ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে পুতিন এখন রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসাবে দেখছেন। পুতিন পরমাণু হামলা চালাতে পারেন ধরে নিয়ে সবরকম প্রস্তুতি সেরে রাখছে ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সরকার। কিন্তু পুতিন যদি সত্যিই ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালান, তাহলে রাশিয়ার উপরও তো প্রত্যাঘাত হবে? আপাতত পুতিনের উপর নজরদারি বাড়ানো ছাড়া বাকি বিশ্বের কিছু করার নেই। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেভাবে লাগাতার ইউক্রেনে পরমাণু হামলার হুমকি দিয়ে চলেছেন, তা ক্রমশ পৃথিবীর কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। পুতিনের এই হুমকিকে আমেরিকা-সহ কোনও দেশই উপেক্ষা করার রাস্তায় যেতে পারছে না। সত্যি সত্যিই পুতিন ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালাতে পারেন- এমন একটা আশঙ্কা বিশ্বে তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেদিকে চলেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে আর্থিক মহামন্দার সম্ভাবনাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এ-বছরের গোড়ায় ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা শুরু করার পর যে আর্থিক সংকট ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে দেখা দিয়েছে, অদূরভবিষ্যতে তার নিষ্পত্তির কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। এরপর যদি যুদ্ধে পুতিন পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান, তাহলে পরিস্থিতি যে এক ভয়ংকর দিকে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগামী বছরটা বিশ্বের জন্য খারাপ যাবে বলে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলি বলতে শুরু করেছে। ভারতের জন্যও এখনও কোনও সুখবর নেই। বস্তুত, কোভিডের সময় থেকেই আর্থিক মন্দার পরিস্থিতি চলছে। একদিকে প্রবল মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, অন্যদিকে বেকারত্ব বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ আর্থিক মন্দা নেমে এলে ভারতের পক্ষে পরিস্থিতি যে আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, তা বলাই বাহুল্য। উন্নত দুনিয়ায় আর্থিক মন্দা যত প্রবল হবে, তত আমাদের বহির্বাণিজ্য ধাক্কা খাবে। রপ্তানি কমবে। বিদেশি মুদ্রার আয় কমবে। দেশে জিনিসপত্রর দাম আরও চড়া হবে এবং বেকারত্ব আরও বাড়বে। অর্থাৎ, মহামন্দার আশঙ্কা সত্যি হলে আগামী বছরে ভারতে কত মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে, তা অনুমান করতেই ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। যদি পুতিন সত্যি করেই ইউক্রেনের (Ukraine) উপর পরমাণু হামলা চালান, তাহলে ওই মহামন্দাকে কোনওভাবেই ঠেকানো সম্ভব হবে না।
গোটা বিশ্ব যখন ভয়ংকর দিনগুলির কথা আশঙ্কা করে আতঙ্কে কাঁপছে, তখন কেন পুতিন এভাবে পরমাণু হামলা চালানোর একগুঁয়ে জেদ নিয়ে চলেছেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যে-যুক্তিতে বাকি বিশ্ব পুতিনের সম্ভাব্য পরমাণু হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কিত, সেই যুক্তিবোধ রুশ প্রেসিডেন্টের কাজ করছে না। কারণ তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসাবে দেখছেন। অর্থাৎ, ইউক্রেনের এই যুদ্ধ তাঁকে জিততেই হবে। যুদ্ধ জিততে না পারলে মৃত্যুই তাঁর কাছে শ্রেয়। যুদ্ধজয় ও মৃত্যুর মাঝামাঝি কিছু পুতিনের কাছে নেই। সেই কারণে পুতিন পরমাণু হামলার পরিণতির কথাটা বিবেচনা করতে নারাজ। ইউক্রেন যুদ্ধ যদি তাঁকে জিততে হয়, তাহলে তাঁকে পরমাণু হামলা নিশ্চিত করতে হবে, এমন একটা বাস্তবতাই ক্রমশ উঠে আসছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত- পুতিন একটি আহত পশু। যে দিনকে দিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
