অনেকেই বলেন, মোদি ও ট্রাম্প পরস্পরের জন্য একদম ঠিকঠাক। দু’জনেই শক্তিশালী পৌরুষের প্রতিচ্ছবি বহন করেন, লোকপ্রিয় আঙ্গিককে রাজনীতিতে মিশিয়ে নিতে চান। প্রদর্শনকামী ভাবমূর্তিতে ভরসা রাখেন। তায় উগ্র-দক্ষিণপন্থী। কিন্তু মোদি এরপরেও দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে লিপ্ত। কিন্তু ট্রাম্প? বিগ বস ও শোস্টপার। এঁদের ‘বন্ধুত্ব’ এবার আগের মতো জমবে তো? লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
আমরা ভুলে যাইনি সে-ই টেক্সাস, ২০১৯।
প্রমত্ত জনসভায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন– ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’! কূটনীতির তোয়াক্কা করেননি। পরের বছর, ট্রাম্প ও মোদিকে আবার গলায়-গলায় দেখলাম আমরা– আহমেদাবাদের ‘নমস্তে ট্রাম্প’ সমাবেশে। কিছুটা বোঝার ভুলের জন্য হোক, কিছুটা বাড়তি উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার কারণে হোক, নয়াদিল্লি এরপর স্রোতের বিপরীতে আবিষ্কার করল নিজেকে, যখন ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেলেন। ওয়াশিংটন ডিসি-তে শুরু হল ‘অব কি বার বাইডেন সরকার’। কিন্তু এই বছর, অভাবনীয়ভাবে, পুনরায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এসেছেন মার্কিন মসনদে। ফিরেছেন আগের বারের চেয়ে বেশি ভোট-ব্যবধানে। এখন প্রশ্ন হল, ট্রাম্প ও মোদি– এই দুই রাষ্ট্রনেতার সম্পর্কে কি পুরনো উষ্ণতা নতুন করে ঝলসে উঠবে?
সাম্প্রতিকের একটি টেলি-সাক্ষাৎকারে মোদি ‘ডিয়ার ফ্রেন্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন ট্রাম্পকে। বস্তুত, এমন গুঞ্জন কান পাতলে ঠাহর হয় যে, মোদি ও ট্রাম্প পরস্পরের জন্য একদম ঠিকঠাক। দু’জনেই শক্তিশালী পৌরুষের প্রতিচ্ছবি বহন করতে ভালবাসেন। লোকপ্রিয় আঙ্গিককে রাজনীতিতে মিশিয়ে নিতে চান, লম্বাচওড়া বক্তব্য শুনিয়ে। প্রদর্শনকামী ভাবমূর্তিতে ভরসা রাখেন। তঁাদের রাজনীতির ধরনধারণে আরও মিল রয়েছে। কী করে চটকদার স্লোগান দিয়ে মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতে হয়, দু’জনেই খুব ভাল বোঝেন। ট্রাম্প এবার ভোটে জিতে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’ (‘মাগা’) হেঁকে বসে আছেন। অনুরূপভাবে মোদিকেও আমরা দেখেছিলাম ‘অমৃতকাল’ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত’ ভারতের সন্ধানে প্রোৎসাহী হতে। আবার, লিবারাল ভাবধারার প্রতি দু’জনেরই আস্থা নেই। দু’জনেই দক্ষিণপন্থী ও জাতীয়তাবাদী উগ্রতার পক্ষে। মোদি যদি আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দু করেন “লুটিয়েন’স দিল্লি”-র অভিজাতদের, তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিশানায় রয়েছে ক্যাপিটল হিলের এস্ট্যাবলিশমেন্ট। কঠোরভাবে অভিবাসন নীতির বিরোধিতা করতে দেখি আমরা ট্রাম্পকে। এর সঙ্গে কেউ যদি সেসব মোদি-ভক্তর সাযুজ্য খুঁজে পায়, যারা ভারতীয় মুসলিমদের, এই দেশের পরিসরেই ‘বহিরাগত’ বলে মনে করে, তাহলে বলার কিছু নেই!
