয়ধ্বনি দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে- তাঁরা কাশ্মীরি এবং মুসলমান, হিন্দু পণ্ডিতদের তাঁরাই পিটিয়ে ঘরছাড়া করেছেন। গত মাসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জানিয়েছিলেন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমা রিলিজের পর কাশ্মীরি মুসলমানদের প্রতি হিন্দু ভারতীয়দের একাংশের মনোভাব কঠোর হয়েছে। গোয়েন্দারা কাশ্মীরি পড়ুয়াদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী যতই স্বাভাবিকতার বড়াই করুন, অবশিষ্ট ভারতকে কাশ্মীর কতটা নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে তা শুধুমাত্র কাশ্মীরিদের উপর নির্ভর করে না। ‘স্টেটলেস অ্যাক্টর’ যারা, সীমান্তপার থেকে যারা চালিত, তাদের মতিগতির উপরেও তা পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। পাকিস্তান, চিন ও হালের আফগানিস্তানের মর্জির দিকে সেজন্য তাকিয়ে থাকতে হবে। তাদের মানসিকতার লেখচিত্র আবার ওঠানামা করবে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কত দ্রুত দেশ এগচ্ছে তার উপর। হিজাব, হালাল, আজান বিতর্ক যত তীব্র হচ্ছে, ধর্মগুরুরা যত জোরে গণহত্যার হাঁক পাড়ছেন, পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও গেরুয়াধারী হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমান নারীদের ধর্ষণের নির্দেশ দিচ্ছেন, ততই তীব্র হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন এবং গভীর হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ফাটল। কাশ্মীর উপত্যকাতেও সেই অনুরণন পরিলক্ষিত। অবিরাম ‘বাছাই হত্যা’ সার্বিক বিপন্নতাবোধ তীব্রতর করছে। পর্যটকদের ঢল যে স্বাভাবিকতার নমুনা নয়, কবুল না করলেও সরকার তা বোঝে। নিরাপত্তায় ছিটেফোঁটা ঢিলেমিতে তাই তারা রাজি নয়। ‘স্বাভাবিক’ কাশ্মীর আজও তাই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বন্দি।
দিল্লিতে ঘটা করে চলছে ‘রাইসিনা ডায়লগ’। নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত এক পদস্থ সরকারি কর্তা সেই অবসরে বললেন, কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরছে কি না তা বিচার ও বোঝার সেরা ও সহজতম মাপকাঠি হল, ভিটেমাটি-হারা পণ্ডিতদের মন। নির্ভাবনায় তাঁরা উপত্যকায় ফিরতে রাজি হলে বুঝতে হবে আস্থা ও স্বাভাবিকতা দুই-ই ফিরেছে। না হলে অবস্থা ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’। পণ্ডিতেরাই সেরা ‘ইন্ডিকেটর’। সাড়ে তিন দশক ধরে চলছে পণ্ডিত-প্রত্যাবর্তনের সেই প্রতীক্ষা।
অবশিষ্ট ভারত স্বাভাবিক না হলে কাশ্মীর কি স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারে? প্রশ্নটি যথাযথ এবং প্রাসঙ্গিক। সংখ্যালঘুর প্রতি ‘বৈষম্য’-র যে-ছবি এখনও জ্বলজ্বলে, যার উল্লেখ সরকারকে সর্বদা ক্ষিপ্ত করে, সেই মানসিকতার বদল না হলে কাশ্মীর কী করে স্বাভাবিক হবে? এখনও মুসলমানদের দিল্লির হোটেলে ঘর পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। গত মাসে বুকিং সত্ত্বেও দিল্লির হোটেল এক কাশ্মীরি মুসলমানকে জায়গা দেয়নি। হোটেলের দাবি, তাদের উপর দিল্লি পুলিশের নির্দেশই নাকি এমনই। রাইসিনা ডায়লগে যোগ দিতে দিল্লি আসা বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গবেষক-লেখক এএসএম সামসুল আরেফিনকেও এমনই ভোগান্তি পোহাতে হল। নামকরা হোটেলে অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং সত্ত্বেও তাঁর এই হেনস্তা।
আমেরিকার ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম কমিশন’ তার সর্বশেষ বার্ষিক রিপোর্টে এবারও জানিয়েছে, নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব হয়েই চলেছে। সরকারকে তাদের সুপারিশ, ‘উদ্বেগজনক’ দেশের তালিকায় ভারতকে রাখা হোক। এই নিয়ে পরপর তৃতীয়বার এমন পরামর্শ! সরকার যতই অস্বীকার করুক, তৃণমূল-স্তরের চিত্র দিন দিন মলিন হচ্ছে। কাশ্মীরের নতুন প্রজন্ম প্রধানমন্ত্রীর দেখানো স্বপ্নে কতটা বিভোর হয় তা দেখতে অপেক্ষায় দেশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.