ফাইল ফটো
লোকসভা ভোটের আগে মহারাষ্ট্রে বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’ কতটা সফল হবে, এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ আগামী কয়েক দিনে বিস্তর হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এটাও প্রশ্ন যে, শিব সেনা দলটির অস্তিত্ব থাকবে কি না। দলবদলের আইনি জটিলতা এড়াতে একনাথ শিণ্ডেদের অন্য কোনও দলে মিশে যেতে হবে। শিণ্ডে বিজেপিতে মিশতে রাজি, কিন্তু তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই বালাসাহেবের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার চলে গেলে কি উদ্ধবের পক্ষে ভগ্নহৃদয় দলটিকে বাঁচানো সম্ভব? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরাধিকার কার, তা নিয়ে ফের উত্তপ্ত মহারাষ্ট্র। তবে এই উত্তাপ কার্যত উত্তাপ নয়। আট ও নয়ের দশকে ঠাকরের এক-একটা হুংকারে যেভাবে জ্বলে উঠত মুম্বই, থানে, নাসিক, পুণের মতো শহর- এখন শিব সেনার এই মুষল পর্বে তার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। বিজেপির মহারাষ্ট্রে ‘অপারেশন লোটাস’ শুধু দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং মহাবিকাশ আগাড়ি-র জোট সরকারকে খাদের কিনারে দাঁড় করায়নি, শিব সেনাকেও সমূলে উৎপাটন করার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
বিদ্রোহী সেনা বিধায়কদের নেতা একনাথ শিণ্ডে দলবল নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন কি না, তা স্পষ্ট হতে হয়তো আরও সময় লাগবে। তবে ‘মাতশ্রী’ থেকে যে শিব সেনার (Shiv Sena) রাশ চলে গিয়েছে, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সিবিআই, ইডি-র ত্রাসে মায়াবতীর আস্ত দলটাই প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে। উত্তরপ্রদেশে ‘বহুজন সমাজ পার্টি’-র সলতেটা এখন টিমটিম করে জ্বলছে। দলিতদের ‘মসিহা’ কাঁসিরাম একসময় বহুজন সমাজ পার্টি-কে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, তারা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে সফল হয়েছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে এই কথাটি প্রচলিত যে, ‘উত্তরপ্রদেশ যার, দিল্লি তার।’ কাঁসিরামের শিষ্যা মায়াবতী তাই প্রধানমন্ত্রী চেয়ারের স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলেন। এখন, সেই উত্তরপ্রদেশে স্রেফ অস্তিত্বের লড়াই লড়তে হচ্ছে বহেনজিকে। কেন্দ্রীয় এজেন্সি লেলিয়ে বিজেপির বহুচর্চিত ‘অপারেশন লোটাস’ বহেনজির দলিত ভোটব্যাংক প্রায় পুরোটাই গিলে ফেলতে সচেষ্ট হয়েছে।
এই পরিণতি বালাসাহেব ঠাকরের শিব সেনার জন্য অপেক্ষা করছে কি না, তা দ্রুত বোঝা যাবে। মহারাষ্ট্রর রাজনীতিতে শিবসেনা নামে উগ্র জাতীয়তাবাদী এই দলটির পত্তন ঘটেছিল ছয়ের দশকের শেষভাগে। ‘মহারাষ্ট্র শুধু মারাঠিদের’ দিয়ে শুরু করে যাদের স্লোগান শেষ পর্যন্ত ‘হিন্দুস্তান হিন্দুদের’- এই জায়গায় এসে পৌঁছেছিল, তারা এখন শুধু অতীতের ছায়া। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে যে, গেরুয়াধারী বালাসাহেবের শিব সেনার মধ্যে এখন লড়াইটা এসে দাঁড়িয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষ মহাবিকাশ আগাড়ি জোটে থাকা হবে, না কি হিন্দুত্ববাদী এনডিএ জোটে ফিরে যাওয়া হবে। এনডিএ-তে ফিরলেও যে শিব সেনার কঙ্কাল ছাড়া কিছু ফিরবে না, তা বলা বাহুল্য।
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের জয়ের পর মহারাষ্ট্র (Maharashtra) নিয়ে যে বিজেপি চুপচাপ বসে থাকবে না, তা বোঝাই যাচ্ছিল। ২০২৪-এর আগে মহারাষ্ট্র দখলে আনা যে মোদি-শাহদের অ্যাজেন্ডায় আছে, সেটা বোঝার জন্য রাজনীতিতে পারদর্শী হওয়ার প্রয়োজন নেই। মহাবিকাশ আগাড়ি জোটকে দুর্বল করার চেষ্টা বিজেপি ২০১৯ থেকেই লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে। মহারাষ্ট্রে লোকসভার আসন ৪৮টি। লোকসভার আসন সংখ্যার নিরিখে উত্তরপ্রদেশের পরেই মহারাষ্ট্র। ফলে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যে কংগ্রেস, এনসিপি ও উদ্ধবের শিব সেনাকে নিয়ে গঠিত মহাবিকাশ আগাড়ি জোটকে ক্ষমতায় রেখে বিজেপি যে লোকসভার ভোটে যেতে চাইবে না, তা নিয়ে সন্দেহ রাখা উচিত নয়। ইডি, সিবিআই-কে যথেচ্ছ ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত শিব সেনাকে কার্যকরভাবে ভেঙে ফেলার একটা জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন মোদি-শাহরা।
বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র হিসাবে উদ্ধব শিব সেনার ক্ষমতা পেয়েছিলেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যে বালাসাহেবের আর কোনও রাজনৈতিক গুণাবলি অর্জন করতে পারেননি, তা বোঝা যাচ্ছে। নয়ের দশকে বালাসাহেবকে কিছু দুষ্কৃতী ফোনে খুনের হুমকি দিয়েছিল। তার জবাবে বালাসাহেব পরের দিন দলীয় মুখপত্র ‘সামনা’-তে হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর গায়ে একটি আঁচড় লাগলে, যারা হুমকি দিচ্ছে, তারা যে সম্প্রদায়ের মানুষ, সেই সম্প্রদায়টিকেই দেশ থেকে মুছে ফেলবে শিব সৈনিকরা। বালাসাহেবের এই ধরনের উগ্র মন্তব্যের সমালোচনায় দেশে ঝড় ওঠে। তাতে থোড়াই কেয়ার ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’-এর। আগুন জ্বলেছিল গোটা মহারাষ্ট্রে। গত কয়েক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, বাবার পথ ধরে উদ্ধব জনরোষ উসকে দিয়ে দলের বিদ্রোহীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু, তাতে যে বিশেষ সাড়া মিলছে, তেমনটা নয়।
যে স্ট্রিট ফাইটিংয়ের রাজনীতিকে পুঁজি করে বালাসাহেবের উত্থান ঘটেছিল, দলের ক্ষমতা পেয়ে ঠিক তার উল্টোপথে হেঁটেছেন উদ্ধব। তিনি বরাবর ভরসা করেছেন ‘কোর্টরুম’ রাজনীতিকে। উদ্ধবের এই রাজনৈতিক কৌশল তাঁকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করেছে মূলধারার শিব সৈনিকদের থেকে। মূলধারার শিব সৈনিকরা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে কৌশলী রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ রাস্তায় নেমে ভাঙচুর, অবরোধের রাজনীতিতে। শিব সেনার এই বিদ্রোহী একনাথ শিণ্ডের তুলনা চলতে পারে একদা এ রাজ্যের বিতর্কিত নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে। সিপিএমে একসময় সুভাষ চক্রবর্তীর যে অবস্থান ছিল, শিব সেনার রাজনীতিতে শিণ্ডে অনেকটা তেমনই। বালাসাহেবের মৃত্যুর পর শিবসেনা যত উদ্ধবের দখলে গিয়েছে, তত দলে কোণঠাসা হয়েছেন শিণ্ডে। উদ্ধব তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে তুলে এনেছেন পুত্র আদিত্যকে। তিনি শিব সেনাকে আরও বেশি ঠান্ডাঘরের রাজনীতিতে নিয়ে গিয়েছেন। নেতৃত্বে কোণঠাসা হলেও শিণ্ডে ক্রমশ সমর্থন পেয়েছেন শিব সেনার নিচুতলার কর্মী ও বিধায়কদের। শিণ্ডে উপলব্ধি করেছেন, বালাসাহেবের উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতিতে ফিরে না গেলে অস্তিত্ব রাখা অসম্ভব।
একহাতে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও অন্য হাতে শিণ্ডের এই উপলব্ধিকে ‘অপারেশন লোটাস’ সফল করতে ব্যবহার করছে বিজেপি। দলের অধিকাংশ বিধায়ক গুয়াহাটিতে পাড়ি জমানোর পর এখন উদ্ধবও উপলব্ধি করছেন, তাঁর বাবার স্ট্রিট ফাইটিংয়ের রাজনীতির গুরুত্ব। বালাসাহেব যখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেন, তখনই হুমকি দিয়ে আগ্রাসী রাজনীতিতে ফিরতেন। ’৯৩-এর মুম্বই দাঙ্গায় প্ররোচনার অভিযোগে নয়ের দশকের শেষে তাঁকে যখন তৎকালীন কংগ্রেস সরকার গ্রেপ্তার করে, তখন মহারাষ্ট্র জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের বিপদ কাটিয়েছিলেন বালাসাহেব। উদ্ধব সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাস ‘বর্ষা’ ছেড়ে ‘মাতশ্রী’-তে ফেরার মধ্য দিয়ে। এক অভিনব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশ। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরিবার ও বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে সরকারি বাসভবন ত্যাগ করলেন, অথচ চেয়ার থেকে সরলেন না। বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ের রাত দেখল উদ্ধবের সঙ্গে হাজার দশেক শিব সৈনিক ১০ কিলোমিটার রাস্তায় শামিল হলেও তাদের সেই চিরাচরিত রোষ উধাও। বালাসাহেবের জীবদ্দশায় শিব সৈনিকদের যে উগ্র রোষের বহিঃপ্রকাশ দেখতে গোটা মহারাষ্ট্র অভ্যস্ত ছিল, তার ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব নেই এই নয়া প্রজন্মের শিব সৈনিকদের।
লোকসভা ভোটের আগে মহারাষ্ট্রে বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’ কতটা সফল হবে, দেশের রাজনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে- এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ আগামী কয়েক দিনে বিস্তর হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এটাও প্রশ্ন যে, শিবসেনা দলটির অস্তিত্ব থাকবে কি না। দলবদলের আইনি জটিলতা এড়াতে একনাথ শিণ্ডেদের অন্য কোনও দলে মিশে যেতে হবে। শিণ্ডে বিজেপিতে মিশতে রাজি, কিন্তু তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই বালাসাহেবের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যেতে চান। উদ্ধব, আদিত্যরা দাবি করছেন, তাঁরা এখনও বালাসাহেবের উত্তরাধিকার বহন করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার চলে গেলে কি উদ্ধবের পক্ষে টুকরো হয়ে যাওয়া দলটিকে বাঁচানো সম্ভব? না কি শিব সেনার পরিণতিও বিএসপি-র মতো হতে চলেছে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.