ট্রাম্প-অনুরাগীরা মেক্সিকো সীমান্তে সুরক্ষা-পঁাচিল তুলতে চায়, আর মোদি-অনুরাগীরা বানাতে চায় মসজিদ ভেঙে মন্দির। সর্বোপরি, দু’জনেই সারাক্ষণ ‘সন্দেহজনক শত্রু’-কে খুঁজতে অনুরাগীদের ব্যস্ত করে রেখেছেন।
তবে কেবল মিলের দিকটা দেখলেই হবে না। যদি তঁাদের পরস্পরের অসংগতি ও অসামঞ্জস্য নিয়ে আলোচনা হয়, তবে তা কিন্তু সাযুজ্যের তালিকাটিকে ছাপিয়ে যাবে। এঁদের রাজনৈতিক যাত্রাপথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। নরেন্দ্র মোদি রাজনীতিতে রয়েছেন অন্তত অর্ধশতক। আরএসএস-এর প্রচারক ছিলেন। তারপর সন্তর্পণে ও সুকৌশলে ক্ষমতার সিঁড়ি ভাঙতে থাকেন সংঘ পরিবারের বৃহত্তর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমত ও প্রধানত একজন অর্বুদপতি ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে আসার পর তঁার উল্কাসৃদশ উত্থান আমরা দেখেছি। বিজেপির অন্দরমহলের ধাপগুলি পেরতে-পেরতে মোদি এগিয়েছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প ‘বহিরাগত’ হয়েই অঁাকড়ে ধরেছিলেন রিপাবলিকানদের। মোদি নিজেকে হিন্দুত্বের আইকন ও সংকটমোচন বলে চেনাতে পছন্দ করেন। অন্যদিকে, ‘ডিল মেকার ইন চিফ’– এমন ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ট্রাম্প। যা কিছু ‘ডিল’, সবই তিনি নিজের মতো করে ক্র্যাক করতে চান। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যক্তিত্বের জাল বুনতে ও বিস্তার দু’জনেই ভালবাসেন। আত্মমোহ ও আত্মচেতনায় দু’জনেই সমান। তবে মোদি এখনও আপন দলীয় রাজনীতির শৃঙ্খলার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে রয়েছেন, অন্যদিকে ট্রাম্প রাজনৈতিক আবহটাকেই দুমড়েমুচড়ে পুরো তছনছ করে দিতে চান– নিজের খেয়ালে চলার স্বার্থে।
চারিপাশকে ঝঁাকিয়ে দেওয়ার এই সহজাত প্রবণতাই কি ট্রাম্পকে করে তুলেছে অনেক বেশি বিপজ্জনক ও অনিশ্চয়ে ভরা? অামাদের মনে পড়বে, মোদি তঁার প্রধানমন্ত্রিত্ব-কালে বেশ কয়েক বার সচেতনভাবে রাজনৈতিক পরিসরকে ঝঁাকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছিলেন– এমন ধরনের পদক্ষেপ করেছেন– যা চিরাচরিত রাজনৈতিক ধারণার বিপরীত পিঠে দঁাড়ায়। যেমন, ‘কালো টাকা’-র বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তিনি ২০১৬ সালে ‘বিমুদ্রাকরণ’-এর ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েও মোদি একটা স্তরে গিয়ে রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের প্রশ্নে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করে যান না। মানে, গভীর রাতে টুইট করে তিনি অন্তত বলেননি, পড়শি দেশে হামলা চালিয়ে তা দখল করতে হবে!
এর বিপরীতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প, নিয়ম করে চলতি রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বৃত্তটিকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। যেমন, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ট্রাম্প একগুচ্ছ রাজনৈতিক মন্তব্য করে বসলেন, নিবিড়ভাবে খেয়াল করতে বোঝা যাবে, তা বিপক্ষীয় রাজনৈতিক শিবিরকে বিভ্রান্ত করতে ও সম্মুখসমরে জড়িয়ে পড়তে প্ররোচনা জোগায়। কলম্বিয়ার অনুপ্রবেশকারীদের গারদে ভরা নিয়ে সে-দেশের প্রেসেডিন্টের সঙ্গে বাক্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া হোক, বা মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মেক্সিকো উপসাগরের নামকরণ নিয়ে বিতর্ক হোক– যে কোনও ইস্যুতে ট্রাম্প আসলে চান– প্রতিপক্ষকে ঠেসে ধরতে, আর তার জন্য রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার পরিবেশকে আন্দোলিত করে তোলা খুব দরকার। রাজনৈতিক সংশোধনবাদের দিকে তঁার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিনি এতটাই ব্যক্তিসত্তা-মনস্ক ও স্বাধীনচেতা।