হেরে যাওয়ার মানসিকতা থেকেই পুতিন (Vladimir Putin) বারবার পরমাণু হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ পুতিন আর জেতার জায়গায় নেই বলেই শুধু পশ্চিমি দুনিয়াই মনে করছে না, ইরান ও বেলারুশের মতো পুতিনের দুই বন্ধু-দেশও মনে করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় ঘটতে চলেছে। এই পরাজয়ের মানসিকতাই পুতিনের মনে গেঁথে বসেছে। সেই পরাজয়ের মানসিকতা থেকেই শেষ অস্ত্র হিসাবে পুতিন পরমাণু হামলার পরিকল্পনা করছেন। প্রথাগত যুদ্ধে পরাজয় দেখলে শক্তিধর দেশগুলি এভাবেই পরমাণু হামলার হুমকি দেয়। ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসাবে পরমাণু অস্ত্র প্রথম প্রয়োগ করবে না- এই নীতি নিয়ে চলে। ভারতের কাছে পরমাণু অস্ত্র হল আক্রমণ মোকাবিলায় প্রতিবন্ধক। ভারতের উপর কেউ পরমাণু হামলা না চালালে ভারত কখনওই প্রত্যাঘাত করবে না। আগ বাড়িয়ে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করার নীতি ভারতের নয়। কিন্তু, রাশিয়া কখনওই এই নীতিতে চলে না। ফলে, রাশিয়া যুদ্ধ জয় করতে পরমাণু অস্ত্রের শরণাপন্ন হতেই পারে।
ইউক্রেনও রাশিয়ার পরমাণু হামলার আশঙ্কায় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের নাগরিকদের সরকারের তরফে পটাশিয়াম আয়োডিন ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। পটাশিয়াম আয়োডিন ট্যাবলেট শরীরে পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি কমাতে সক্ষম। ইউক্রেনে যে সমস্ত পরমাণু হামলা প্রতিরোধকারী বাঙ্কার ও আশ্রয়স্থল রয়েছে, সেগুলিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, পুতিন পরমাণু হামলা চালাতে পারেন ধরে নিয়ে সবরকম প্রস্তুতি সেরে রাখছে ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সরকার। কিন্তু পুতিন যদি সত্যিই ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালান, তাহলে রাশিয়ার উপরও তো প্রত্যাঘাত হবে? আমেরিকা ইতিমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছে, পরমাণু হামলা চালালে তার পরিণতি রাশিয়ার পক্ষে ভাল হবে না। পুতিন অবশ্য প্রত্যাঘাত নিয়ে কোনও আশঙ্কায় আমল দিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, ‘আমরা পরমাণু হামলা নিয়ে যে-কথা বলছি, তা কাউকে ঠকানোর জন্য নয়। যারা আমাদের পরমাণু হামলা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে, তাদের জেনে রাখা ভাল যে, হাওয়ামোরগ একদিন তাদের দিকেও ঘুরবে এবং তাদের নিশানা বানাবে।’ পুতিনের অভিমত হল, পশ্চিমি দুনিয়া রাশিয়াকে ধ্বংস করতে নেমেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। ক্রেমলিনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের উপর পরমাণু হামলা চালিয়ে আমেরিকাই দৃষ্টান্ত তৈরি করে রেখেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ জেতার জন্য পুতিন তাঁর বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছেন। আরও নতুন নতুন অস্ত্র নিয়ে এসেছেন। কিন্তু রুশ বাহিনীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বহু রুশ সেনা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে পুতিন পরমাণু হামলার জন্য কালক্ষেপ না করতে পারেন বলেও মার্কিন বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সেই কারণে পুতিনের পরমাণু হামলার কথা আগাম জানার জন্য আমেরিকা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজে সব শক্তি নিয়োগ করেছে। সবরকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরমাণু হামলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তবে পুতিন যদি চিরাচরিত যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে ইউক্রেনে ছোটখাটো পরমাণু অস্ত্র দিয়ে হামলা চালান, তাহলে তা কীভাবে রোখা সম্ভব? সেটা নিয়েই এখন যাবতীয় উদ্বেগ। আপাতত পুতিনের উপর নজরদারি বাড়ানো ছাড়া বাকি বিশ্বের কিছু করার নেই। যে কোনও দিন ইউক্রেনে পরমাণু হামলা ঘটে গেলে, তার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে শুধু জল্পনাই একমাত্র ভবিতব্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.