মোদি এরকম নন। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। হাই-প্রোফাইল ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর লোগো হিসাবে তিনি মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত চশমা পছন্দ করেছিলেন, এবং তা বেশ লাগসই সিদ্ধান্ত, মানতেই হবে। ‘লৌহ মানব’ সরদার প্যাটেলের উত্তরসূরি রূপে যখন নিজেকে তিনি নির্বাচিত করেন, তার মধ্যেও সুচিন্তিত রাজনীতির ছাপ প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু ট্রাম্পের রাজনীতির ধরন দেখলে কারওরই মনে হবে না, এই মানুষটির সঙ্গে আমেরিকার পূর্বতন রাজনৈতিক ইতিহাসের আদৌ কোনও যোগ আছে! বরং মনে হবে যে, ইতিহাসকে তিনি আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে ব্যক্ত করতে ব্যস্ত।
এরপর, যথারীতি যে-কথাটি এসে যায়, তা এই নিবন্ধের প্রথমে তোলা প্রশ্নটিকেই অনুসরণ করে– আগামী পঁাচ বছর ট্রাম্প ও মোদি কি বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতে পারবেন? কোনও যৌথ সম্পর্কেই অধস্তন ব্যক্তির ভূমিকা পালন করতে মোদি পছন্দ করেন না। অন্যদিকে, ট্রাম্প খ্যাতির আলো ভাগ করতে চান কারও সঙ্গে। কাজেই একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার প্রবণতাটি এখানে দু’-তরফে দু’রকমভাবে স্পষ্ট। ভারতীয় কূটনীতির দিক থেকে আমেরিকার মতো দেশের সঙ্গে একাসনে বসতে পারা একটা বলার মতো বিষয়। কিন্তু ট্রাম্প আবার অন্যদের হ্যাঠা করতে, ভয় দেখাতে অভ্যস্ত।
সেদিক থেকে দেখলে, ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটি বেশ অপ্রতিসম। আমেরিকা সুপার পাওয়ার, বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব কাটানোর ক্ষমতা অপরিসীম। ভারত, ক্ষমতার রাজনীতিতে, তত বড় হয়তো নয়, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ট্রাম্পের কাছে ভারতের বিরাট বাজারের কদর রয়েছে। তবে সেই বাজারকে তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির চশমায় ধরতে চান। আর, মোদির কাছে আমেরিকা আশাবাদের প্রতিভূ– যদি ট্রাম্পের সরকার ভারতকে ‘বন্ধু’ ও ‘সহযোগী’-র মর্যাদা দেয়।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে একশ্বাসে চিন ও ভারতের নাম নিয়েছেন, তাদেরকে এক বন্ধনীভুক্ত করে ‘ট্রিমেন্ডাস ট্যারিফ-মেকার’ (শুল্ক আদায়ে অত্যুৎসাহী) অভিধা দিয়েছেন। এতে খানিকটা শঙ্কা যে ঘনায়, তা মানতে হবে। ভুললে চলবে না, এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট কূটনীতির তেমন পরোয়া করেন না, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ধারও তেমন ধারেন না। ট্রাম্পের বৈশ্বিক রাজনীতির দর্শনটি পুরনো বন্ধুত্বের উপরও নির্ভর করে না তেমন। চুম্বকে: ডোনাল্ড ট্রাম্প বেজিং এবং নিউ দিল্লি– দু’পক্ষের সঙ্গেই ‘ডিল’ করবেন, তবে তা করবেন নিজের শর্তে। হোয়াইট হাউসের বর্তমান বাসিন্দাটি নিরবিচ্ছিন্ন আত্মস্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না, তঁার কাছে উচ্চ মূল্যবোধের তেমন গুরুত্ব নেই। অন্য দেশের সঙ্গে সংলাপেও যে তিনি এ-স্বভাব ধরে রাখবেন, প্রত্যাশিত।
পরে কয়েক মাস তাই ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি সময়পর্ব। ত্বরা দেখালে হবে না, ধৈর্য রাখতে হবে, আর প্রতিটি পট পরিবর্তনে নজর রাখতে হবে। সৌজন্যবোধে সামান্য অঁাচড়টি না পড়তে দিয়েই মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে ট্রাম্পকে, যে, ২০১৯ সালের মার্কিন ভোটে তিনি কেমনভাবে পাশে দঁাড়িয়েছিলেন তঁার। যদিও এর পরিণতি কেমন হবে, ভাল না খারাপ, তা অনুমান করা দুঃসাধ্য। ব্যাপারটা এরকম–
যেন কোনও রিয়েলিটি শো চলছে, ট্রাম্প তঁার একমেবাদ্বিতীয়ম ‘বিগ বস’। সেই শো-তে একজনের কণ্ঠই শোনা যায়– তিনি স্বয়ং ট্রাম্প। বাকি সব দেশ, তার মধ্যেই ভারতও আছে, নিরীহ দর্শক বই কিছু নয়! কী আসতে চলেছে পরের দফায়, সে নিয়ে কারও তেমন কোনওধারণা নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.